পোস্টস

গল্প

ইদের সকাল

১১ জুলাই ২০২৪

সোলায়মান হোসেন তুষার

ইদের সকাল 

নতুন সকাল যা নিয়ে এলো তা এককথায় ঈশ্বরের উপহার।

লুৎফর যুবক। বয়স কম করে হলেও বাইশ। চালচলন তেরো বছরের কিশোরের মতো হলেও দাড়িগোঁফ গজিয়েছে ঢের। তেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে সে জলের সাথে জীবনের যোগ করে আসছে। পরিবারের অন্নযোগও হচ্ছে এই সন্ধির ফলে।

উঠান পার করে আম্বিয়াদের বড় বাড়ি পাড়ি দিলেই সোনাইখাল। সোনা না উঠলেও জাল ফেললে উঠে আসে চ্যাঙ, বোয়াল, কৈ! সেখানেই ভোর হলে গুড়-মোয়া, খই নিয়ে রওনা হওয়া; বাইশের তেরো বছরের হিসাব এই-ই। ইদ-কুরবানি হলে ব্যতিক্রম বটে। ইদে যায় ইদগাহ মাঠে, কুরবানিতে হাটের পাশের মোবাশ্বের মাতব্বরের গোশত বানাতে। জীবনের এই দুটো দিন তার অঘোষিত জলছুটি!

বাবা মারা যায় তেরোতে। জলের ঋণ শোধ করতে, নয়তো জলের সাথে মিলন ঘটাতে জলেই জীবন দেন তিনি। তার আগের দিনগুলোতে বাবার ফরমায়েশ খাটা, জলের সাথে বন্ধুত্ব, জল থেকে ফায়দা আঁটা এবং জল থেকে মগজবলে কিংবা কৌশলে জীবনরক্ষার কৌশল শিক্ষা পেয়েছে। পরের দিনগুলোতে নিজেকেই নিজে দীক্ষা দিয়েছে ভয়কে জয় করার এবং বদমায়েশ ক্ষুধাকে। বেঁচে থাকতে আর যা লাগে তা জয় হয়েছে কিঞ্চিৎ!

জীবন তাকে যা দিয়েছে তার কিঞ্চিৎই দিয়েছে বোন শরীফাকে। শরীফার গেল বৈশাখে বারো গেল। বারোর সাথে আরো গেল শিশুমনও। বুকের উপর একফালি তালি দেওয়া ফ্রক পড়তে সে আর চায় না। এখন তার মনেও ধরে আমের কুঁড়ির মতো ছোট-ছোট একঝাঁক বায়না। সোমবারের সাপ্তাহিক লেস-ফিতাওয়ালার থেকে তার ইচ্ছে হয় জবা রঙের লিপস্টিক নিতে; শীতে মাখতে ইচ্ছে হয় ফর্সা হওয়ার ক্রীম। এই শন পাপড়ি খেতে ইচ্ছে হয় তো এই চালতা, জলপাই, বড়ই’র আচার। ইচ্ছের প্রজাপতি রঙের বাহার! ইদ এলে লাচ্ছা সেমাই তার চাই, হাঁসের ডিমগুলো চাই, নুডলস চাই... অথচ মাসান্তরে ছেঁড়া ফ্রকে আরেকটা তালি নিজহাতে লাগাতে হয়। মেয়ে ডাঙর হলে এসব শিখতে হয়; এই শিক্ষা তাকে মা-চাচি সকলে দিয়েছে। মা অবশ্য এগিয়েছে আরো। পাশের বাড়ির ছোট বউয়ের থেকে একটা ওড়না চেয়ে এনেছে। ছোট বউ নিতান্ত ভালো; মাস গেলে কর্তাকে বলে একটা নতুন জুটিয়ে দেবে বলেছে। মেয়ে ডাঙর হচ্ছে। এখন থেকেই পর্দা শিখুক—সাথে তালিও ঢাকুক দুটোই চায় মা। এই আমাদের বাঙলা মা, সঙ সেজে সংসার করে না!

ভাতের সাথে কচুভর্তা মেখে লেবুর রসে ইফতার সারলেও তা বড় রসের বিষয় হয় না। সে বিষয়ে বরঞ্চ খেয়ালও দেওয়া যায় না। কেননা রমজান নাজাতের দরজায়। আর মাত্র দিন দশ গেলে সে-ও যাবে। কিন্তু ইদ বছরে একদিন। একমাত্র আনন্দের দিন। গরিবের মনে পুষে রাখা একটি ভালো থাকার দিন। মা লুৎফরকে বলে গেলো—বৎসরের একটা দিন। আমি বুড়া মানুষ, তয় তোর বোন... সে জেদ ধরেছে নতুন জামার। তোরে কওয়ার সাহস ও পায় না। দেখিস আনতে পারস কি-না। ছয়ডা ডিম জমাইছিলো; তা-ও কুত্তায় নিলো...

লুৎফর তারাবীহতে যায়। বিশ রাকাআত সে পড়ে না। আট রাকাআত পড়েই বের হয়; ছোটবেলাকার অভ্যাস এটা। কেউ তাকে বাকি বারো রাকাআতের সুফল জানায়নি, সে-ও জানে না। মসজিদ প্রায় খালপাড়ে। বড় বাড়ি জামে মসজিদ। আম্বিয়াদের বড় বাড়ি। সে আম্বিয়াদের পাছ-দুয়ার হয়ে রাস্তা ধরে। গ্রামের বাড়ি রাত হলেই দরজা-কপাট লাগানো হয়, বলা চলে সূর্য বিদায় বললেই। তারপর ভরসা চাঁদ। চাঁদের সাথে সহযোগিতার জন্যে গ্রামে সৌরশক্তি নামক সোলার-ব্যাটারির বিদ্যুৎ নগদে এসেছে। কিস্তিতে মিলে যায়। আম্বিয়াদের ঘরের আলগা দুয়ার থেকে আম্বিয়ার চাঁদমুখখানিও দেখতে পাওয়া যায় এই সৌরশক্তির আলোয়। বড় বাড়িতে সবশেষে আম্বিয়াদের সদর দরজায়ই খিল লাগে। খিল লাগে লুৎফর রাস্তায় পড়লেই। পাছ-দুয়ার পার করলেই কপাট লাগানোর শব্দ লুৎফরকে পুলকিত করে, আশান্বিত করে। একটা ঘোর লাগা স্বপ্ন বাস্তবিক অবসাদকে জয় করে সুখমালা এনে পড়ায় লুৎফরকে। রাত সকাল হয় এই একবাক্য জপে—কেউ তার জন্য দরজা খুলে বসে ছিলো। ইশ!

চাঁদরাত। ইদের চাঁদ; আনন্দের রাত। লুৎফরের জন্য চাঁদরাত হয়েছে কালরাত। দিনে যখন হাট থেকে ফিরছিলো তখন দেখেছে বড় বাড়ির বউয়েরা মিলে উঠান আয়না করেছে, ঘরদোর ঝাড়া দিয়ে তাড়া করেছে মাকড়সা—একদম জাল-পালসহ। তার বদলে শোভা পাচ্ছিলো মাকড়সার মতো চকচকে রঙের ফতুয়া-ফ্রকের মেহমানের উঁকিঝুঁকি। এশায় মসজিদে দেখা গেল ক’ঝাঁক শুভ্র মার করা পাঞ্জাবি-ফতুয়াওয়ালাকে, সবার মাথায় টুপি থাকলেও আনকোরা এক যুবকের মাথায় টোপরও ছিলো। যুবকের বকের মতো লম্বা গলা, রঙ বকফর্সা! চিকন হলেও লম্বা চুলে মানানসই। রাজকুমার কী বককুমারের মতোন! 
লুৎফর আন্দাজ করছিলো প্রতিবেশী কোন মেয়ের বিয়ে। কিন্তু বিয়ে কি রাতে হয়? হলে কী! আরো রমজান মাস, দিনে বিয়ে হলে মিষ্টিমুখ ছাড়াই অতিথিদের ফিরতে হতো। কিন্তু বিয়ে কার?—মাত্র তিনদিন সে খালপাড়ের টঙে ছিলো। ভ্যাসাল তুলেছে ঘন্টা দু’তিন পরপর। শরীফার জামা কেনার পন মনে-মনে ক্ষণেক্ষণে ধারণ করেছে। অথচ এরমধ্যে কি-না কোন মেয়ের ঠিকানা পরিবর্তন হতে চললো! সে যাইহোক জামা হয়নি শরীফার। হবে কী করে? কৈ, চ্যাঙ, বাইম ছাড়া মিলেছে কী! ইদের বাজারে এর দাম তলানিতে। বছরের একটা দিন সবাই-ই কমবেশি ভালোমন্দ খেতে চায়। তবু বিক্রি হলো। যা দাম পাওয়া গেলো তা গেলো মুদির দাম মেটাতে। চাল-ডাল-আলুতে। কাল ইদে মা হয়তো চাল-ডাল-আলুর খিচুড়ি বানাবে, ডিম ভাঁজবে। লাচ্ছা সেমাই, নুডলস অবশ্য কেনা গেছে; নিশ্চয়ই হাঁসের ডিমও জমেছে। কেবল শরীফার জামা...

এমন দিনে লুৎফরের মন খারাপ থাকাই নিয়ম। বাইরে গেলে নবীন আনন্দবাহন চাঁদকে দেখিয়ে, চাঁদরাতকে দেখিয়ে কাঁদতে হবে—তাতে তার মান যাবে; চাঁদের এহেন অপমানের কথা ভেবে সে বাইরে বেরোয় না। উপস্থিত মুসল্লী হিসেবে উপস্থিত দাওয়াতও পেল। হুজুর ডাকলো মেয়ের বাবাকে; উঠলেন কি-না আম্বিয়ার বাবা। লোকটার আহাম্মকি আচার-অনুষ্ঠান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে দেখে হাসি পায় লুৎফরের। মনে পড়ে ছোটবেলার গল্প। লুৎফর তখন পাড়ায়-পাড়ায় মারবেল খেলে বেড়ায়। সেদিনও জামতলায় খেলছিলো। পুলিশ আসছে দেখে লোকটার সে কী দৌঁড়! সে দৌঁড়ায়—পিছনে পুলিশ দৌঁড়ায়। পুলিশ ঘাম ঝরিয়ে কলার চাপবার পরে জানা গেলো সে দৌঁড়েছে ভয়ে; অপরাধী অন্য কেউ। ভেতর থেকে তৈরি হতে থাকা আর বাইরে থেকে দমন করতে থাকা হাসির তোড় লুৎফরের প্রত্যেকটা অঙ্গকে নাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তা নিমেষে মিলিয়ে যায় কাজীর বয়ানে, “বড় বাড়ি নিবাসী আসমত মিয়ার বড় কন্যা আম্বিয়ার সাথে...” লুৎফর কতক্ষণ পাথর থাকে। তারপর বৈশাখের বর্ষার মতো ঝুম করে ছোড়ে তার উচ্চহাস্য। হুট করে ছুট দেয় দরজার দিকে। লোকজন চোখ চাওয়াচাওয়ি করে। মিষ্টির দাওয়াত মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু লুৎফর চলে একাকী শালিকের মতো। বধির ভিখারির মতো!

কখন ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই। অনেকদিন পরে ভালো ঘুম হয়েছে। ঘুমের ঘোর এখনো ঘুরছে শরীরজুড়ে। মায়ের ডাকে আন্দাজ করলো এখন ভোর। ইদের ভোর। আজ সে খালে ভ্যাসাল তুলতে যাবে না তাতো মা জানে; তবুও একের পর এক ডাকছে কেন?
লুৎফর বিরক্ত হয়। চোখেমুখে বালিশ চেপে ঘুমাতে চেষ্টা করে। রাতের ঘটনা মনে উঁকি মারার চেষ্টা করায় বিরস মুখে উঠে বসে। পুকুর ঘাটে হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখে মা স্টিলের নতুন বাটিটায়, যেটা পুরনো হাঁড়িটা বেঁচে শরীফা কিনেছিলো, সেটায় সেমাই বেড়ে এনেছে। এসে বললো—তুই গোসল করবি না? শরীর খারাপ? যা, গিয়ে গোসল করে বাক্স থেকে সাদা পাঞ্জাবি পড়ে নামাজে যা। সময় তো যায়যায়!

ফজরতো ঘুমেই ওজর। এখন কীসের নামাজ?—প্রশ্ন চোখে তাকাতেই মুয়াজ্জিনের ইদ মোবারক অভিবাদন কানে আসে। ইদের নামাজ! বাবার সাথে শৈশবের দিনগুলো মনে পরে... 
গোসল আর করে না। জামাও বদলায় না। দরকার কী? ঐ সাদা পাঞ্জাবিরও যে এক হাল; ছেঁড়া পাল!

নামাজ শেষে সবাই সবার সাথে কোলাকুলি করে। বাঙালি মুসলমানের এ ঐতিহ্য। লুৎফরের বুক লাগে শূন্য। সে এই কোলাহল এড়াতে খালের দিকে হাঁটে। কী ভেবে যেন ভ্যাসালের দিকে যায়। যদিও আজ জলছুটি, তবুও ভ্যাসাল তুলতে উদ্যত হয়। কৈ, চ্যাঙ উঠলে ছেড়ে দিবে। ছেড়ে দেওয়াটারও একটা নাম ভেবে রেখেছে—ইদমুক্তি! ভ্যাসাল তুলতেই তোলপাড় ওঠে। কোন জন্তু বেঁধেছে হয়তো; গুইল-বেজি হবে ভেবে যেই ভ্যাসাল ছাড়তে যাবে তখন চোখ চকচক করে ওঠে। বয়সের অর্ধেক গেলো এর সন্ধানে-সন্ধানে, সোনাখুঁজিয়েরা যেমন সোনা চেনে—জেলেরাও তেমন রূপারঙ জ্যান্ত সোনাকে ভালোভাবেই চেনে। অভ্যাসবশত মুগুর নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। একটা-দুইটা না, একেবারে চারটা। চারটা রূপারঙ সোনা। লুৎফর বিশ্বাস করতে পারে না, নিজেকে চিমটি কেটে দেখে! মোটেও স্বপ্ন না—একেবারে জলের মতো সত্যি, জীবনের মতো সত্যি। চার-চারটে চারহাতের জ্যান্ত বোয়াল।

গ্রামে পরিচিতি পেতে হলে হয় জেলে যাও নয় বোয়াল পাও। এগুলো আদি কার্যকরী পন্থা। কান থেকে কানে কানাকানি হয়ে জন থেকে জনে জানাজানি হয়ে যায়। মাছগুলো বাজারে নিয়ে যাওয়াতে বেশ চাঞ্চল্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শহর থেকে চাকুরিজীবীরা এসেছে বটে; তবে এই মাছ ক্রয় তাদের সাধ্যসীমানাও পেড়িয়ে যায়। লুৎফর এ গল্প জানে, সমাধানও জানে। বাবার থেকে শিখেছিলো। প্রত্যেকটা মাছকে চার-টুকরা করে চারটি মাছকে মোট ষোলো টুকরা করে। চৌদ্দ টুকরা দুপুর গড়াবার আগেই বিক্রি হয়। ক্রেতা থাকলেও বাকি দু’টুকরা সে বেঁচে না। এগুলো ঘরে নেবে, মা কষিয়ে রাঁধবে। ইদ ইদের মতো মনে হবে।

বাড়ি রওনা হওয়ার আগে সে রওনা হয় শহরে। একটা ফ্রক, একটা পড়নের শাড়ি কিনবে। নিজের জন্য বককুমারের মতোন একটা পাঞ্জাবি কিনবে। গ্রামের মেঠো পথে চলতে আরম্ভ করলো ভ্যান। বাজার থেকে খালপাড় হয়ে বাড়ির ঠিক আগেই বাঁক নিয়ে পড়বে বড় রাস্তায়। ভ্যানওয়ালা চাচা বিরহীকন্ঠে মনাঘাত করার সুরে গান গাইছে—
“মন আমার জাইলা মাঝি পাইতাছে জাল ভবের বিলে,
দিনে দিনে মাছগুলো তার খাইলো রে কোন নিঠুর চিলে!”

বড় রাস্তার মোড়ে ভ্যান আগলে দাড়ালো বোরকা পড়া এক মেয়ে। চোখও তার ঢাকা। হাতে ব্যাগ। ভ্যান থামালে মেয়েটি উঠে ভ্যানে না বসে চেপে ধরলো লুৎফরের হাত। কানে কানে কী বললো জানি না, লুৎফর নেমে পড়লো।

দু’টুকরো মাছ, দুটো কাপড় ঘরে ফিরলেও ফেরেনি লুৎফর। ওদিকে আসমত মিয়ার মেয়ে বাসর রাতে বাথরুমে যাওয়ার কথা বলে বেরিয়ে কোথায় গিয়েছে; খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জোর গুজব শোনা যাচ্ছে!