গালিভার চতুর্থ ভূমি থেকে বের হয়ে অনকদিন আটকে রইলে নিজের কামরায়। হুউনিমের আদর্শ বারবার পীড়া দিতে থাকে।
সেদিন আবার ঝড়ের রাত। একটা কাটাশূণ্য কম্পাস হাতে বেরিয়ে পড়লেন গালিভার। গন্তব্য অজনা। ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে সে নতুন ভূমিতে নিজের আধিপত্য দেখতে ব্যস্ত। জাহাজ ঘুরছে, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস চলতে চলতে দ্বীপ পেড়িয়ে একটা মূল ভূমিতে গালিভারের জাহার ভিড়লো।
গালিভার অবাক! ঠিক তার নিজের দেশের মতই একটা ভূমিতে এসে পড়েছে। এবার আর আগের চারটার মতো কোনো অতিপ্রাকৃত বিষয়াবলি নেই। কয়েকজন তরুণের সাথে সপ্তাহ খানেক কাটানোর পর আস্তে আস্তে অনেককিছুই জেনে গেলো গালিভার। গালিভারের ডায়েরির পাতার লিখা থেকে,
"তাহাদিগের ভূমির নাম তাহাদিগের ভাষার নামেই। ভাষার উৎকৃষ্টতা দ্রষ্টব্য, এবং তাহারা ভাষার লাগি বেশ রক্ত দান করিয়াছে। তাহাদের ভূমিতে তাহারা বারবার পদতলিত হইয়াছে বিভিন্ন শাসক দ্বারা। অবশেষে বীরদের বীরদর্পে তাহার চিনিয়ে আনিয়াছিলে তাহাদের স্বাধীনতা। কিন্তু, তাহাদের জনগণ বর্তমান অবস্থায় খুশি নহে। বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীই সেই দাদার আমলের দাপটে বাঁচতে চায়। যেকোনো তর্কে, বিতর্কে, প্রশ্নত্তোরে তাহারা স্ট্রম্যান ফ্যালাসি প্রয়োগ করে।
আমি একজনকে জিগ্যেস করিলাম, আপনারা রুটি কেনো খান না। প্রতিউত্তরে আমি পেলাম, "আমরা ভাতে মাছে বাঙ্গালী। আমাদের ভাতের ইতিহাস অনেকদিনের। আমরাই একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্যে রক্ত দিয়েছি। আমরা স্বাধীনতা আনতে রক্তের হিসেবে সবচেয়ে বেশি রক্তদাতা।"
আমি থ হয়ে রইলাম!
তাহাদের এখানে শাসক পরিবর্তন হয় না। উত্তরাধিকার সূত্রে তাহারা বসে পড়েন গদিতে। তাহাদিগের পিতা, প্রপিতার নাম ভাঙ্গিয়ে চলে যায় যুগের পর যুগ। আপনি তাহাদের কোনো ছাপোষা কর্মচারীর দিকেও যদি আঙুল তুলেন, তাহলে তারা বলিবে, "আমি আমার উপর আঙুল তুলেছেন। আর আমি দেশের একজন কর্তা। তাই প্রমাণ হয় আপনি দেশের উপর আঙুল তুলেছেন। আপনি স্বাধীনতা বিরুদ্ধে। আপনার বাবা দাদারাও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে।"
এখানে আসিলে বুঝিতে পারা যায় জাতীয়তাবাদ কতোটা ভয়ঙ্কর হইতে পারে। অমর্ত্য সেন নামক একজন বিখ্যাত পন্ডিত ব্যক্তির নাম শুনিলাম। তাহার কিছু লিখাও পড়িয়াছি। তিনি একদা এক লিখায় জাতীয়তাবাদ অভিশাপ নাকি আশির্বাদ তা নিয়ে লিখেছেন। তবে, এই ভাষা ভিত্তিক ভূমিকে জাতীয়তাবাদ আশির্বাদ হইলেও তা এখন অভিশাপ হইয়া উঠিতেছে। যে জাতীয়তাবাদের পিঠে তাহাদিগের আগের বাবা দাদারা স্বাধীনতা চিনিয়ে আমিয়াছিলো, সেই একই জাতীয়তাবাদ বিক্রি করিয়া তাহারা এখন মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করিতেছে।
এই ভূমিতে সকল শক্তির অধিকারী দেশের প্রধান। তাহাদের সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত অসীম ক্ষমতাসীন এই ব্যক্তির একা সিদ্ধান্তেই সবকিছু চলিতে থাকে। জনমতকে তিনি গ্রাহ্য করেন না। কারণ, তিনি মনে করেন জনমতকে প্রাধান্য দিলে জনগণ মাথায় উঠিয়া নাচিতে পারে। তাছাড়া, সাধারণ জনগণ যারা নিম্নভূমিতে আছে তাহাদের সিদ্ধান্ত, মতামত ছাড়াই শাসকদের গদি চলিতেছিল এবং চলিতেছে।
এবার সবচেয়ে দ্রষ্টব্য তাহাদের ভূমির বাসস্থান নিয়ে বলি। তাহাদের ভূমি মূলত তিনভাগে বিভক্ত। একদম নিম্নভাগ যা পানি দ্বারা বেষ্টিত হয়ে পুরো ভূমির সিংহভাগ। সেখানে যাহারা বসবাস করে তাহাদের ডাকা হয় 'আম'। তাহারা জন্মের ভিত্তিতে এখানেই জন্মে এবং মরিয়া যায়। তাহাদের কোনো সিদ্ধান্ত, মতামত কোথাও কখনও গৃহিত হয় না। তাহারা অনেকেই জানেও না তাহাদের জন্মের উদ্দেশ্য কীসের। শুধু ভূমির কঠোর পরিশ্রম জনিত কাজে তাহাদের ব্যবহার নিরেট শ্রমিকের মতোই।
মধ্যভাগে আসে তাহাদের আমলার এবং বিভিন্ন ক্ষমতার অধিকারীরা। বংশসুত্রে যাহারা বিভিন্ন নেতা নেত্রীর আত্মীয় হয় তাহাদিগের জন্যে এই ভাগ। বিভিন্নরকম সুবিধার অঢেল ভান্ডার। কোনো 'আমের' ভাষায় ইহাকেই তাহাদিগের পবিত্র গ্রন্থের 'আদর্শ ভূমি' বলা হইয়াছে। যাহাদের দাদা, নানা, প্রপিতামহরা দেশের মুক্তির তরে লড়াই করিয়াছিল, তাহাদের জন্য এই ভূমি। বংশপরম্পরায় যতদিন ভূমি আছে ততদিন তাহারা সেই সুবিধা ভোগ করিতে পারিবে। আর আমলারা যারা দেশের সুনাগরিক তাহাদের প্রধান উদ্দেশ্য তাহাদিগের প্রধানের সকল কথা বাস্তবায়ন করা এবং তাহার আধিপত্য বজায় রাখা।
একদম উচ্চস্তরে স্বয়ং শাসক গোষ্ঠী। নিম্নভূমি থেকে সেই উঁচুস্থানকে অনেকে 'অন্তিম আর্দশ মন্দির' বলে। সেখানে যাওয়ার কেউ স্বপ্নও দেখিতে পারে না। শুধু ঈশ্বরের নিকট দুয়া করিতে পারে যদি পরজন্ম বলিয়া কিছু থাকে তাহলে যেনো সেইখানে তাহার জন্ম হয়। আদর্শ মন্দিরে প্রধানের বসবাস। তিনি সেইখান থেকে যাহা বলিতে চান তাহা বলিয়া দেন। আর মধ্যভাগের আদর্শ ভূমিতে থাকা সুবিধাজনক ব্যক্তিবর্গরা কড়তালি দিয়া সেই বক্তৃতা সাদুবাদ জানান।"
গালিভার এইটুকু লিখে থামিয়া গেলে। নদীর পাড় যাইতে প্রথা নামের এক অতি সুন্দর এবং চৌকস মেয়ে তাহাকে আমন্ত্রণ জানাইলো। গালিভার পাড়ে বসিয়া পূর্ণিমা দেখিতে দেখিতে প্রশ্ন করিলে, "তোমরা আমার নৌকায় উঠিতেছো না কেনো?
প্রথা বলিল, এই কাস্তিকে আমরা পবিত্র মানি। তাই তাহাতে আমরা পা দিতে পারিব না।
গালিভার পুনরায় জিগ্যেস করিলো, এই গল্পটা কেহ আমাকে শুনায়নি তো!
প্রথা বলিল, আরেকদিন শুনিবে। এখন মনস্থির করিয়া পূর্ণিমা দেখো।