সুমন ভাইয়ের কথাটা এভাবে ফলে যাবে, ঘুণাক্ষরেও কি ভাবতে পেরেছি!
শুনে হাসতাম। তিনি আমাকে উপাধি দিয়েছিলেন ঠাণ্ডা মাথার খুনি। দেখে নাকি মনে হয়, ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানি না, অথচ তলে তলে অনেকদূর, গলি পেরিয়ে রক্তের সমুদ্দুর!
সুমন ভাই বলতেন, ‘দীর্ঘদিনের চেনাজানা মানুষও তোমাকে ভোদাইমার্কা ভেবে ভুল করতে পারে। কিন্তু আমি জানি, তুমি ভেতরে ভেতরে কী কঠিন জিনিস! দেখা গেলো, তুমি হাঁটছো হাঁটছো... হাঁটতে হাঁটতে চোখের সামনে একজন মানুষ পড়লো, যাকে পছন্দ করো না। অমনিই পকেট থেকে ছুরি বের দিলে তার পেটে ঢুকিয়ে। সে যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো, তর্জনীতে একটু রক্ত নিয়ে মুখে দিলে, অনেকটা লবণ চাখার মতো। রক্তের স্বাদ কিছুটা মিষ্টি দেখে ভাবলে লোকটার আরো কিছুদিন বেঁচে থাকা দরকার ছিলো। মানুষ হিসেবে খারাপ না। আবার এমনও হতে পারে, কারো রক্তের স্বাদ এত বাজে, এত বেশি ঝাঁজ— মনে হবে, ঠিকই আছে। এ লোক বেঁচে থাকলে অনিষ্ট করে বেড়াতো!’
শুনে বলতাম, ‘আরে ধুর!’
‘এটাই সত্য। প্রতিদিন একটি গোলাপ আদলে এটাকে বলা যাবে প্রতিদিন একটি খুন!’
‘শুধু একটি, আর বেশি নয় কেন!’
‘বেশি হলেও হতে পারে। কিন্তু একটি থাকবেই থাকবে। সারাদেশে অন্তত একটি খুন সংঘটিত হবেই! খুনখারাবি তো এখন ডালভাত হয়ে গেছে।’
ভেতরে ভেতরে অনেকটা দুর্বল আমি। কোনো বিড়ালের বাচ্চাকেও জীবনে আছাড় মারিনি। এমনকি মুরগি জবাই দেখতেও ভয় লাগে। জবাই শেষে যখন ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে, পারতপক্ষে সামনে থাকতে চাই না। দেখলে কষ্ট লাগে। সেই আমি কি না মানুষ খুন করবো!
একটা মিথ্যা তিনবার বললে নাকি তা সত্যে পরিণত হয়। এটা গোয়েবলস সাহেবের সূত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি সূত্রটি আবিষ্কার ও প্রয়োগ করেন।
তাহলে কি সেই অশুভ সূত্রটাই প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সুমন ভাই এসব কথা বলার মাধ্যমে আমার সাহসের ভিতটাকে শক্ত করে দিয়েছেন! পাশাপাশি সময় এবং পরিস্থিতিও মানুষকে সাহসী করে তোলে।
নিজের বোনকে বখাটেরা ডিসটার্ব করলে পৃথিবীর কোন ভাইটা স্থির থাকতে পারে?
এখানে পৃথিবী শব্দটার ব্যবহার বোধহয় ঠিক হলো না। বাংলাদেশ ছাড়া, এত উৎকট সমস্যা বহির্বিশ্বে ঘটে বলে জানা নেই। স্বদেশেরই একটা মেয়ে, তাও মহল্লার— বখাটেরা তাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না।
প্রেম উথলে উঠলে উল্টাপাল্টা প্রস্তাব দেবে, টিজ করবে। এ ধরনের কোনো ছেলে সচরাচর মেয়েদের ভালোবাসা পায় না। টিজ করে সাড়া না পেলে বখাটেরা আরো বেপরোয়া হয়ে যায়। উৎপাত মাত্রা ছাড়ায়।
নিষ্পাপ মেয়েদের বেঁচে থাকাটাকে কঠিন করে তোলে এরা।
আমার বোনের ক্ষেত্রেও হলো। চলতি পথে বখাটেরা কত রকমের মন্তব্য যে ছোড়ে—
আয় যাইগা
সেক্সি গার্ল
জব্বর মাল
মাগীর ভাব দেখো
দিবি নাকি
চল আন্ধার ঘরে যাই...
স্কুলপড়ুয়া মেয়ের জন্য প্রেমিকপুরুষরা প্রেমিকসত্তা প্রতিষ্ঠা করতে উঠে-পড়ে লাগে।
মুমু আমার ছোট বোন। সব ভাই-ই তার ছোট বোনকে তুলনামূলক বেশি ভালোবাসে। আমিও বাসি।
কতটুকু? ভালোবাসা পরিমাপ করার যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি বলে পরিমাণ বোঝানো যাবে না। তবে অনেক, অ-নে-ক...। আদিখ্যেতা করে বলতে পারি, আমিই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। সব বিষয়ে মাপামাপি না করলেও চলে। ভাইবোনের নির্মল ভালোবাসার কাছে হিমালয়ও মাথা নোয়ায়। শুধু অমানুষরা দাঁড়িয়ে থাকে দুর্বিনীত ভঙ্গিতে।
মুমু যখন সেভেনে, তখনই পেয়েছে প্রথম প্রেমপত্র। মহল্লারই এক ছেলে দিয়ে বলেছে উত্তর চায়। মুমু সেই চিঠি ধরিয়ে দেয় আমার হাতে।
সেই গতানুগতিক কথা। ভালোবাসার বান-তুফান।
মুমুকে না পেলে নিজের জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে, অতএব তার জীবন সফল করার আকুতি। আরো কত রকম আবদার-আহ্লাদ!
সেই চিঠি ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। দুই বছর আরো চিঠি পাওয়া, নানা রকম অবাঞ্ছিত কথা শোনার মধ্য দিয়ে গেছে। মুমুও কিছুটা বুঝদার হয়েছে। সে বুঝেছে এরকম চিঠি পেলে আর ভাইয়াকে দেখানো চলবে না। নিজ উদ্যোগেই ধামাচাপা দিতে হবে।
আরো অনেক সমস্যাই সে সামলে নিয়েছে। কিন্তু সমস্যা যখন বাড়াবাড়ি রকম, লুকোচাপার সুযোগ থাকে না। মুমুর সর্বশেষ সমস্যাটা ধরা পড়লো আমার সামনে, অনেকের সামনে।
ক্লাস নাইনের একজন শিক্ষার্থীর কত পড়াশোনা। কত টেনশন। পরীক্ষা, ভবিষ্যৎ, উচ্চশিক্ষা, ক্যারিয়ার—আরো কত কী। ভবিষ্যতের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে এ সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এ সময়টাতেই বাধা হয়ে দাঁড়ালো বদ বদরুল। মুমুর প্রেমিক হিসেবে সে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। বদরুল বখাটে— বলার অপেক্ষা রাখে না। বদরুল অবিবেচক— বুঝতে বেশি জ্ঞানী হতে হয় না। বদরুল গণ্ডমূর্খ— শিক্ষিত-রুচিবান ছেলেরা এ সব করে বেড়ায় না।
বদরুলকে নিয়ে ভাবার বা তার পেছনে একটা মিনিট ব্যয় করার সময় মুমুর কই!
কিন্তু বদরুলের প্রেম, প্রেমের প্রকাশ বন্যার পানির মতো বাড়তে থাকে।
বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছায় মুমু আমাকে না জানিয়ে পারে না।
এতদিন শুধু মুখে বাজে কথা শুনিয়েই ‘তৃপ্ত’ ছিলো কিন্তু এবার ওড়না ধরে টান দিয়েছে। হুমকিও দিয়েছে, সাড়া না দিয়ে মুমু মহল্লায় কীভাবে থাকে দেখে নেবে।
মুমুর ভয়— আগামীতে ওড়নার বদলে যদি ওকে নিয়েই টান দেয় জানোয়ারটা।
ওরা সব পারে পারে।
এসিড ছুড়তে পারে।
ধর্ষণ করতে পারে।
দলবল নিয়ে কুৎসা রটাতে পারে।
এমনকি কারো জীবনপ্রদীপও নিভিয়ে দিতেও পিছপা হয় না।
বোনের এ বিপদে আমাকে উদ্যোগী হতে হয়।
মুমুকে আশ্বস্ত করি, সব ঠিক হয়ে যাবে। ওইসব বদরুল-ফদরুলকে একটা ক্ষতিকর মশার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভাবার কোনো কারণ নেই।
প্রথমে আমি গিয়ে বদরুলকে বোঝাই, সে মেনে নেয়।
সব কথায় হ্যাঁ হুঁ করে যায়।
ওকে বলি, ওর বোনের পথচলায় কেউ এমন করলে নিশ্চয়ই ওর ভালো লাগবে না।
বদরুল সহমত পোষণ করে। প্রতিশ্রুতি দেয়, মুমুকে আর জ্বালাতন করবে না।
দুইদিন বন্ধ থাকে। তারপর আবার স্বরূপে আবির্ভূত হয় সে।
আবার বোঝাই।
এবার এক সপ্তাহ’র জন্য কার্যক্রম বন্ধ রাখে। কিছুদিন পর আবার কুকুরের লেজ বাঁকা অবস্থানে ফিরে আসে!
তৃতীয়বারের মতো যখন বোঝাতে যাই, সে রুখে দাঁড়ায়।
প্রেমিক হিসেবে কী করবে না করবে এটা তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার।
বুঝতে পারলাম, প্রেমের বড় বেশি বাড় বেড়েছে। এ বাড়ন্ত পাখনা কাটতে হবে। এবং আমাকেই।
থানা পুলিশকে বলে লাভ হবে না। এরা যেমন দুই নম্বর লোক, ওরাও দুই নম্বর। সমগোত্রের, চরিত্রে উনিশ-বিশ নেই। বরং ক্ষেত্রবিশেষে পুলিশ আরো বেশি বদমাশ।
মুশফিক রহমান কী পারে, দেখিয়ে দেওয়ার সময় হয়েছে।
নাহ, ভুল বললাম। কাউকে দেখিয়ে দেওয়ার নয়, বরং নিজেই দেখে নেওয়ার। আত্মমূল্যায়ন। সুমন ভাইয়ের ধারণার একটা পরীক্ষা হওয়া জরুরি।
দোকান থেকে একটা ছুরি কিনি। চকচকে ঝকঝকে। সন্ধ্যা হলেই ছুরিটা প্যান্টের পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াই। এটাকে কাজে লাগাতে হবে। সন্ধ্যার পর রাস্তায় থাকি। পরপর কয়েকদিন। বদরুলকে পাই না। কালে-ভদ্রে পেয়ে গেলেও সে থাকে সবান্ধবে।
ওর মতোই কুরুচিশীল সব ছেলেপেলে। যারা চিৎকার করে কথা বলে আর কারণে-অকারণে খে খে করে হাসে।
দেখে গা জ্বালা করে।
কিন্তু কিচ্ছুটি করার নেই। এ অবস্থায় কিছু করার থাকে না। মনকে সান্ত্বনা দিই— সামনে তো আমারই দিন!
আমি লেগে থাকি আঠার মতো। লেগে থাকা অবশেষে ফলপ্রসূ হয়।
এক রাতে, দশটার মতো বাজে বোধহয়, যথারীতি মহল্লায় চক্কর দিচ্ছি। এখন আমার কাজই এটা। বারোটার আগে বাসায় ফিরি না।
এসময় উদয় হয় বদরুল। সরু গলিপথে বদরুল হেঁটে আসছে!
সামনাসামনি হতেই বদটাকে বলি, ‘কেমন আছো বদরুল?’
সে চোখ-মুখ শক্ত করে বলে, ‘জি ভালো।’
‘তোমার জন্য একটা সুখবর আছে। মুমু তোমার ভালোবাসাকে মেনে নিয়েছে!’
‘সত্যি বলছেন ভাইয়া?’ বদরুলের গলায় যুগপৎ উত্তেজনা ও আনন্দ।
‘হ্যাঁ, বিশ্বাস না হলে আমার সাথে বাসায় চলো।’
বিনা বাক্যব্যয়ে, খুশিমনে বদরুল আমার পিছু নেয়।
হাঁটতে হাঁটতে ‘নিরাপদ’ নির্জন এক গলিতে চলে আসি।
এ গলিতে মানুষ তেমন একটা চলাচল করে না।
সিটি কর্পোরেশনের একটা ডাস্টবিন এখানে— দুর্গন্ধময়, কেউ এদিকটায় আসে না।
বিকল্প পথ যখন আছে, মানুষ এদিকে আসবেই বা কেন।
শুধু কিছু টোকাই ডাস্টবিন থেকে উচ্ছিষ্ট খাবার, পলিথিন, বোতল ইত্যাদি খোঁজে। তাও দিনের বেলায়।
হাঁটতে হাঁটতে সেই ডাস্টবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়াই।
বদরুল বলে, ‘এখানে এলেন কেন? আপনাদের বাসা তো অন্য পথে!’
‘এখান দিয়েও যাওয়া যায়। কেন তোমার তর সইছে না?’
বদরুল হাসে। রোমান্টিক, প্রেমজয়ের হাসি। আধো অন্ধকারে ঝিকিয়ে ওঠে দাঁত।
আরো অনেক আগড়মবাগড়ম কথা বলতে বলতে আমি বদরুলের কাঁধে হাত রাখি।
গা-টা কেমন রিরি করে ওঠে।
তারপর সন্তর্পণে হাত দিই পকেটে।
আছে। জিনিসটার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়।
ছুরিটা বের করে সজোরে, আমূল ঢুকিয়ে দিই বদরুলের পেটে।
হতভম্ব সে কিছু বুঝতে পারে না। আর্তনাদ করতেও ভুলে গেছে যেন।
কিন্তু তারপরই শুরু করে বিকট চিৎকার। ধস্তাধস্তি। প্রতিরোধের চেষ্টা।
সে ওষুধও আমার আছে। কোমরে বেঁধে রাখা গামছা বের করে ওর মুখ বেঁধে দিই। নাকের ফুটোসহ। যেন কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়। আবার শুরু করি ছুরির ব্যবহার।
শালার কৈ মাছের প্রাণ; জবাই করা মুরগির মতো শুধু তড়পায়। রাস্তার ধূলি-বালি গায়ে মাখায়। ফিনকি দেওয়া কিছু রক্ত আমার গায়ে এসে লাগে। এতে আমার অস্বস্তি লাগে না, কেমন যেন পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করি।
আত্মতৃপ্তি নিয়ে তাকিয়ে দেখি হারামিটার কর্মকাণ্ড। প্রেমসম্রাটের পতন হয়ে গেছে। আচমকা মনে পড়ে সুমন ভাইয়ের রক্ত-থিওরি। কথাটা সত্য-মিথ্যা যা হোক, একটু পরীক্ষা করেই দেখি।
তর্জনীতে রক্ত নিয়ে জিহ্বায় ছোঁয়াই।
যেভাবে পানখোররা পানের বোঁটা থেকে জিহ্বায় চুন লাগায়।
এক্কেবারে বিস্বাদ। গা গুলিয়ে ওঠে। শুনেছি রক্তের স্বাদ নোনতা। কিন্তু এটাতে নুনের কোনো টেস্টই পাচ্ছি না।
শালা নিশ্চয়ই খুব খারাপ মানুষ ছিলো, যার কাছে রক্তও দূষিত।
এখানটায় বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ না। লাথি দিতে দিতে জানোয়ারটাকে ডাস্টবিনের কিনারায় নিয়ে আসি।
প্রশান্ত মনে বাসায় ফিরি। একটা ফুর্তির আমেজ দেহজুড়ে।
আমার ভেতরে কোনো অনুশোচনা জাগে না, এত বড় একটা অপরাধ করে ফেলার পরও। বরং মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে, শালা কুত্তার বাচ্চা! এবার জাহান্নামে বসে প্রেম করগে!
পরদিন, স্কুলে যাওয়ার আগে মুমু আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখে-মুখে ভীতির ভাব।
‘কিরে, কিছু বলবি?’
‘ভাইয়া... ভাইয়া...।’
‘আরে বল না, কী হয়েছে।’
‘শুনেছিস, বদরুল খুন হয়েছে। নিতু ওদিক থেকে আসার সময় লাশ দেখে এসেছে।’
‘বদরুল? কোন বদরুল... ও চিনেছি! কীভাবে মারা গেলো রে?’
‘আমারও তো একই প্রশ্ন।’
‘ভালোই তো হয়েছে। বোধহয় র্যাব ক্রসফায়ারে দিয়েছে।’
‘ভাইয়া!’ মুমু অবিশ্বাসভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারি ওর হিসাব মিলছে না। অন্য কারো অনুশোচনা নিজের ঘাড়েই নিতে চাচ্ছে।
‘তোর স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে না?’
‘আমার কেমন যেন ভয় লাগছে।’
‘ধুর পাগলি। ভয়ের কিছু নেই। তোর জন্য ভালোই হয়েছে। এখন আর কেউ ডিসটার্ব করবে না।’
তবু ওর সংশয় যায় না। দ্বিধায় ভুগতে থাকে। ইউনিফর্মের প্রান্ত খোঁটে, আঙুল দিয়ে।
শেষে ওর কপালে চুমু খেয়ে, পিঠ চাপড়ে আশ্বস্ত করে বলি, ‘এবার স্কুলে যা। নিতু বসে আছে অনেকক্ষণ। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। চল, আজ আমি তোদের স্কুলে পৌঁছে দিই।’
তারপর থানা থেকে পুলিশ আসে। অপমৃত্যুর মামলা দায়ের হয়।
পরদিন পত্রিকায় এক কলামে পাঁচ ছয় লাইনের খবর ছাপা হয়— যুবকের রহস্যময় মৃত্যু।
এ দেশের সরকার, পুলিশ কোনোকিছু পত্রিকায় আলোচিত হওয়ার আগে বুঝতে পারে না। এবারও তাই ঘটলো। পুলিশ বিপক্ষ গ্রুপের পাঁচ-ছয়টি ছেলেকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যায়। সন্দেহজনকভাবে।
বিপক্ষ রাজনৈতিক দলের ছেলেরা পারস্পরিক প্রতিহিংসাবশত এমন কাজ করতেই পারে।
কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা একেই বলে। মনে মনে আমি হাসি। যেহেতু উচ্চৈস্বরে হাসার সুযোগ নেই।
ঐ শালা একাই মরেনি, আরো অনেককে মেরে গেছে।
যাক, ভালোই হয়েছে। সমাজের কিছু জঞ্জাল পরিষ্কার হোক। অল্প সময়ের জন্য হলেও। কিছুদিন পরে এরা ঠিকই ছাড়া পাবে। আবার শুরু করবে অনৈতিক কর্মকাণ্ড। মাথার উপর ছায়া হয়ে থাকবে রাজনৈতিক বড় ভাই!
সফল এ খুন আমাকে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস। বাতলে দিয়েছে এগিয়ে যাওয়ার দিশা। মাথায় একটা বাক্য কাজ করে— প্রতিদিন একটি খুন! প্রতিদিন একটি খুন! প্রতিদিন একটি খুন! বাক্যটা প্রতিধ্বনিত হয় বারবার। সুমন ভাই কোন পোকাই না ঢুকিয়ে দিলেন মাথায়, অনুরণিত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে, বাড়ছে ভ্রমরের গুঞ্জন!
মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর সমস্যার শেষ নেই। আমাদেরও। বাবার একার রোজগারে সাত-সাতজন মানুষের সংসার। বাবা হিমশিম খান, তবু কাউকে বুঝতে দেন না কষ্টটুকু। আমিও কিছু করতে পারি না। পাশ করে বসে আছি জড়ভরত। ইন্টারভিউ দিই, চাকরি হয় না। চাকরি হয় না, তবু ইন্টারভিউ দিয়েই যাই। ব্যাংক ড্রাফট, পে অর্ডার, সিভি... আরো কত কী জমা দিই! এদিকে চাকরির বয়সও চলে যাচ্ছে।
সব চাকরিজীবীরই কিছু না কিছু সঞ্চয় থাকে। নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যৎ চিন্তায়। বাবারও ছিলো। তাঁর বন্ধুস্থানীয় এক লোক মোটামুটি কেঁদে-কেটে এক লাখ টাকা ধার নেন। বলেছেন এক মাস পরেই ফেরত দেবেন। একমাস দূর থাক, চলে গেছে পাঁচ বছর। পাঁচ গুণন বারো সমান ষাট মাস। মাস ফুরিয়েছে একে একে, টাকা আসেনি। দেরিতে হলেও বাবা বুঝতে পেরেছেন, টাকাটা ইহজীবনে ফেরত পাবেন না। কোনো কোনো বিপদগ্রস্তকে সহযোগিতার খেসারত এভাবেই দিতে হবে।
বদরুলের অগস্ত্যযাত্রার এক সপ্তাহ পরই আমার হাত চুলকাতে লাগলো।
রক্তে লাগলো নতুন আলোড়ন। অভূতপূর্ব নাচন। শিরায় শিরায়। রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কোষে কোষে।
কোত্থেকে যেন অমোঘ আহ্বান আসে। নামো, কাজে নামো। প্রতিদিন একটি খুন। একটি খুন প্রতিদিন। খুন প্রতিদিন একটি। খুন খুন খুন। প্রতিদিন একটি খুন...।
কাজে নেমেই যাই। এবার শিকার হিসেবে বেছে নিই আজমত চাচাকে। বাবার বিশ্বাসের ঘরে যে আগুন দিয়েছে। লোকের সরলতার সুযোগ নিয়ে যে উগরে দিয়েছে গরল। বাবা কতবার যে তার কাছে টাকা চাইতে গিয়েছেন। লাজলজ্জাহীন হয়ে। নিতান্ত অসহায় হলে যা হয়। না গিয়েই বা কী করবেন, অবস্থা খারাপ না হলে প্রচণ্ড আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ বাবা এক কথা দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করতেন না।
আজমত চাচার প্রতিবার একই প্রতিশ্রুতি, সামনের মাসেই দিয়ে দেবো। বাবা একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
সংসারমায়া বড় মায়া। এ বাঁধন শক্ত বাঁধন। এতগুলো মানুষের জীবনযাত্রার মূল নিয়ন্ত্রক তিনিই। তাকে ছাড়া অসহায় এ মানুষগুলো।
আজমত চাচাও বদরুলের চেয়ে কোনো অংশে কম নন। যদিও ভিন্ন চরিত্রের। ভদ্রবেশী টাউট।
সময় এসেছে আরেকটা আবর্জনা ভাগাড়ে ফেলার। কীভাবে অপারেশন সম্পন্ন করা যায়, কয়েকদিন আজমত চাচার বাসার চারপাশে গিয়ে রেকি করি।
করতে করতে একসময় পরিকল্পনার ছকও বানাই। কীভাবে কী করবো। নীলনকশা প্রস্তুত হওয়ার পরই তাকে ধরি। সপ্তাহে দুই তিনবার আজমত চাচার এলাকায় যাই। অবশ্য তার বা তার পরিবারের সবার চোখ বাঁচিয়ে। আজ আর চোখ বাঁচানোর দরকার নেই। মহল্লায় গিয়ে দাঁড়াই। রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ দূর থেকে দেখি, চাচা আসছেন।
এগিয়ে যাই তার দিকে। সালাম দিয়ে বলি, ‘বাবা খুব অসুস্থ। আপনাকে একটু যেতে বলেছেন।’
চাচার মুখে বিরক্তির ভাব— ‘আমি গিয়ে কী করবো। ডাক্তার ডাকো।’
‘পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবে না চাচা। অবস্থা খুব সিরিয়াস!’
‘টাকা চাওয়ার জন্য নতুন নাটক করছে না তো!’
‘ছি চাচা, মৃত্যুপথযাত্রী একজন মানুষকে নিয়ে এভাবে বলতে নেই।’
‘তো চলো। দাফনটা করেই আসি!’
শালা শুয়োরের বাচ্চা বলে কী। বেহায়ার বেহায়া।
কিছুদূর হাঁটার পর বলি, ‘চাচা, কিছু মনে করবেন না। আমি একটু প্রস্রাব করবো।’
দূরের সরু গলিটা দেখিয়ে বলি, ‘ওখানটায় যাবো। একা যেতে ভয় করছে। আপনিও চলুন না।’
নিমরাজি চাচা আমার পিছু নেন।
ভালোই হয়েছে। জায়গাটা অন্ধকার। কেউ কিচ্ছুটি টের পাবে না। হাঁটতে হাঁটতে একসময় দাঁড়িয়ে পড়ি। পেছন থেকে চাচা বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘কী হলো থামলে কেন?’
‘আরেকটা কাজ আছে যে!’
ছুরিটা বের করে হাতে নিই। অন্ধকারে চকচক করে ওঠে ছুরি। চাচা কিছু একটা অনুমান করতে পারেন যেন। দৌড় দিতে চেষ্টা করেন। তার আগেই খপ করে ধরে ফেলি। ছুরিটা আমূল ঢুকিয়ে দিই পেটের ভেতর। তারপর একটা রামমোচড়।
ওই এক মোচড়েই কর্মসারা। চিৎকার করার সুযোগ দিই না। স্কচ টেপ পেঁচিয়ে দিই মুখে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চাচা নিথর হয়ে পড়েন।
রক্তের টেস্ট কেমন জানতে একটু রক্ত নিই। জিহ্বায় ছোঁয়াই। সুমিষ্টই মনে হলো। তার মানে মানুষ হিসেবে খুব একটা খারাপ ছিলেন না।
সামষ্টিকতার কথা থাক, কতটুকু ভালো নিজ চোখেই দেখেছি।
সুমন ভাইয়ের থিয়োরি অনুযায়ী লোকটার আরো কিছুদিন বেঁচে থাকার দরকার ছিলো!
শান্তি পেলাম। পরম শান্তি।
মানুষ খুন করায় এত সুখ! সিরিয়াল কিলারদের প্রতি ঈর্ষা হলো। ইশ! কত সুখী তারা। আমরা বুঝতে না পেরে উল্টো গালি দিই! এরপর থেকে, বদলে যেতে থাকে আমার জীবনধারা। মহল্লায়, মহল্লার বাইরে, পরিচিতজন, আত্মীয়দের মধ্যে যাকেই জঞ্জাল মনে হয়েছে, দেশের মানুষের জন্য, দেশের জন্য অহিতকর মনে হয়েছে— খেইল খতম গ্রুপের কাতারে নিয়ে গেছি।
আশপাশের মানুষরা বুঝতে পারে না, কী থেকে কী হয়ে যায়। শুধু একটু চমক অনুভব করে। পত্রিকার ছোকরা সাংবাদিকরা রিপোর্ট লেখে— নিজস্ব প্রতিবেদক : গতকাল সোমবার আরেকটি খুনের ঘটনা ঘটনা ঘটেছে। রহস্যময় এ হত্যাকাণ্ডগুলোর কূল-কিনারা করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গতকাল এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, অপরাধী যত শক্তিশালীই হোক, আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অ্যারেস্ট করা হবে...।
শুধু মুমু... যখনই কোনো ঘটনা ঘটে, সে আমার দিকে অবিশ্বাসভরা চোখে তাকায়। বড় বড় চোখে কত কী বলতে চায়। বোঝাতেও!
কিন্তু তাকানোই সার, মুখ ফুটে কিছু বলে না। অবশ্য অনেকদিন পর হলেও সে একসময় মুখে খোলে। তদ্দিনে মুমু কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পৌঁছে গেছে। বুঝতে শিখেছে অনেক কিছু।
পাশের ফ্ল্যাটের অবিবাহিতা মেয়েটা প্রেগনেন্ট হয়ে যায়। চাইলেও তারা ব্যাপারটাকে শেষ পর্যন্ত গোপন রাখতে পারেনি। প্রায় প্রতিদিনই ঝগড়া হয় বাসায়। মেয়ে-বাবা-মা-অন্য ভাইবোনরা ঝগড়াকে উচ্চমাত্রায় নিয়ে যায়। উত্তেজিত হয়ে গেলে কারোরই কোনো কথা বাধে না। বাইরের মানুষের কথাও মাথায় থাকে না তাদের। এভাবেই বিষয়টা জেনে যাই। এক ছেলের সাথে প্রেম ছিলো আইরিনের। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সে আইরিনের সর্বনাশ করে। পরে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায়। এও বলে, পেটের সন্তানটা তার না, অন্য কোনো নাগরের। আইরিন অ্যাবরশনও করাবে না, সমাজ থেকে পালাবে না, গলায়ও দড়ি দেবে না। পণ করেছে—সন্তানের অধিকার, নিজের স্ত্রী হওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে ছাড়বে। বিপদে পড়ে তার পরিবার। অনাকাঙ্ক্ষিত এ শিশুকে কীভাবে তারা বরণ করবে! এলাকাবাসী অবিবাহিতা একটি মেয়ের মা হওয়াটাকে কেন মানবে...।
এরকম অবস্থায় আমাকেই দায়িত্ব নিতে হয়। একটা বেজন্মাকে জন্মের শিক্ষা দিয়ে খরচ করে ফেলি। এ ঘটনায় আইরিনের কষ্ট পাওয়াই ছিলো স্বাভাবিক, কিন্তু না— খবর পাওয়া মাত্র সে প্রতিবেশীদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করে। ও নিজেই মিষ্টি দিতে এলে ওর কাছ থেকে চেয়ে দুইটা মিষ্টি বেশি নিই। আরাম করে, তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া যাবে। সময় নিয়ে খাবো আর মনের পর্দায় দেখতে থাকবো খুন করার দৃশ্যাবলি। যেই না মিষ্টিতে কামড় বসাতে যাবো, কোত্থেকে যেন মুমু ছুটে আসে— ‘খবরদার ভাইয়া, এ মিষ্টি তুই খাবি না।’
‘কেন, কী হয়েছে?’
‘তোর লজ্জা করে না, একজন মানুষ খুন হলো আর এ আনন্দে মিষ্টি খাচ্ছিস!’
‘লজ্জা করবে কেন, আনন্দ লাগে। খবরে দেখিস না, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা র্যাবের হাতে ক্রসফায়ারে মারা গেলে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন মিষ্টি বিতরণ করে!’
‘ওসব রাজনীতির ব্যাপার, আমি বুঝি না; আমার ভালোও লাগে না। মানুষ খারাপ হতে পারে, তাই বলে তার মৃত্যুতে আনন্দ করা অমানবিক। অস্বাভাবিক।’
‘বাহ, তুই তো দেখছি মানবাধিকার রক্ষার ধ্বজাধারী হয়ে গেছিস! এদিকে আয়, মিষ্টি খা। ভালো জিনিস।’
মুমু অসম্মতি জানালে আমি খাইয়ে দিতে যাবো, আচমকা মিষ্টির প্লেট ছুঁড়ে মারে মুমু। ঘরের কোণে পড়ে প্লেটটা ঝনঝন শব্দ করে। মিষ্টিগুলো এলোমেলো হয়ে ফেটে যায়। কাচের টুকরো ছিটকে পড়ে চতুর্দিকে।
‘এত বর্বরতা তোকে মানায় না, ভাইয়া। তোকে নিয়ে আমি অনেক অহংকার করতাম। আর তুই...!’ বাক্য শেষ করতে পারে না মুমু, ডুকরে কেঁদে ওঠে। ওড়না দিয়ে চাপা দেয় মুখ, চোখ।
‘তোর কষ্ট পাওয়ার মতো আমি কী করলাম! চোখ মোছ।’
‘বাংলাদেশে শত শত মেয়ে অবৈধভাবে প্রেগনেন্ট হচ্ছে, আগামীতেও হবে। কয়টা সমস্যার সমাধান করবি তুই?’
মুমু কি আমাকে সন্দেহ করছে? কীভাবে বুঝতে পারলো। আমি তো প্রমাণ রাখি না কখনো। এরপর কোনো বাতচিতে না গিয়ে বাসার বাইরে চলে আসি। আইরিনের রুম থেকে হাই ভলিউমে ধুমধারাক্কা হিন্দি গানের মূর্ছনা ভেসে আসছে। আজ ওর বড় আনন্দের দিন!
মুমুকে শান্ত করতেই হোক, কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দৌড়ঝাঁপ কমাতে— কিছুদিন নিষ্ক্রিয় থাকি। যদিও প্রতিদিন টেলিভিশনে খবর দেখলে, পত্রিকা পড়লে হাত নিশপিশ করতে থাকে। মন চায় সব হারামিকে নরকের ঠিকানায় পার্সেল করে দিই। কিন্তু পারি না, অক্ষম আক্রোশে ছটফট করি কেবল! নিজেকে প্রবোধ দিই— এখন না পারি, একসময় না একসময় ঠিকই পারবো।
বাংলাদেশের সীমানাঘেঁষা একটি জেলায় আমার বাল্যবন্ধু মিলনের বাড়ি। ওখানকার একটা কলেজের প্রভাষক সে। একসাথে পড়াশোনার করার পর সঙ্গত কারণেই আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। তবে মোবাইলফোনে প্রচুর কথা হয়। একদিন কথায় কথায় মিলন জানায়, তাদের এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে। দুইজন প্রার্থীর একজন মুক্তিযোদ্ধা, অপরজন রাজাকার। একাত্তরে আলবদর বাহিনীর সংগঠক ছিলো। এ বিষবৃক্ষ এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। রাজাকার প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থীর নামে, জনসভায় এখানে-ওখানে যা-তা বলে বেড়ায়। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটাক্ষ করে। অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যাচ্ছে, তার পাশ ঠেকানো যাবে না। রাজাকার যদি একবার ক্ষমতা পায়— কী হতে পারে ভেবে শঙ্কিত হয় মিলন, এলাকার আরো অনেকেই। এটা হবে রক্তার্জিত লাল-সবুজ পতাকার অবমাননা।
সব শুনে কেমন যেন আগ্রহ জমে আমার। রাজাকারটার বাড় স্বচক্ষে দেখতে মন চায়। মিলনকে বলি, ‘তোদের এলাকায় দাওয়াত দে। মহান রাজাকারকে একবার দেখি!’
মিলন খুশি হয়— ‘আজই চলে আয়। দাওয়াত লাগবে না।’
বলা দেরি, যেতে দেরি করি না। মিলনদের গ্রামে পৌঁছাই পরদিনই। সেই রাজাকারকে দেখেও ফেলি নির্বাচনী পোস্টারে! দুইদিন পরে তার জনসংযোগে, জনসভায় সরাসরি দেখি। রাজাকারের মুখের অমৃতবাণী শুনি। নতুন করে ধর্মতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব জানি। বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধ ‘ভাইয়ে ভাইয়ে গণ্ডগোল’ বাক্যটা শোনার পর আর দেরি করা চলে না। যদিও সিদ্ধান্তটা আগেই নেওয়া, ফাইনাল করাটাই বাকি।
রাজাকারের নাগাল পেতে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। সবসময় চামচা পরিবেষ্টিত থাকে, একা পাওয়া কঠিন। রাজাকারের সাথে এ প্রজন্মের কয়েকটি ছেলে ছায়ার মতো লেগে থাকে। আহারে হতভাগা প্রজন্ম, কোন বাবা তোদের জন্ম দেয়!
কৃষ্ণকালো এক রাতে চামচাদের বিদায় দিয়ে ধানখেতের আইল ধরে বাড়ি যাচ্ছে মোতালেব রাজাকার। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছালে পিছন থেকে ডাক দিই— ‘চেয়ারম্যান সাহেব, শোনেন!’
অন্ধকারে আমাকে চিনতে পারে না সে। অবশ্য আলোতেও চিনতো না। ফিরে তাকিয়ে বলে, ‘কে তুমি?’
‘বাংলাদেশের নগণ্য এক নাগরিক। আপনার ভোটার।’
‘এত রাতে এখানে কী করো?’
‘আপনার অপেক্ষায় ছিলাম!’
রাজাকার বুঝে যায়, পরিস্থিতি সুবিধার না। সে ধমক দিতে চেষ্টা করে। তার আগেই বের করি ছুরিটা। কায়দা করে ছুরিটা ঢুকিয়ে দিইÑথলথলে ভুড়ি, একবার দিলে কাজ হবে বলে মনে হয় না। উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করতে থাকি। মুখে গামছা বেঁধে দিয়েছি। গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে কেবল। গোঁ গোঁ নিস্তেজ হয়ে এলে একসময় শব্দ রাস্তা থেকে গড়িয়ে পড়ে ধানখেতে। রাজাকারের জারিজুরি, বাহাদুরি শেষ।
যথারীতি রক্ত তুলে নিই মুখে, ওয়াক থু! এত বিশ্রী স্বাদ... এত ঝাঁজ; কে যেন অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছে আমার মুখে! কী আছে রাজাকারের রক্তে? এ কী, হাত-পা কাঁপছে কেন, টলছি কেন এমন? টলতে টলতে আমিও কাত হয়ে পড়ি রাস্তার উপর। দুই তিনটা গোত্তা খাওয়ার পর আমার অর্ধেক শরীর চলে যায় পাকতে শুরু করা ধানখেতের ভেতরে, বাকি অর্ধেক আইলে। নাড়িভুড়ি একত্র করে, দলা পাকিয়ে উঠে আসতে চায় বমি— ওয়াক ওয়াক!
বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়তে থাকে শরীরের কোষে কোষে। কী আছে রাজাকারের রক্তে, পাকিস্তানি জানোয়ারের রক্ত কী দিয়ে তৈরি? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগেই উপলব্ধি করলাম— আমি মারা যাচ্ছি! বিষক্রিয়া ষোলোকলা পূর্ণ করছে!
শেষবারের মতো চোখ বন্ধ করার আগে চোখের সামনে স্থির হয়ে থাকে লাল-সবুজরঙা এক টুকরো কাপড়। ধীরে ধীরে লাল-সবুজরঙা কাপড়টা রূপ নেয় আমার মায়ের নামাজের কাপড়ে। শুভ্র সে কাপড় পলকে বিছিয়ে যায় দিগন্তজুড়ে। উড়তে থাকে পতপত করে।