পোস্টস

উপন্যাস

জীবন জুয়া

১১ জুলাই ২০২৪

আলফা বন্ধন

"মানুষের ভাষ্য মতে জেলখানার বিভিন্ন নাম থাকলেও আমার কাছে, জেলখানার আরেক নাম পাগলা গারদ। পাগলা গারদের মানুষ নিজেদের বিভিন্ন প্রতিভা দেখায়, এখানে ও তেমন। সেখানে ও কিছু মানুষ আতংকে থাকে, থানা হাজত এর প্রাথমিক কয়েদীরাও তেমন আতংকে থাকে। তবে আমার তেমন আতংক মনে হচ্ছেনা।"

"বর্তমানে আমার অবস্থান উত্তরা পশ্চিম থানার কয়েদী। আমার নামে প্রাথমিক যে জিডি (জেনারেল ডায়েরী) করা হয়েছে তা হলো আমি একজন জুয়ারী।"

"যে জিডি করেছে সে নিতান্তই রাগের বসে বোকামি করেছেন, জিডি করেছে আমারই ক্যাম্পাসের সিনিয়র সানজিদা আপু। গাজীপুর চৌরাস্তায় একটি গার্মেন্টস এর মালিকের একমাত্র সুন্দরী কন্যা।সুন্দরী বললে খানিকটা কম হবে এর সাথে ভয়ংকর যুক্ত করতে হবে।কারন ক্যাম্পাসে সবাই তাকে ভয় পায় একই সংগে তার পিছে লাইন লেগে পরে থাকে।

এবার আমার পরিচয় দেই।আমার নাম আলফা বন্ধন।নামটা আমার বাবার দেয়া। তিনি একজন ফিজিক্স এর প্রভাষক। নাম শুনলে আমাকে ছেলে নাকি মেয়ে সেটা নিয়ে জাজ করা হয়।এতে আমার কিছু আসে যায় না।কিন্তু আলফার সাথে বিটা গামা লাগানো আমার ক্লাসমেট দের অভ্যাস।আমি উত্তরা ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগ এর প্রথম বর্ষের নিয়মিত ছাত্র।নিয়মিত লেখার অভ্যাসটা বাংলা পত্র লেখার অভ্যাস থেকে হয়ে গেছে।

ক্যাম্পাসে আমি জনপ্রিয়তার শীর্ষ একজন।আসর জমাতে আমার জুরি নেই।ভার্সিটির প্রথম দিনের একটা ঘটানা,

" এখানে সিনিয়র জুনিয়র মেনে চলায় হয়,সিনিয়ররা স্টলে বসলে জুনিয়রের ঢোকার অনুমতি নেই।ভুলে যদি কেও ঢুকে এক কাপ চা খেতে থাকে সিনিয়রের একজন শুরুতে তার নাম ঠিকানা জিজ্ঞাসা করবে বিনয়ী ভাবে মনে হবে তাহেরি হুজুর খোজ নিচ্ছেন।এর পরেই শামীম ওসমানের ভাষণ শুরু হবে।
"কোন ইয়ার?
" ফাস্ট ইয়ার।
"ডিপার্টমেন্ট? 
" ফার্মেসী।
"বাংলাদেশের শীর্ষ ৩টি ফার্মাসিউটিক্যাল ব্র্যান্ড কী?

এ পর্যায়ে অনেকেই চুপ হয়ে যায়।
তখন পাশ থেকে একজন দাঁড়িয়ে বলে উঠবে।তোর মধ্য আদব কায়দা নেই।সালাম দে।

" আসসালামু আলাইকুম। 
এবার তিনি আবার বলবে এখানে ৫ আছে ৫ বার সালাম দে।

এবার কিছুটা ভীত হয়ে সে ৫ বার সালাম দিবে।

এরপর তাকে বলা হবে সিনিয়ররা স্টলে থাকলে আর কখনো ঢুকবিনা।আর এটা নিয়ে বাইরে কোন গন্ডগোল করলে তোর ভর্তি বাতিল।মনে থাকবে?
"জি ভাই।
একবার না।৫ বার বল জি ভাই।
" জি ভাই। জি ভাই।জি ভাই।জি ভাই।জি.
"থাক হইছে, এখন ক্লাসে যা।চা বাড়ি থেকে খেয়ে আসবি।বাপের টাকা নষ্ট করে বাইরে খাবি না।

'সিনিয়রদের একেকজন বিশাল ফিলসফি দিবে,এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।এটা বিনোদনের একটা অংশ।এই অংশের আরেকজন দর্শক মতি মিয়া।যার নামে এই দোকান।পান চিবুতে চিবুতে সে মজার এই দৃশ্য উপভোগ করে।'
'মতির দুধ চা ' স্টলের নাম।
খাটি দুধ দিয়ে বানানো মাটির কাপে এই চা খেয়ে এল এল লি ডিপার্টমেন্ট এর রবিন ভাই এই দোকানের নাম দিয়েছিল মতির দুধ চা। নামটা মতি ভাইয়ের মনে ধরে সেখান থেকেই এই নাম।

রবিন ভাই গরিবের বন্ধু রবিন হুড না হলেও।যত বড় সমস্যা হোক,রবিন ভাইয়ের কাছে কোন সমস্যাই না।কারন এতিম খানায় বড় হওয়া রবিন ভাই ছোট বেলা থেকে সমস্যা দেখে অভ্যস্ত।

'এবার কাহিনীতে ফিরি'
ক্যাম্পাসে আমার পঞ্চম দিন।এর মধ্যেই আমার গুটি কয়েক বন্ধু হয়ে গেছে।তাদের মধ্য আবিদ,সাজ্জাদ,মেহেদী,ইসরাত আর মুন অন্যতম।
এরা আমাকে কড়া নির্দেশ দিয়েছে সিনিয়র ভাইরা দোকানে থাকলে যেন দোকানে না যাই।
আমি বললাম কেন?র‍্যাগ দেয় নাকি?প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে র‍্যাগ দেয়ার নিয়ম আছে নাকি?

আবিদ বলল 'নিয়ম বানানো রবিন ভাইয়ের কাজ।রবিন ভাইয়ের মুখের কথাই নিয়ম,কেও নিয়মের ব্যতিক্রম কিরলে শারীরিক শাস্তি না দিলেও মানষিক ভাবে শান্তিতে থাকতে দেবেনা'

বললাম৷ ঠিক আছে আমি দেখছি।তোমরা থাকো।
'সবাই আমাকে তুই করে বললেও আমি সবাইকে তুমি করে বলি এর কারনটা অন্য সময় বলব'

" রবিন ভাই তখন স্টলে বসে মাটির কাপে দুধ চা আর বাম হাতে বেনসন এন্ড হেসেজ জ্বালিয়ে তার সাগরেদ দের সাথে কোন বিষয়ে কথা বলছিল, এর মধ্য আমি গিয়ে সবার উদ্দেশ্য লম্বা সালাম দিলাম-
'আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু'

পরিস্থিতি নীরব,ভিক্ষুক সম্প্রদায় এমন বড় করে সালাম দিয়ে মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করে।
সবার মধ্য দেখে রবিন ভাই সালামের উত্তর নিলেন। 
'ওয়ালাইকুম সালাম,কে তুমি?
'আমি আলফা'নাম বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
'কোন ইয়ার?কোন সমস্যা?

(ইয়ার জিজ্ঞাসা করাটা হয়ত রবিন ভাইয়ের মুদ্রা দোষ, যাকে দেখেন তাকেই হয়ত জিজ্ঞাসা করেন।)
'জি ভাই সমস্যা,আপনারা কোন ইয়ার?

সবাই সবার মুখ চাওয়া চায়ি করছে,মনে হচ্ছে -গাজা খেতে বসে মাত্র গাজার সাথে সিগারেট এর নিকোটিন এর মিক্সিং এর সময় ফর্মা এসে তাদের জিজ্ঞাসা করছে।কারো কোন কথা নেই।

রবিন ভাই বলল। কে তুই কোন ইয়ার?আর নাম কি বললি আলফা?মসকরা করিস?ভালো নাম বল।

আমি বললাম 'ভালো নাম আলফা বন্ধন।জন্মের পর দুইটা খাসি জবেহ করে এই নাম রাখা হয়েছে।

' আমরা কোন ইয়ার জেনে তোর দরকার কি?
'আমার পিতা মহোদয় এর করা নির্দেশ বড়দের সম্মান করতে হবে,সম্মান দিলে সম্মান পাওয়া যায়।এখন আমি যদি আপনারা কোন ইয়ার না জেনে দোকানে ঢুকে একটা সিগারেট ধরিতে ফেলি সে ক্ষেত্রে আপনি আমাকে পেটালেও আপনার গাতে যেই অপমান লেগেছে তা সরাতে পারবেন না'

দলের একজন রবিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে হুকুমের অপেক্ষায়।জার্মান শেফার্ড এর মত ভংগিতে তাকিয়ে আছে যেন রবিন ভাইয়ে বলা মাত্র আমার কলার ধরে একটা থাপ্পড়ে ৫ আংগুল বসিতে দিতে পারলে তার মন শান্ত হতো।

রবিন ভাইকে শান্ত মনে হলো।শুধু শুধু তার তাকে সবাই মান্য করে এমন না।তার ধৈর্য শক্তি ভালো।পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার বিশেষ ক্ষমতা এই রবিন ভাইয়ের আছে।
তিনি বললেন' তোমার বাবা ঠিক বলেছেন,তবে তুমি যেভাবে জিজ্ঞাসা করেছো এটা বেয়াদবি'

রবিন ভাইকে আরেকটু উত্তেজিত করে দিতে পারলে ভালো লাগত।আমি বললাম।
'আমি নিরুপায়, শার্ট এর বুক পকেটের সামনে এ কোন ইয়ার লিখে দেয়া থাকলে এই সমস্যায় আমাকে পড়তে হত না,আমার বেয়াদবির জন্য আপনি যে শাস্তি দিতে চান দিতে পারেন।'

রবিন ভাইয়ের মুখে হাসি দেখতে পেলাম।মনে হচ্ছে সে এই বিতর্কে মজা পাচ্ছেন।তার পুরনো দিনের বিটিভির পর্দায় বিতর্কর কথা মনে পড়ে গেছে।রবিন ভাই একজন বিতার্কিক সেটা আমি আগেই জানতাম।ক্যাম্পাসের ডিবেটিং সোসাইটির ব্যানারে আমি তার ছবি দেখেছি।
সামনে একটা টুল দেখিয়ে বলল-
' বস।কথাতো ভালোই বল,কথা ছাড়া আর কি পার। নাচতে পারো?
দলের সবাই হেসে উঠল।এবার সবাই মজা পাচ্ছে।
'বললাম জি না ভাই,তবে আপনি বললে একটা গান শুনাতে পারি।আমার গানের গলা ভালো।'
'ঠিক আছে একটা ফোক সং ধর'

আমি একটু নড়ে চড়ে গান ধরলাম-

"মনরেএএএ,হাইলা লোকের লাংগল বাকা, জনম বাকা চাঁদ রে,জনম বাকা চাঁদ"

পরিবেশ শান্ত, আশেপাশে লোক জড় হতে শুরু করেছে।দূর থেকে আমার বন্ধুরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।এমন দৃশ্য তারা আগে দেখেনি এমন ভাব।বড়লোকদের ছেলেপুলে এদের অবাক হওয়ার ব্যাপার প্রবল।

গান শেষ করতেই মতি ভাই মাটির কাপে এককাপ ফুটন্ত চা বানিয়ে রবিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল।
'বড় ভাই, অনুমতি দিলে ছোট ভাইরে এককাপ চা খাওয়াই।মেলা পুরানা দিনের গান।ছোডকালের কথা মনে পইড়া গেল'
রবিন ভাউ হাসল। এর মানে উত্তর হ্যা।

আমি চা মুখে দিয়েই বুঝলাম, রবিন ভাইয়ের নাম দেয়া সঠিক।

চা খাওয়ার মাঝেই রবিন ভাই বলে উঠল।
'সিনিয়রদের সাথে বসে একসাথে এখানে কেও চা খায়নি,তুই প্রথম।মতি ভাই চা বানিয়ে ফেলছে তাই অনুমতি দিলাম।কারন খাবার অপচয় করতে নাই যার রিজিকে আছে সে খাবে।'
(নিজের সম্মান ধরে রাখার তাগিদে এ কথা বললেও তিনি যে খুশি হননি তা না,তিনি নিজেও জানেন না তিনি আমাকে তুমি থেকে তুই করে বলছে।এমন যেন আমি তার আপন ছোট ভাই।

এবার তিনি বললেন ' তোর আব্বা তোকে ভালো শিক্ষা দিয়েছেন।তোর মধ্য প্রতিভা আছে, তুই বিতর্ক করতে পারিস?
'জি ভাই কিছুটা, সমকাল পত্রিকার বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আমাদের দল রানার্স আপ হয়েছিল'
'রানার্স আপ হলে হবে না।জীবনের লক্ষ হতে হবে চ্যাম্পিয়ন, ক্লাস শেষে মতি ভাইয়ের দোকানে অপেক্ষা করবি তোর সাথে কথা আছে।এখন আমি উঠব।এখন তুই ক্লাসে যা।'

স্টল থেকে বের হয়ে দেখলাম সাজ্জাদ নেই,আমার ঝামেলা দেখে ওর পেটে ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে।প্রকৃতির ডাকে সে ছোতাছুটু করছে।

এর মধ্য ইসরার বলল তুই এত ভালো গান পারিস। আমাদের শুনাস নি তো।আমি হাসলাম।

এর মধ্য পাশ থেকে একটা মেয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল।চোখে কালো সানগ্লাসে চোখ দেখা যাচ্ছে কানের লতি বেয়ে চুল বয়ে গেছে মেঘনা নদীর মত।হালকা মোছ।রোদের আলতে মেয়েটাকে চিনা বাদামের মত লাগছে।
'আমি নীলাদ্রি, ফাস্ট ইয়া, ফার্মাসি ডিপার্টমেন্ট '

আমি হাত না মিলিয়ে বললাম, 
আলফা বন্ধন,ইলিশ ডিপার্টমেন্ট, প্রথম বর্ষ।

এত সুন্দর একটা মেয়ের হাত ফিরিয়ে দেয়ায় মেয়েটা খানিকটা অপমানিত বোধ করলেও সাভাবিক ভাবে হাত নামিয়ে নিল।আর বলল -'ইলিশ ডিপার্টমেন্ট মানে?'

মেহেদী বলল-ইংরেজি বিভাগ,আলফা সব কিছু নিয়েই মজা করে।

নীলা হেসে উঠল,তার হাসির তুলনা দিতে হলে পাউরুটির সাথে অরেঞ্জ জেলির মিশ্রণের তুলনা দিতে হবে।গজ দাতটা তার হাসির মধুরতা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

সে বলল 'আজ আসি,আমার ক্লাস শেষ '
বলেই পাজেরো গাড়িতে উঠে সাই করে চলে গেল।

আমি বাস্তবে ফিরলাম এক কনস্টেবল এর ডাক শুনে
' এই ছেলে বাইরে আয়,বড় সাব তোরে ডাকে,বড় সাবরে সালাম দিবি।বেয়াদবি বড়সাবের সামনি করবি না।বড়সাব বেয়াদবি পছন্দ করেন না।'

কনস্টেবল এর নাম মকবুল, তিনি সম্ভবত বড়সাহেবকে ভয় পান আর বড়সাহেবকে বড়সাব বলেই ডাকেন।বড় সাব না বলে যদি বড় সাপ বলে ডাকত কেমন হত?ভাবতেই আমি ফিক করে হেসে উঠলাম।কনস্টেবল বিরক্ত হিয়ে বলল।বেদ্দবের মত হাসবি না।তোর হাসি ফাসি দিয়া বাইর করব।

গেট খুলে দেয়া হলো।আমি এগিয়ে গেলান বড়সাবের কাছে।

চলবে...!