আমরা যারা শৃগাল, নেংটি ইঁদুর কিংবা উইপোকা হয়ে গর্তে লুকিয়ে আছি, নিজের গায়ে নোংরা লাগছে না বলে চুপচাপ থাকব বলে ধনুর্ভঙ্গ পণ করেছি, সকল অন্যায় অত্যাচার মুখবুজে সহ্য করে যাব বলে স্থির করে আছি, নড়বড়ে মেরুদন্ড আর দুর্বল চিত্ত নিয়ে সবকিছু না দেখার ভাণ করে আছি। হ্যাঁ এই আমাদের সামনেই ইস্পাত কঠিন মেরুদন্ডের গৌরবময় উদাহরণ উপস্থাপন করে গেলেন আবু সাঈদ। রংপুরের আবু সাঈদের বুক যেন বাংলাদেশের হৃদয়।
একজন আবু সাঈদকে পৃথিবীর আলো বাতাসে বড় করে তুলতে মা, বাবা, ভাই-বোন ও স্বজনেরা যে অবর্ণনীয় ত্যাগ স্বীকার করেছেন। প্রিয় শিক্ষকেরা যত্ন করে পড়িয়ে বিদ্যার প্রতিমূর্তিরূপে গড়ে তুলছিলেন। স্বপ্নের দেশের সকল সুন্দরেরে মাখামাখি করে বেড়ে উঠছিলেন। এক নিমিষে এক গুলিতে সেইসব ত্যাগ ও মহিমার প্রতিদান এইভাবে চুকিয়ে দিতে পারলে হে রাষ্ট্র? নিজের সন্তানেরে নির্বিকারে বলি দেয়ার এমন দুর্মর মতি তোমরা কোথা থেকে কিভাবে রপ্ত করলে? বোধ-বিবেক শিকেয় তুলে এতটা ঘৃণা, আক্রোশ, ক্রোধ, হিংসা জমিয়ে রেখে ভালোমানুষিতার মুখোশ পরে থাকো কিভাবে?
রে রাষ্ট্রের নিয়ন্তা! তোমাদের আর সভ্য বলি কোন মুখে?
ছেলেটির বাবা শতবর্ষী। মা নবতিপর। দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার অন্তিম সময়ে তাদের জীবনে নরক নামিয়ে না দিলে কি চলতই না তোমাদের? শোকাভিভূত বিষন্ন প্রকৃতির অভিশাপ তোমরা বইতে পারবে তো?
বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর যে পুলিশম্যান আবু সাঈদকে গুলি করল, একটিবারের জন্যও তার বুক কাঁপল না? মনের কোনো এক তন্ত্রীতে একটুখানি মায়াও জাগল না? নিজের সন্তান বা ভাইয়ের মুখটি মনে পড়ল না? মানুষকে এতটা নির্মম ও পাষণ্ড হতে আছে?
নিরস্ত্র সাঈদ তো আক্রমণ করতে আসেনি! তোমরা কেন আগ্নেয়াস্ত্র নিশানা করে হায়েনা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে? এ তোমাদের কোন শিক্ষা?
১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। যেন মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনের ৫৫ বছরের পরম্পরা।
একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে গণ-অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক শামসুজ্জোহা এক শিক্ষক সভায় বলেছিলেন, ‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত। এরপর কোনো গুলি হলে তা ছাত্রকে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে।’ ঠিক তার পরদিনই বিক্ষুব্ধ ক্যাম্পাসে ছাত্র মিছিলের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ান তিনি। বুক পেতে নেন ঘাতকের তপ্ত বুলেট। অংশ হয়ে যান সুবর্ণ ইতিহাসের।
অধ্যাপক শামসুজ্জোহার শহীদ হওয়ার ৫৫ বছর পর তাঁর আত্মনিবেদনের সেই বাণীর উদ্ধৃতি দিয়ে নিজের ফেসবুক পাতায় পোস্ট করেছিলেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দ্বাদশ ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তিনি লিখেন, ‘স্যার! এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার, স্যার!
আপনার সমসাময়িক সময়ে যাঁরা ছিলেন, সবাই তো মরে গেছেন, কিন্তু আপনি মরেও অমর। আপনার সমাধি আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা উদ্ভাসিত।
এ প্রজন্মে যাঁরা আছেন, আপনারাও প্রকৃতির নিয়মে একসময় মারা যাবেন। কিন্তু যত দিন বেঁচে আছেন, মেরুদণ্ড নিয়ে বাঁচুন। ন্যায্য দাবিকে সমর্থন জানান, রাস্তায় নামুন, শিক্ষার্থীদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়ান। প্রকৃত সম্মান ও শ্রদ্ধা পাবেন। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন না। আজন্ম বেঁচে থাকবেন শামসুজ্জোহা হয়ে।
আবু সাঈদ আরো লিখেন, 'অন্তত একজন শামসুজ্জোহা হয়ে মরে যাওয়াটা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের।’
ইতিহাসের কী বিস্ময়কর পরম্পরা! আবু সাঈদও তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের পরদিনই আত্ম–উৎসর্গ করলেন বুকে বুলেটের আঘাত নিয়ে। বুঝিয়ে দিলেন, মুক্তিযুদ্ধে একটি দেশ পেলেও গণমানুষের মুক্তির আন্দোলন কাল থেকে কালান্তরেরই এক অনিবার্য চলমান প্রক্রিয়া।
প্রথম আলো জানাচ্ছে, রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে আবু সাঈদের বাড়ি। তাঁর বাবা মকবুল হোসেনের বয়স প্রায় ১০০ বছর। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি নির্বাক স্তব্ধ হয়ে গেছেন। মা মনোয়ারা বেগমের বয়স ৯০ বছরের মতো, তিনিও অসুস্থ। আবু সাঈদ ছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বাবা একসময় দিনমজুরি করতেন। ছয় ভাইয়ের মধ্যে আবু সাঈদ সবার ছোট। সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক এই পরিবারে একমাত্র তিনিই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন।
এমন চাঁদমুখ মহৎপ্রাণ সাহসী ছেলেটিকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিলেই মানুষের সহজাত স্বাধিকার চেতনাকে দমিয়ে রাখা যাবে না। বরং আমজনতার মনে বিপ্লবের যে বারুদটি আবু সাঈদ উপ্ত করে রেখে গেলেন সেটিই যুগে মানবাধিকারের কথা বলবে। জনগণকে সেবার দেয়ার কথা বলে সরকার আসে। সেই জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বতঃসিদ্ধ চাওয়াকে অগ্রাহ্য করবার মওকা তারা কিভাবে পায়? বৈষম্যবিরোধী চলমান আন্দোলন থমকে দিতে সব বন্ধ করে বসে থাকলেই কি বঞ্চনার প্রলয় বন্ধ হবে?
এর আগে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী তালাত মাহমুদকে মোবাইল ফোনে হুমকি দেয় তার একই বিভাগের ছাত্রলীগ কর্মী হৃদয় আহমেদ। হুমকিদাতা স্পষ্ট করে বলেন, ‘আপনার ছেলে কোটা আন্দোলন থেকে সরে না দাঁড়ালে তাঁর লাশ পাবেন।’
তারপর সারাদেশের পরিস্থিতি বিশ্ববাসী দেখল। গণমানুষের অধিকারের কথা বলায় একদিনে ছয়জন তরুণপ্রাণকে দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হলো।
যেকোনো সভ্য রাষ্ট্র হলে এতক্ষণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর সরি বলে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেয়ার কথা। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে তো অমন সভ্যতা ও ভব্যতার ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নাই। তাই এখানকার কর্ণধারেরা আবু সাঈদের মতো তরুণপ্রাণকে প্রকাশ্যে গুলি করবার পরও বুক ফুলিয়ে চলতে পারে, রাগ দেখাতে পারে, জেদ বজায় রাখতে পারে। অথচ আইনপ্রণেতা বা মন্ত্রী হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করেছিলেন রাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে তারা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না।
ক্ষতি অনেক হয়ে গেছে। ছাত্রলীগ অ্যাকটিভিস্টসহ ছয়জন মানুষের প্রাণ গেছে। ছাত্রলীগ বাড়াবাড়ি করায় সব জায়গায় ঘাড়ধাক্কা খাচ্ছে। এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করে শিক্ষার্থীদেরকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়া হয়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে হয়েছে। তারপরও অধিকাংশ জনতার দাবি মেধার মূল্যায়নে কোটা সংস্কারে সরকার গা করল না। সরকার থাকে জনগণকে সেবা ও সাহচর্য দিতে। এমন গোঁয়ার্তুমি করতে নয়। অহমিকা দেখাতে নয়।
এই আধুনিক কালে এসে ৫৬ ভাগ কোটার বৈষম্য জিইয়ে রাখবার কোনো সুসঙ্গত মানে নেই। সংস্কার অতি অবশ্যই জরুরি। তরুণেরা এরচেয়ে বেশি কিছু চায়নি তো! এই কথাগুলো বলতে বলতেই আবু সাঈদ কালের ডাকে সাড়া দিয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন। আবু সাঈদ মেরুদন্ড নিয়ে বাঁচবার আহ্বান জানিয়ে গেছেন সবাইকে। আমরাও তাঁর অন্তিম আহ্বান মাথা পেতে নিয়েছি। ক্রমাগতভাবে নিজেরে অপমানের তরিতে রেখে আপনারা কিভাবে স্বাধীনচেতা মানুষের ভয়াল স্রোতস্বিনী পাড়ি দেবেন জানি না। আজকের অধিকার সচেতন তরুণেরা শিরদাঁড়া সোজাই রাখবে, যাতে মানুষ হিসেবে অকর্মার বিভ্রাট রচনাকারীদের সাথে তফাতটা স্পষ্ট বুঝা যায়।
আপনারা যারা আকাশে ঘর বানিয়ে মাটির ঘাসেদের উপেক্ষা করে কেবলই মেঘেদের মিতালীতে দিন গুজরান করবেন বলে স্থির করে আছেন তারা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণিকার 'মহতের দুঃখ' স্মরণ করতে পারেন:
সূর্য দুঃখ করি বলে নিন্দা শুনি স্বীয়,
কী করিলে হব আমি সকলের প্রিয়।
বিধি কহে, ছাড়ো তবে এ সৌর সমাজ,
দু-চারি জনেরে লয়ে করো ক্ষুদ্র কাজ।
লেখক: সাংবাদিক
১৭ জুলাই ২০২৪