পোস্টস

সমালোচনা

ওয়েব ফিল্ম: দুই দিনের দুনিয়া, আলোচনা-পর্যালোচনা

১১ মে ২০২৩

Moin Hasan

মূল লেখক মঈন হাসান

২০১৬ সালে যখন আয়নাবাজি সিনেমা মুক্তি পায়, তা নিয়ে সবার মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ দেখা যায়। সিনেমার গল্প ছিল সাড়া ফেলবার মতোই। যার ফলে উৎসাহ খুব স্বাভাবিক বলেই মনেহয়। যারা হলে গিয়ে সেসময় সিনেমাটি দেখলেন, সবার মধ্যে একটা মুগ্ধতা ছিল। সেই আয়নাবাজি সিনেমার গল্প লিখিয়েদের একজন ছিলেন অনম বিশ্বাস, অন্যজন গাউসুল আলম শাওন। পরবর্তীতে দেবী সিনেমার পরিচালকও ছিলেন অনম বিশ্বাস। সে থেকে তাকে নিয়ে আশা করার মতো জায়গা তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। যা এখন পর্যন্ত তিনি বেশ ভালোভাবেই ধরে রেখেছেন বলা যায়। 

দুই দিনের দুনিয়া। সম্ভবত নামের মধ্যেই এই ওয়েব ফিল্মের সার্থকতা খোঁজা সহজ হবে। যে গল্প, সেখানে দুই দিনের দুনিয়া- আমাদের সমাজের এই প্রচলিত বাক্যের ভাবটুকু নিয়ে যতটুকু পোট্রে করা যায়, পরিচালকের সেই চেষ্টা বেশ ভালোই ছিল। 

আমরা যে অল্প কিছুদিনের জন্য দুনিয়ায় আছি, আর যখন তখন চলে যাব, এই সহজ জিনিসটা আমরা সাধারণত খুব একটা মনে রাখিনা। মনে রাখিনা কীভাবে? আমাদের কর্মে মূলত, অর্থাৎ আমরা যা করি এক জীবনে, সেসবই তো আমাদের কর্ম। আমরা হয়তো অনেককিছুই লোভে করি, ক্ষোভে করি, পাপের ভাব মনে জমলে করি। এরকম অনেক করা আমাদের এই ছোট জীবনে, দুই দিনের দুনিয়ায়, আমরা ঘটাই। যার অনেককিছুই হয়তো প্রয়োজন ছিলনা। কিন্তু আমরা যখন তা করি, তখন আমরা ততটুকু চিন্তা করি না, ভাবিনা কি থাকতে পারে উপসংহারে।

আর পাপ যখন করি, তখন আসলে শুধু আমি এর দায় নেই না। আর সমস্ত বাকি মানুষ, যারা আমারই চারপাশের, তারাও আমার এই লোভের, ক্ষোভের থেকে করা পাপের ভারটা বহন করে, তারাও দায় নেয়। আমি যখন পাপ করি, আমি যেন সমগ্র সমাজকে নিয়েই পাপ করি। আর পাপের ফল, যা আমি এই দুনিয়াতেই- বিভিন্নভাবে ঘুরে যেন আমার কাছেই ফিরে আসে। আমার পাপ আমার কাছেই ফিরে আসে অনেক গল্প হয়ে। অথচ দুনিয়াটা ছিল দুই দিনের। দুই দিনের দুনিয়া। পরিচালক অনম বিশ্বাসের এই ওয়েব ফিল্মের গল্পের সাথে নামের সার্থকতার জায়গাটা হয়তো এখানেই ঘটে বলে দর্শকের কাছে মনে হবে। 

যিনি এই ওয়েব ফিল্মের গল্পকার, তার নাম আশরাফুল ইসলাম শাওন। দুই দিনের দুনিয়া নিয়ে তিনি যে গল্পটা বানিয়েছেন, সেখানে সময়-ভবিষ্যত নিয়ে ইন্টারেস্টিং কিছু বিষয় আছে। টাইম ট্রাভেল, টাইম লুপ- যা বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য সম্ভবত নতুন। গল্পের খাতিরেই হোক বা নতুন কিছু সংযোজন করাই হোক, এসব ব্যাপারে সাধারণত বেশ আগ্রহী দর্শক এখন খুঁজে পাওয়া যায়। ‘গল্পের খাতিরে’ ধরে নিয়ে মূল গল্পটা, গল্পটা কি বোঝাতে চায় আমাদের, তাই বুঝতে চেষ্টা করে যাওয়াটা বরং এখানে বেশ আনন্দদায়ক হবে। 

 

ওয়েব ফিল্মের ভেতর থেকে কিছু কথা 
 
চঞ্চল চৌধুরী, ফিল্মে যার নাম সামাদ, তিনি একজন ট্রাক ড্রাইভার। ফিল্মটা দেখতে গেলে, তার কিছু পাপ আমরা চিহ্নিত করতে পারব। সে থেকে গল্পের প্যাটার্নটা বোঝা বেশ সহজ হবে। আর তার সেই পাপের রেখাই যেন সমস্ত ফিল্মে দেখা যায়। 

যেমন, সামাদের দ্বিতীয় বিয়ে। যা তার পরিবার জানেনা, তার প্রথম স্ত্রী জানেনা। এবং এই দ্বিতীয় বিয়ে শুধু বিয়ে না, সেখানে সামাদ একটা অঘটন বা পাপ ঘটায়, যা তাকে বাধ্য করে দ্বিতীয় বিয়ে করতে। আর সেই বিয়ের খবর তার পরিবার পরে জানতে পারে, যখন তার দ্বিতীয় স্ত্রী সামাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। সামাদের পরিবার এসব জানার পর সেখানেও তার নিজের করা পাপের স্রোতটাই যেন বইতে থাকে, ভীষণ কষ্ট পায় তার প্রথম স্ত্রী। অকাল পাথারে পরে তার দ্বিতীয় স্ত্রী। এক পাপের কত স্রোত বইছে দর্শকদের এখানে খেয়াল করতে হবে। 

আরো কিছু উদাহরণ টানা যাক। সামাদ তার ভাই ইদ্রিসের জমি বুঝিয়ে দিচ্ছে না। ইদ্রিসের বাড়িতে তখন অনেক সমস্যা, তার বউ অসুস্থ, টাকার দরকার। ফিল্মের শুরুতেই সামাদ তার হেল্পার আকবরের কাছে টাকা দেয় তার মহাজনকে দেবার জন্য। আকবরকে দেওয়া চার লক্ষ টাকা থেকে দুই লক্ষ টাকা সে জুয়া খেলে হারে। আকবরের ফোন বন্ধ এবং টাকার দুশ্চিন্তায় সামাদ আকবরের বাড়িতে গিয়ে এই সমস্ত ব্যাপার জানতে পারে। অর্থাৎ জুয়া খেলে টাকা হারাবার ব্যাপার। তখন তার সাথে ছিল ফজলুর রহমান বাবু, ফিল্মে যার নাম জামশেদ। জুয়া খেলে হারা সেই দুই লক্ষ টাকা আবার জুয়া খেলেই উঠানোর জন্য সামাদ বোর্ডে বসে। সামাদ যখন জুয়ার বোর্ডে, ইদ্রিসের ফোন আসে। দুই লক্ষ টাকা ফেরত পাবার অস্থিরতা, জুয়ার বোর্ডে বসে সামাদকে ইদ্রিস ফোনে শোনায় তার বউ অসুস্থ, তারও টাকার কতটা প্রয়োজন, প্রয়োজন তার প্রাপ্য জমির। আর সামাদ শোনায়, সে নিজে গলা পর্যন্ত বিপদে আছে আর এখন এইসব আলাপের সময় না। এই সমস্ত ঘটনা যখন ঘটছে, তখন সেই জুয়ার আসরে- ট্যাকা পাখি গানটাও বাজছে, যেটা ফিল্ম রিলিজের বেশ কয়েকদিন আগে রিলিজ হয়েছিল। দর্শকদের এই সময়টা চমৎকার মনে হবে। পাপ, প্রয়োজন, টাকা সব মিলেমিশে এক জায়গায় এসে থামে। ছোট-ছোট কথাবার্তা, আবহ এবং ঘটমান ঘটনাগুলিও বেশ অর্থবহ মনে হবে। 

জুয়া খেলে সামাদ টাকা উঠায়। ব্যাগ ভরে টাকা নিয়ে বাইরে এসে দেখে তার নিজের ট্রাকটা নাই। ইন্টারেস্টিং যে, হাতে এখন টাকা আছে। সাধারণত, এখন কিছুটা স্বস্তি পাবার সময়। টাকা হাতে থাকলে এমনিতেই সবকিছু সহজ মনেহয়, তা যদি আরো হারানো টাকা হয়। কিন্তু সেই রেখা, পাপরেখা এতদূর পর্যন্ত টানা যে, দুঃসময় আর শেষ হয় না। যেন এই আছে, এই নাই। একটা গহ্বরেই পড়ে থাকার সমান হয়ে গেছে জীবন। খেয়াল করে থাকবেন দর্শক, কনসিকুয়েন্সগুলি। কার্মা- নামে যে টার্ম ব্যবহার হয়, সেটা নিয়েও ভাবা যাবে তখন সামাদের জীবন দেখতে গেলে। এবং একদম শেষ দিকে সামাদের আরো একটা কর্ম, একটা বড় পাপ দেখানো হয়। যা জামশেদ বা ফজলুর রহমান বাবুই বলেন। সেই পাপের প্রায়শ্চিত করতে গিয়ে চঞ্চলের একমাত্র মেয়ে মিলির জীবনটাও প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিল। সমীকরণ এমন হয়, সামাদ কি নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে নাকি তার মেয়েকে, এরকম একটা জায়গায় গল্প এসে থামে। সামাদের করা পাপগুলি তার নিজ উপলব্ধিতে আসে। এরপর দৃশ্যে কান্না, অসহায়ত্ব, ভুল স্বীকার এসব ঘটতে থাকে। 

 
জামশেদ কে? 
 
ফজলুর রহমান বাবু ‘জামশেদ’ নামে একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। তিনি হঠাৎ করেই দৃশ্যে আসেন। তিনি ভবিষ্যৎ থেকে এসেছেন, ২০৩৩ সাল থেকে এসেছেন এবং তিনি জানেন কি ঘটবে। এই কথাগুলি বিভিন্ন সময় তিনি বলেন। পরিচালক বা গল্পকার সম্ভবত জামশেদ চরিত্রকে ব্যবহার করেছেন গল্পকে আরো সহজ-সাবলীল করবার জন্য। কিছুটা ফিলোসফিক্যাল জায়গা থেকেও এই চরিত্রকে ব্যাখ্যা করবার সুযোগ থাকে। যেহেতু ভবিষ্যৎ বক্তা হিসেবে জামশেদের আবির্ভাব, সেহেতু আমাদের যেটা ভবিতব্য, তা যে আমরা এড়াতে পারিনা, সেরকম জায়গা থেকেও তাকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। পাশাপাশি আমাদের কর্মফল বলতেও কিন্তু ভবিষ্যৎ। এই সমস্ত কিছুই এখানে সংযুক্ত রয়েছে বলেই ধারণা করা যায়। 

 
শেষের কথা 
 
অভিনেত্রী তানভীন সুইটিকে অনেকদিন পর দর্শকরা হয়তো দেখবেন। চঞ্চল চৌধুরীর স্ত্রীর ভূমিকায় তিনি চমৎকার অভিনয় করেছেন। বিশেষ করে চঞ্চল আর সুইটির ফোন আলাপের কথা বলতে হয়। যে আলাপে তানভীন সুইটি চঞ্চলকে তার দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারে জানতে পারবার কথা জানায়, সাথে তার রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ পেতে থাকে। তানভীন সুইটি এই ধরনের কাজ আরো করবেন বলে প্রত্যাশা রাখা যেতে পারে। 

গল্পকার আশরাফুল ইসলাম শাওন, পরিচালক অনম বিশ্বাস তাদেরকে ধন্যবাদ, যে তারা চিন্তা করবার মতো কিছু জিনিস করার চেষ্টা করেছেন। আমাদের কর্ম এবং কর্মফল, এই দুই নিয়ে আমাদের মনোজগত সাধারণত ভাবতে চায় না। কিন্তু দুই দিনের দুনিয়ায় এসব ভাবনার গুরুত্ব কতটুকু, তা বিভিন্ন মাধ্যমগুলিতে দেখানো আরো বেশি প্রয়োজন।