পোস্টস

চিন্তা

সরকার কেন পেটাবে, রাষ্ট্রকে কেন বদনামের ভাগীদার করবে?

১৬ জুলাই ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

গতকাল দিনভর এমনকি রাতেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলনরত যেসব শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগের এক্টিভিস্টরা পিটিয়ে জখম করেছে তারা সবাই এদেশের নাগরিক। তাদের সবার নামেই NID কার্ড আছে। তারা বহিরাগত কেউ না। এমনকি বাইরের কেউও যদি আমার দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি রণহুঙ্কার দেয় সেই রণে সারা দিলেও জেনেভা কনভেনশন ও জাতিসংঘের বিধিবিধানের প্রতি মান্যতা দিতে হয়।

ছাত্রলীগ যা করেছে তা না টিকবে আন্তর্জাতিক আইনে, 
না জাস্টিফাইড হবে দেশের সংবিধানে। প্রতিবাদ করবার স্বাধীনতা সংবিধানে সংরক্ষিত। শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যদি ছাত্রলীগকেই দিতে হয় তাহলে এই রাষ্ট্রের পুলিশ, এপিবিএন বা আনসারের কী কাজ? সরকার কেন পেটাবে? রাষ্ট্রের কেন বদনাম হবে?

শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে রা'জাকার দাবি করছে এর দায়ভার ছাত্রদের ওপর না চাপিয়ে সরকারকেই সবার আগে নিজেদের বোধ ও বিবেকে ফিরতে হবে। ক্ষমতাসীন দল পরিবেশিত মুক্তিযুদ্ধের Cognition এ দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখন আর আস্থাশীল নয়। কারণ এটার যথেচ্ছাচার ও অতি ব্যবহারে কচলানো লেবুর মতো তেতো বানিয়ে ফেলা হয়েছে।

সাধারণ শিক্ষার্থীরা তীব্র আবেগ ও গোস্যা থেকে নিজেদেরকে রা'জাকার বলেছে বলে আওয়ামী লীগের খুব লেগেছে না? কিন্তু আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর লোকেরা যখন ওই রা'জাকারদের সাথে মিলেমিশে মাফিয়াগিরি করে, লুটপাট করে, আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে, গণহারে নিজেদের দলে জায়গা করে দেয়; তখন কারো টনক নড়ে না, অনুভূতি জাগে না?

আমরা নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি ও সহমর্মিতা জানাই। ছাত্রলীগের অনধিকার অ্যাক্টিভিটির নিন্দা করি। নারীর প্রতি সভ্যতাবিরোধী সহিংসতা ও নিপীড়ন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নির্যাতিতের মধ্যে আমার কন্যারাও থাকতে পারত।

ক্ষমতাসীন সরকার বৃক্ষের গোড়া কেটে আগায় জল ঢালবার প্রয়াস পাচ্ছে। তারা ১৫ লাখ সরকারি চাকুরির জন্য ১৮ কোটি মানুষকে জিম্মি ও মোহগ্রস্ত করে রেখেছে। শিক্ষার্থীরা দেখছে একজন সরকারি পিয়ন বা চাপরাশিরও যে ঠাটবাট তাতে জীবন দিয়ে হলেও সরকারি চাকরি বাগাতে হবে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আমি দোষ দেই না। সরকারি কর্ণধারেরাই এই ফাঁদটি পেতে রেখেছে।

শিক্ষার্থীরা কেন ইনডিপেনডেন্ট গবেষক, উদ্যোক্তা, প্রজ্ঞাবান কৃষক, সেবাপরায়ণ চিকিৎসক বা স্বাধীন শিক্ষক-আর্কিটেক্ট এবং নিঃস্বার্থ পলিটিশান হতে চাইবে না? প্রতি বছর ক্যাডার সার্ভিসে লোক নেয়া হবে মাত্র তিন হাজার জন। এই মুষ্টিমেয় জবের জন্য লাখো প্রার্থী কেন উন্মুখ ও মরিয়া হয়ে যাবে। কেন শিক্ষার্থীদের সামনে ভিন্নতর ও বহুমুখী স্বপ্নের দুয়ার খোলা রাখা হয় না? এসবের জবাব আগে দিয়ে তারপর প্রটেস্টারদের দমন করবার কথা কল্পনা করবেন।

স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস ২০২১ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। তাদের মধ্যে নারী ৪ লাখ ৪ হাজার ৫৯১ জন, যা মোট চাকরিজীবীর প্রায় ২৬ শতাংশ। ২০১০ সালে নারী চাকরিজীবীর সংখ্যা ছিল ২১ শতাংশ।

বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদপ্তরের শূন্য পদ ৩ লাখ ৫৮ হাজার ১২৫টি।

এর মধ্যে ১ম শ্রেণীর পদ ৪৩ হাজার ৩৩৬টি, দ্বিতীয় শ্রেণীর ৪০ হাজার ৫৬১, তৃতীয় শ্রেণীর ১ লাখ ৫১ হাজার ৫৪৮ এবং চতুর্থ শ্রেণীর শূন্য পদ ১ লাখ ২২ হাজার ৬৮০টি।

৪০তম বিসিএসে ১ হাজার ৯২৯ জন নিয়োগ করা হয়েছে। ৪২তম বিশেষ বিসিএসে (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে ৩ হাজার ৯৬৬টি সহকারী সার্জন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

দ্বিতীয় শ্রেণীর ১০-১৩তম পদের নিয়োগ পিএসসির মাধ্যমে হয়ে থাকে। ১৪ থেকে ২০তম গ্রেডের নিয়োগ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, সংস্থার নিয়োগবিধি অনুযায়ী হয়।

মোটের ওপর এই হলো বাংলাদেশে সরকারি চাকরির পরিসংখ্যানগত বাস্তব অবস্থা। এত কম চাকরি তাও আবার ৫৬ ভাগ রাখা হয়েছে বিভিন্ন কোটা। নিয়োগ প্রক্রিয়াও অগণন দুর্নীতি আর ঘুষে ভরা। তাহলে কোটার বাইরের সাধারণ প্রার্থীদের জায়গা কোথায়?

সব বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ন্যায্য এটা মেনে নিয়ে আর এতটুকু বলপ্রয়োগ না করে, দমনপীড়ন না করে আলোচনার মাধ্যমে কোটা সংস্কারের দাবি জানাই। আর তা না পারলে খামোখা মসনদ আঁকড়ে রাখবার কোনো মানে নেই।

এতটুকু বৈষম্য জিইয়ে রাখবার নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়। দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধারা কিঞ্চিত আত্মস্বার্থনিমগ্ন হয়েও যুদ্ধে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেন নাই। শুভবোধের জন্য ত্যাগ এবং সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়াই তাদের একমাত্র প্রতীতি ছিল। আমরা এমন বীরদের আজীবন বন্দনা করে যাবো। নিরঙ্কুশ সাধুতায় মোড়ানো ওই বীরত্বের আলোয় এইসময়ের নতুন প্রজন্মকে আলোকিত করবার দাবি জানাই।

লেখক: সাংবাদিক 
১৬ জুলাই ২০২৪