পোস্টস

গল্প

ভাড়ায় চালিত

১১ জুলাই ২০২৪

Shifat Binte Wahid

মূল লেখক সিফাত বিনতে ওয়াহিদ

"চুপি চুপি চলে না গিয়ে, সে কেন বিদায় নিলো না হেসে..." মাইক্রোল্যাবের ছোট্ট ব্লুটুথ স্পিকারে বেগম আখতারের সুরেলা কণ্ঠ ১২৫০ স্কয়ারের এই পুরো ফ্ল্যাটটাকে একটা বিচ্ছেদী আবেগে ছেয়ে রেখেছে। মধ্যরাত। শহরের কোলাহল কমে এসেছে। দূর থেকে ভেসে আসছে রাতজাগা কুকুরদের দু একটা ভাসা ভাসা ডাক। ঘরের সবগুলো দরজা-জানালাই খোলা। দখিনা বাতাসে দোল খাচ্ছে টবে থাকা গাছের পাতাগুলো, কিছুক্ষণ পর পর ফ্লোরে পড়ে থাকা কাগজগুলো শব্দ করে ঘরের এপাশ থেকে ওপাশে উড়ে উড়ে, সরে সরে যাচ্ছে। যদিও আমি ঘরের বাতি বন্ধ রাখতেই ভালোবাসি, রাত হোক কিংবা দিন। এখন জ্বলছে। এই মুহূর্তে আমার ফাঁকা ফ্ল্যাটটায় আরেকজন মানুষের অস্তিত্ব থাকায় বাতি বন্ধ করা যাচ্ছে না।

 

চোখ বন্ধ করে বেগম আখতারের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাচ্ছিলাম বহু সময় ধরে, "আমি তো রাখিনি তারে বেঁধে...শুধু ভুল করেছি ভালোবেসে, শুধু ভুল করেছি ভালো বেসে...চুপি চুপি...। "আপনাকে ম্যাসাজ করে দেবো?"- ছেলেটার কথায় ঘোর ভাঙলো। চোখ খুলে সামনের দেয়াল ঘেঁষা সোফার দিকে তাকালাম শান্ত দৃষ্টিতে৷ ২৫-২৬ বছরের একটা ছেলে। পরনে নীল জিন্স আর লাল-কালো একটা চেক শার্ট। নরমালি এমন ওয়েদারে ছেলেরা টি-শার্ট পরতেই বেশি কমফোর্ট ফিল করে। এই ছেলের শার্ট পরার কারণ জানি না। একবার জানতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু এমন প্রশ্ন করা ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারছি না। ও নিশ্চয় আমাকে পাগল-টাগল ভাবছে, অথবা জানি না, আমার মতো কাউকে আগে দেখেছে কি না!

 

কিছুক্ষণ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলাতেই জানতে চাইলাম, আপনার নামটাই জানা হলো না! হালকা হেসে ছেলেটা জবাব দিলো, "সাদমান।" বাহ! সুন্দর নাম। আমিও হেসে জবাব দিলাম। ছেলেটা এবার লাজুক হাসি দিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে, পৃথিবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান-ভাণ্ডার সেখানে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। এই দৃষ্টির সঙ্গে আমি পরিচিত। জীবনে বহুবার বহু জায়গায় কী করতে হবে বুঝতে না পারলে আমিও গভীর মনোযোগে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, কখনো অল্প সময়, কখনো দীর্ঘ ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আমি ছেলেটার তাকিয়ে থাকার দিকে একবার চোখ রেখে বিছানা থেকে ওঠে দাঁড়ালাম। সাদমান তখনো দেয়ালের দিকেই তাকিয়ে। সাদমান নামের অর্থ কী? এটাও জানতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে না। রুম থেকে বারান্দায় হেঁটে যেতে যেতে গুগল মামার কাছে জিজ্ঞাসা রাখলাম। সে জবাব দিলো, সাদমান অর্থ "ভাগ্যবান"। কোথাও কোথাও আবার বলছে "আনন্দিত"। যেটাই হোক না কেন, নামটা সুন্দর, ছেলেটার মতোই।

 

আপনি ড্রিঙ্ক করেন? বারান্দার স্লাইডের কাছে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলাম। সাদমান অবশেষে দেয়াল থেকে মুখ ফিরিয়ে উত্তর দিলো, "অকেশনালি।" বাহ! বেশ! আজকে কি খাবেন? সে পাল্টা প্রশ্ন করলো, "আপনি খাবেন?" আহা! আই উইশ! আমার নার্ভের সমস্যা। মদ-সিগারেট খাওয়া বহু আগেই ডাক্তার হারাম ঘোষণা করে রেখেছেন, কিন্তু কত হারাম কাজই তো জেনেশুনেও করি, তাই কয়েক বছর ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনকে পাত্তা না দিয়েই নিজের মর্জি চালিয়ে মদ্যপান চালিয়ে গিয়েছিলাম, ফলাফল- শরীর এখন জং ধরা গাড়ির মতো সময়-অসময়ে জায়গায়-বেজায়গায় ব্রেক ফেল করে। সাদমানকে এটা বলতেই সে হো হো করে হেসে ওঠলো। ওর হাসি দেখতে ভালো লাগছে। মানুষের হাসি দেখতে বরাবরই আমার ভালো লাগে। দুখী দুখী চেহারার কাউকে দেখলেই আমার মনে বিষণ্নতা চেপে বসে। এতক্ষণ সাদমানকে দুখী দুখী মনে হচ্ছিল, বেগম আখতারের গানটার মতো। মনে হচ্ছিল, আজ রাতে এই ফ্ল্যাটটায় তাকে অনিচ্ছাতে থাকতে হচ্ছে।

 

সিদ্ধান্ত হলো, সাদমান মদ্যপান করবে আর আমি হালকা লিকারের এক কাপ লেবু চা খাবো৷ চিনি ছাড়ার পর চা খাওয়াও বাদ দিয়েছি বছর পাঁচেক হবে। আজকে খেতে ইচ্ছে করলো। চিনির বদলে হালকা মধু দিয়ে খাওয়া যেতেই পারে। একটু আদা দিলে ভালো হতো। কিন্তু এই বস্তু ঘরে আছে বলে মনে হয় না, খোঁজাখুঁজির ঝামেলায় যেতে ইচ্ছে করলো না বলে শুধু লেবু চা নিয়ে আমরা ফ্লোরে কুশন নিয়ে বসে পড়লাম। ছেলেটা এখনো বেশ চুপচাপ। একটা পেগ বানিয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে জানতে চাইলাম, আপনি এখানে কেন এসেছেন, জানেন? সাদমান চিয়ার্স বলে একটা চুমুক দিলো হুইস্কির গ্লাসে। আমার ধারণা, হুইস্কিতে চুমুক দেওয়ার এই সময়টা ও উত্তর ভাববে। আমার সামনে প্রচলিত উত্তর দেওয়াটা সম্ভবত ওর শোভনীয় মনে হচ্ছে না। নাহলে ও চুমুক দেওয়ার আগেই উত্তর দিতে পারতো। এখানে আসার কারণ সম্পর্কে ওর অজানা থাকার কথা না, আবার এও সত্য, এতক্ষণে ও কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে, সাধারণত ও যে কারণে এভাবে এসে থাকে, সে রকম কিছু এখানে না ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।

 

হুইস্কির গ্লাসটা ফ্লোরে রেখে সাদমান বললো, "আপনি যে কারণে ডেকেছেন।" ছেলেটা নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমান। টাকাটা জলে যাবে না ভাবতেই ভালো লাগছে। মাথা মোটা এবং হিউমারলেস পুরুষ আমার পছন্দ না। পুরুষ আমার কাছে তাদের বুদ্ধি, বিচক্ষণতা এবং আচরণের কারণে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। একবার কোনো এক আড্ডায় এক মাথা মোটা পরিচিত লোক আড্ডায় উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে, "এই স্যাপিওসেক্সুয়্যাল বলে একটা টার্ম দেখতেছি ইদানিং, এরা কি মাথার ব্রেনরে লাগায়?" বলে খ্যাক খ্যাক খ্যাক করে নিজের সমস্ত শরীর দুলিয়ে একটা বিশ্রী হাসি দিয়েছিলেন। বুদ্ধিহীন লোকের বোঝার কথা না, স্যাপিওসেক্সুয়্যালরা কী দেখে আকর্ষিত হন। যার যেটা নেই, সে সেটা বুঝবে না, এটাই স্বাভাবিক।"

 

"এখন আপনি ডিসাইড করবেন আমাকে কেন ডেকেছেন..." সাদমান হুইস্কির গ্লাসে আরেকটা চুমুক দিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, কবিতা পড়েন? ও চট করেই জবাব দিলো, "আর্ট এবং লিটেরেচারের প্রতিটা ক্ষেত্রই বেঁচে থাকার রসদ যোগায়, না পড়লে বেঁচে আছি কী করে?" বাহ! ছেলেটা আবারও আমাকে মুগ্ধ করলো। আমি কিছু বলার আগেই ও আবার বলে ওঠলো, জীবনানন্দ আমার প্রিয়। আমি একটা তৃপ্তির হাসি দিয়ে বললাম, জীবনানন্দের বনলতা সেন ছিলেন। আর আমি, টাকা দিয়ে মানুষ ডেকে পাশে বসিয়ে রাখি- নিঃসঙ্গতা যাপন করতে কিংবা এই যে ধরুন, কথা বলতে। এইবার সাদমান সম্ভবত কিছুটা অবাক হলো, ধাক্কাও খেলো কি?

 

আমার মতো কারো সঙ্গে কি আপনার আগে দেখা হয়েছে, সাদমান? প্রশ্নটা করার পর উত্তর দিতে বেশিক্ষণ সময় নিলো না- "নাহ। নিঃসঙ্গতা যাপনের জন্য অথবা কথা বলার জন্য কখনোই আমাকে কেউ ডাকেনি। ডেকেছে নানা অদ্ভুত সব ফরমায়েশ নিয়ে।" আমি হাসলাম। আমার হাসির মধ্যে সম্ভবত একটা দম্ভও লুকিয়ে ছিল কোথাও না কোথাও! নিজেকে নিয়ে আমার অনেককিছুতেই প্রাইড রয়েছে। সেগুলো অন্যের সামনে প্রকাশ না করলেও, নিজের কাছ থেকে তো আর লুকানো সম্ভব হয় না। 

 

এই ছেলেটার সঙ্গে কথা বলা যায়। যদিও সাদমানকে এখানে যে পাঠিয়েছে, সে এমন ধারণাতেই পাঠিয়েছে, এই মিডল এইজ ক্রাইসিস নিয়ে আজ সারা রাত আমি ছেলেটাকে খাটিয়ে নেবো। এরজন্য মোটা অংকের টাকাও গুনতে হয়েছে। তবে যিনি সাদমানকে এখানে পাঠিয়েছেন, ওর সম্পর্কে হয়তো তার কোনো ধারণাই নেই। আমার একবার জানতে ইচ্ছে করলো, ও কি শখে এমন কাজ বেছে নিয়েছে, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো গল্প আছে? কিন্তু আমি তো বরাবরই মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলাতে বিব্রত বোধ করি। টাকা দিয়ে কথা বলতে ডেকে এনেছি অর্থ তো এই না যা খুশি প্রশ্ন করতে পারি। ইচ্ছেকে সংবরণ করে বললাম, আপনার কি কিছু জানতে ইচ্ছে করছে? কিছুটা হেজিটেশন নিয়েই ও জিজ্ঞেস করলো, "আপনি কি প্রায়ই এভাবে কথা বলতে মানুষ ভাড়া করেন?" “মানুষ ভাড়া করা” টার্মটা কিন্তু দারুণ, যদিও এটা এক রকম অপমানও। মানুষকে এখন কথা বলার জন্যও মানুষ ভাড়া করতে হয়, পৃথিবী কত নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠেছে।

 

নাহ! আমি এই প্রথম কাউকে টাকার বিনিময়ে কথা বলতে ডেকেছি। যদিও আপনার সঙ্গে কথা শুরুর আগে নিশ্চিত ছিলাম না, পুরোটা রাত নিঃসঙ্গতা যাপন করবো, নাকি কথা বলবো- সাদমানকে বলতেই ও আবার জানতে চাইলো, "আপনার কি কোনো বন্ধু নেই?" আমি একবার কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ দুটো বন্ধ করে আবার খুললাম। ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, আছে। অনেক বন্ধু আছে। অনেক যৌনসঙ্গীও আছে। ছিল বলা ভালো৷ এখন তাদের উপস্থিতি সচেতনভাবেই আমি এড়িয়ে চলি৷ নিঃসঙ্গতা যাপনের মানুষ নেই। বন্ধুত্ব আছে বলেই আপনার নিঃসঙ্গতার ভার কেউ নেবে কেন? আপনিই বা এই ভার অন্য কারো উপর দেবেন কেন? উত্তর সম্ভবত ওর তেমন পছন্দ হয়নি৷ ও জানতে চাইলো, "বন্ধু মানেই তো আপনার আনন্দ এবং দুঃখের ভার বহন করার দায়িত্ব তার।" আমি হেসে দিলাম। প্রতিটা সম্পর্কেরই কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এই যেমন আমরা মাদারহুডকে মহান বানিয়ে মায়ের উপর সন্তানদের সমস্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতায় থাকি। মায়েদেরও নিশ্চয় ক্লান্তি আছে, তারা প্রকাশ করেন ভিন্ন পন্থায়, মেরে-বকে। চাপিয়ে দেওয়া এই প্রবণতাটাকেই আমি অপছন্দ করি।

 

ভোর হয়ে আসছে। চারপাশে পাখিদের কিচির-মিচির, দু একটা রিকশার টুংটাং বেলের আর মানুষের হাটাচলা ও কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে বাইরে থেকে। সাদমান একটা সিগারেট খাবে বলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আমিও ভোর দেখবো বলে পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। পেছনে বাজছে ড্রিম থিয়েটার। সিগারেট টানতে টানতে সাদমান নীরবতা ভেঙে বললো, "আমার আসল নাম আবির। এই প্রফেশনে ছদ্মনাম ব্যবহার করতে হয়। আজ পর্যন্ত যে কয়জনের কাছে গিয়েছি, তাদের কাউকে আমার ছুঁতে ইচ্ছে করেনি, তবু ছুঁতে হয়েছে। হয়তো অর্থের বিনিময়ে গিয়েছি- ব্যাপারটা মাথায় থেকে গিয়েছিল। আজ প্রথম আমার কাউকে ছুঁতে ইচ্ছে করছে। আমি কি আপনার হাতটা কিছুক্ষণের জন্য ধরতে পারি?"