সকাল থেকেই পেটে গন্ডগোল মতির। বৃষ্টি নামার আগে আকাশ যেমন কিছুক্ষণ তর্জনগর্জন করে তারপর জমজমিয়ে নামে, তারও হইছে সেই দশা। এ পর্যন্ত কম করে হলেও দশবারো বার যাওয়া সারা। গতরাতে সেগুনবাগিচার বিউটি কমিউনিটি সেন্টারের গেইটম্যান নুরুরে হলিউড সিগারেট আর রহিমা খালার স্পেশাল মালাই চা খাওয়ায়া এক প্যাকেট মোরগ পোলাও কোনরকমে বাগায়া আনছিল সে। কথায় আছে, কুত্তার পেটে ঘি হজম হয়না। মতিরও অবস্থা হইছে সেইরকম। পাতলা ডাল আর মোটা চালের ভাত হজম করা পেটে মোরগ পোলাও বেচারিরাও নিজেদের অসম্মানিত ভাবে, তাই হজম না হয়ে বের হয়ে যেতে চায় তারা।
প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি নীলক্ষেত-পলাশী-শাহবাগ-চাঁনখারপুল এলাকায় ঘুরে ঘুরে প্লাস্টিক কুঁড়ায় মতি। সন্ধ্যার পর তা মহাজনের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে অন্য ধান্দায় নামে। আর সেটি হলো নেশা বিকিকিনির ধান্ধা।
শাহবাগের তিন নেতার মাঝারের গেইট থেকে গাঁজা নিয়ে রোজকার কাস্টমারদের কাছে তা ঘুরে ঘুরে সাপ্লাই দেয়। মতির বান্দা কাস্টমারদের বেশীরভাগই রিকশা ভ্যানওয়ালা। তবে মাঝেমাঝে ভাগ্য ভালো হলে দুয়েকটা বড়সড় পার্টিও ঝুটে যায়। তখন একদিনেই চারপাঁচ দিনের রোজগার হয়ে যায় তাঁর। এইতো সেদিন হাইকোর্টের সামনের গাছতলায় বসে অন্যদের সঙ্গে বসে জুয়া খেলার সময় একটা প্রাইভেট গাড়ি তাদের সামনে এসে জোরে ব্রেক কষে দাঁড়ায়। তারপর গাড়ি থেকে এক সাহেব এসে জানতে চায়, কারো কাছে গাঁজা পাওয়া যাবে কিনা! মতি সুযোগ বুঝে অন্যদের ইশারা দিয়ে সরে যেতে বলে। তারপর সাহেবরে মুরগি বানানোর চেষ্টা করে।
মতিঃ স্যার, আপনের কি হাঁচাই গাঞ্জা লাইগবো?
সাহেবঃ সত্য নাকি মিথ্যা? তোর সঙ্গে রাতদুপুরে ইয়ার্কি করছি বাস্টার্ড?
মতিঃ না, স্যার, ভাবছিলাম আপনে পুলিশের লোক কিনা। ঐ মাঙ্গিরপুতগো জ্বালায় শান্তিমতো ব্যবসাডাও করতে পারতাছি না। হালারপুতেরা টেকার ভাগও লইবো আবার পুটকিতে গরম ডিমও ভরবো। একেকটা আস্ত হারামির জাত।
সাহেবঃ প্যাচাল বাদ দে। গাঁজা আছে? থাকলে দ্রুত দে।
মতি বিড়বিড় করে বলে, এইতো চান্দু লাইনে আসছো। তারপর বলে, স্যার, আইজকা তো মাল পাইবেন না। আপনের মতো আরও অনেকেই এসে ফিরে গেছে। কাউরেই দিতে পারি নাই। কি করুম, পুলিশের কড়া পাহাড়ায় ডরে কেউ এহন আর এসব সাপ্লাই দিতে চায় না।
সাহেব এবার আগের থেকে সুর নরম করে বলে, অল্প কিছুও নাই, টাকা যা লাগে দিবো।
এবার মতির মুখ লাল হয়ে উঠে। সে মনে মনে ভাবে, আইজকা বড় পার্টি পাওয়া গেছে। যা পারা যায় কামায়া নিতে হবে। তারপর বলে, স্যার, আমার নিজের জন্য অল্প কিছু রাখছিলাম। অন্য কাউকে দেইনাই। তবে আপনি যহন এতো কইরা কইতাছেন, তয় আপনাকে দিতে পারি। কিন্তু টেকা বেশি দেওন লাগবো।
সাহেবঃ তাড়াতাড়ি দে, টাকা যা চাস পাবি। শেষমেশ চড়া দামে দুইটা গাঁজার স্টিক সাহেবের হাতে গুঁজে দেয় মতি।
ইদানিং ভার্সিটির হলগুলো থেকেও গাঁজার অর্ডার আসে মতির কাছে। ছেলেদের থেকে মেয়েদের হল থেইকা অর্ডার আসে বেশি। মতি ভাবে, কি জমানা আইলো, মাইয়া মাইনষেরাও সমানে গাঞ্জা টানে। লাজশরমের বালাই নাই।
যাই হোক সবাইকে গাঁজা সাপ্লাই দিয়ে শেষে নিজেও অবশিষ্টগুলো জোরসে টানে। রাত যত গভীর হয়, মতির নেশাও ততো চড়ে। একসময় নেশার ঘোরেই সিটি কর্পোরেশনের এলইডি লাইটের ফকফকা আলোকে আড়ালে রেখে হাকিম চত্তরের গাছতলায় বিছানা পেতে বেঘোরে ঘুমায় সে। রাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যায় মতির। আর তখন নানান কথা মাথায় আসে তাঁর। মতির মনে পড়ে তাঁর মায়ের কথা। সে তাঁর বাবাকে কখনো দেখেনি। মা যখন ছিল, তাকে জিজ্ঞেস করলেই বলতো, তোর বাবা আছে, বিদেশে কামে গেছে। কাম শেষ হলেই ফিরা আইবোনে। কিন্তু সেই অতটুকুন বয়সেই মতি বুঝে গেছে যে, তাঁর বাবা আসলে কোনদিন আর ফিরবে না। মা তাঁর সাথে মিথ্যা কথা বলতেছে। আসলে আশেপাশের মানুষরাই তাকে প্রতিমুহূর্তে বুঝিয়ে দিয়েছে সে একটা বেজন্মা। আরেকটু খোলাসা করে বললে, সে এমন ছেলে যার বাবার ঠিক নাই। সুযোগমতো কেউ তাঁর মায়ের সর্বনাশ করে চম্পট দিয়েছে। আর এ সর্বনাশের ফসল সে।
মতির যখন সবে লাইনে দাঁড়িয়ে রিলিফের চাল/ডাল নেয়ার বয়স অথবা পথশিশুদের স্কুলে গিয়ে মনোযোগী ছাত্রের ভান করে পেটে খাবার চালান দেয়ার বয়স, ঠিক সেই বয়সে তাঁর মা অন্য আরেকজনকে বিয়ে করে তাকে ফেলে রেখে চলে যায়। তখন তারা মগবাজার রেলগেট লাগোয়া বস্তিতে থাকতো। ঐ বস্তিরই এক মহিলা, যে রাত নামলে বেশ্যার কাজ করতো, সে তাকে দয়া করে আশ্রয় দেয়। একসময় মতির সাথে ঐ মহিলার অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠে। মহিলার দিক থেকেই প্রথম কু প্রস্তাব আসে। সদ্য দাড়িগোঁফের আল গজানো মতিরও একসময় শরীরে শিহরণ জাগে। ঝাঁপিয়ে পড়তে দুইবারের বেশি ভাবে না সে। কিন্তু তাদের এই নষ্টামি বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। একদিন মহিলার স্বামী হাতেনাতে তাদের ধরে পেলে। তারপর সালিশে বস্তির সরদার মতিকে বস্তি থেকে বের করে দেওয়ার রায় দেয়, এছাড়া ওই মহিলাকেও তালাক দিতে বলে তার স্বামীকে। তারপর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই আস্তানা গাড়ে মতি। প্রথম দিকে নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে টিকে থাকাই তার জন্য বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। তাঁর সমবয়সীরা তাকে নতুন উপদ্রব মনে করে সবসময় তাড়ানোর ধান্ধায় থাকতো। দিনের বেলা সবাই এক জোট হয়ে তাকে ভালোয় ভালোয় এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দিত, আর রাত নামলে দুইচারটা কিলঘুষিও মারতে দ্বিধা করতো না।
কিন্তু একদিনের এক ঘটনার পর পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে যায়। ভাগ্য মতির পক্ষে কথা বলে। এরপর থেকে মতি শাহবাগ-টিএসসি এলাকায় টোকাই-ভাঙ্গারী দলের লিডারে পরিণত হয়। সেদিন ভার্সিটির মুহসিন হল থেকে ভাঙাচোরা আর ক্ষ্যাপমতো একজোড়া পাম্প সু চুরি করে ফিরছিল মতি, ভিসি চত্বর পার হয়ে যেইনা টিএসসির দিকে এগোবে, ওমনি আগে থেকে ওৎপেতে থাকা একদল পোলাপান হালারে ধর ধর বলে তাকে ঘিরে ধরে। কারও হাতে ইট, কারও বা চাকু অথবা ক্ষুর। মতি ঘটনার আকস্মিকতায় ভড়কে না গিয়ে উল্টো বিকট শব্দে হেসে উঠে। তারপর সবাইকে চমকে দিয়ে হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলে, তোরা মারবি আমারে? আয় দেখি কতবড় কইলজা তোগো। এরপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজনের হাত থেকে একটা ইটের টুকরা নিয়ে আরেকজনের মাথায় জোরসে মারে। এর কিছুক্ষণ পর তেড়ে আসা দলের কাউকে আর আশেপাশে খুঁজে পাওয়া যায়না, শুধু মাথায় আঘাত পাওয়া ছোকরার দুয়েকবার ঘোঙানির শব্দ শোনা যায়। অন্যের মাথা ফাটিয়ে এভাবেই নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে নেয় মতি।
রোজকার এই জীবনের বাইরেও আরেকটা জীবন আছে মতির। যে জীবনে সে তার ভালোবাসার মানুষ ময়নাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। রাতে নেশার ঘোরে গাছতলায় শুয়ে শুয়ে সে ভাবে, ময়না আর তার ছোট্ট একটা সংসার হবে। চান্দের লাহান ফুটফুটে একটা বাচ্চা হবে। আরো কত কি! ময়নাও তার মতোই টোকাই, তবে সে তাঁর মা-বইনের সাথে পলাশীর বস্তিতে থাকে। দিনে একবারই দেখা হয় তাদের। সেটাও চাঁনখারপুলে মহাজনের কাছে দিনের সংগ্রহ বুঝিয়ে দেওয়ার সময়।
প্রতিদিন ময়নার সাথে দেখা হওয়ার আগে শাহবাগ মোড়ের ফুলের দোকানগুলোর ফেলে দেয়া বাসি-পঁচে যাওয়া ফুলের স্তূপ থেকে অপেক্ষাকৃত একটু ভালোটা সে কুঁড়িয়ে নিয়ে সবার অগোচরেই তা ভাঙারির বস্তায় লুকিয়ে রাখে। তারপর তা সুযোগমতো ময়নার ময়লা নাকের ডগার কাছে তুলে ধরে বলে, কি কেমুন ঘ্রাণ? ফাইন নাহ? এরপর রহস্য করে হাসতে হাসতে বলে, যাহ তোকে দিয়ে দিলাম এইটা। ময়নাও তখন মুচকি হেসে ফুলটা নিয়ে যত্ন করে নিজের বুকের কাছে রেখে দেয়। এভাবেই চলছে গত দেড়বছর ধরে।
কিন্তু আজ মতির পেট সব গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেলছে। তাঁর অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাওয়ায় তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোরা ধরাধরি করে তাকে মহাখালির কলেরা হাসপাতালে নিয়ে যায়। যদিও সমাজের নিচু জাত টোকাই শ্রেণীর হওয়ায় সিট জুটেনি ভাগ্যে। হাসপাতালের বারান্দাতেই রাখা হয়েছে তাকে। সেখানে শুয়ে শুয়েই সে ভাবে, আজও কি ময়না তাঁর বাসি ফুলের ঘ্রাণের অপেক্ষায় থাকবে?..
বাসি ফুলের ঘ্রাণ
লেখার সময়কাল, ২০১৭' কোনো এক রাত
মুহসিন হল, ৪৬৫ নম্বর রুম।