পোস্টস

প্রবন্ধ

যতীন সরকারের সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রত্যাশা এই সময়ের প্রত্যাশা কে ধারণ করে

২৫ জুলাই ২০২৪

এনামূল হক পলাশ

যতীন সরকারের সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রত্যাশা এই সময়ের প্রত্যাশা কে ধারণ করে। স্যারের সর্বশেষ বইটি নিয়ে কিছুটা আলোচনা করতে যাচ্ছি। আমি অধ্যাপক যতীন সরকারকে যতীন স্যার হিসেবে বলছি এই কারণেই যে, তিনি আমাদের সময়ের একজন শিক্ষক এবং আমাদের সময়ে আমরা শিক্ষকদেরকে স্যার হিসেবেই জানি। তিনি তথাকথিত প্রভু মানসিকতার কর্তৃত্ববাদী স্যার নন, বরং তিনি আমাদের গুরু। তিনি আমাদেরকে পথ দেখান। আমরা যা চিন্তা করতে পারিনা সেই চিন্তা আমাদের ভেতরে ঢুকিয়ে দেন। এই বিষয়ে ব্রাজিলীয় ঔপন্যাসিক এবং গীতিকার পাওলো কোয়েলহোর 'বাবা, ছেলে আর নাতিদের জন্য গল্প' থেকে একটি গল্প কোট করতে চাই। গল্পটি হচ্ছে, "যোগী রমন ছিলেন ধনুর্বিদ্যা শিল্পের একজন প্রকৃত গুরু। একদিন সকালে তিনি তার প্রিয় শিষ্যকে নিজের দক্ষতা প্রদর্শন করতে আমন্ত্রণ জানান। 

শিষ্যটি এর আগে এটি একশো বারেরও বেশি দেখেছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে তার গুরুকে মান্য করতো।

তারা মঠের পাশে অরণ্যে ঢুকে গেল। তারপর তারা একটি চমৎকার ওক গাছের কাছে পৌঁছেছিল। রমন তার মাফলারের ভেতরে গুঁজে রাখা একটা গোলাপ ফুল বের করে ওক গাছেটার একটা ডালে স্থাপন করলেন।

তারপর তিনি ব্যাগ খুলে তিনটি জিনিস বের করলেন: মূল্যবান কাঠ দিয়ে তৈরি নিজের চমৎকার ধনুক, একটি তীর আর সূচ দিয়ে লাইলাকের কাজ করা একটি সাদা রুমাল।

যোগী ফুলটি যেখানে স্থাপন করেছিলেন সেখান থেকে একশত পা দূরে অবস্থান করলেন। লক্ষ্যের মুখোমুখি হয়ে তিনি শিষ্যকে রুমাল দিয়ে তার চোখ বেঁধে দিতে বললেন।

শিষ্য তার গুরুর কথা অনুযায়ী কাজটি করল। 

'তুমি আমাকে কতবার ধনুর্বিদ্যার মহৎ ও প্রাচীন খেলার অনুশীলন করতে দেখেছ?' রমন তাকে জিজ্ঞেস করল। 

'প্রতিদিন,' তার শিষ্য উত্তর দিল। 'আর আপনি সবসময় তিনশ পা দূরে থেকে গোলাপকে আঘাত করতে পেরেছেন।'

রুমাল দিয়ে চোখ ঢেকে যোগী রমন তার পা মাটিতে দৃঢ়ভাবে রাখলেন। তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ধনুকের জ্যা টানলেন - ওক গাছের একটি ডালে রাখা গোলাপের দিকে লক্ষ্য করলেন - আর তারপর তীরটি ছেড়ে দিলেন।

তীরটি বাতাসে শিস দিয়ে উঠলো, কিন্তু এটি গাছে আঘাত করেনি। তীরটি লজ্জাজনকভাবে বিস্তৃত ব্যবধানে লক্ষ্য হারিয়েছে। 

'আমি কি লক্ষ্যে আঘাত করেছি?' চোখ থেকে রুমাল সরিয়ে বললেন রমন। 

'না, আপনি পুরোপুরি মিস করেছেন,' শিষ্য উত্তর দিল। 'আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে চিন্তার শক্তি এবং জাদুকরী ক্ষমতা প্রদর্শন করতে যাচ্ছেন।' 

'আমি তোমাকে চিন্তার শক্তি সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ শিখিয়েছি,' রমন উত্তর দিলেন। 'যখন তুমি কিছু চাও শুধুমাত্র তাতেই মনোনিবেশ করো: কখনও এমন লক্ষ্যে আঘাত করো না যা তুমি দেখতে পাও না।'"

আমরা যতীন স্যারের জ্ঞানাশ্রমে যারা নিয়মিত ঢু মারি তারা তার অনুশীলন সম্পর্কে জানি। কিন্তু সবসময় একই পাঠ নিয়ে ঘরে ফিরি না। প্রায় নিয়মিত যতীন স্যারকে পাঠ করি, তাতে কখনো বিরক্ত হই না। তার চিন্তা এবং দর্শন  প্রতিদিন আমাদের কাছে নতুন ভাবে ধরা দেয়। যোগী রমনের মতো তিনি তার নিত্য শিষ্যদের নিত্যনতুন চিন্তা দান করেন।

কথা না বাড়িয়ে আমরা সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রত্যাশা নামক বইটিতে প্রবেশ করি। এই বইটিতে যতীন স্যার মোট ২৪ টি প্রবন্ধ লিখেছেন বা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত প্রবন্ধ এই বইয়ে স্থান পেয়েছে। বইটি পাঠ করলে যতীন সরকারের জীবন দর্শন সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। যতীন সরকার শুধুমাত্র আমাদের শিক্ষকই নন। তিনি এই সময়ের শিক্ষক। তিনি প্রবন্ধে জানিয়েছেন মাস্টারি করতে গিয়ে ক্লাসরুমে ৪৫ মিনিট সময়ের মধ্যে প্রতিটি ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদেরকে শুধুমাত্র পাঠদানই করে গেছেন। ক্লাসরুমে পাঠদানের বাইরে তার নিজস্ব চিন্তা, দর্শন, চেতনাকে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রকাশ করতে পারেননি। সেই চিন্তাগুলি প্রকাশের জন্য তিনি মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন বক্তৃতা এবং লেখালেখি। যতীন সরকার এমনই একজন মানুষ যিনি অসাধারণ বাগ্মিতার জন্য সারাদেশেই জনপ্রিয় বুদ্ধিজীবী। তার ভাষা অত্যন্ত সরল যার মধ্যে কোন মারপ্যাঁচ নেই। তিনি সহজ এবং সরল ভাষায় কঠিন কথাটি বলে দিতে পারেন।

তিনি তার প্রথম প্রবন্ধটিতে সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। এই প্রত্যাশার মধ্যে গভীর একটি প্রশ্ন লুকায়িত আছে। তাহলে কি সংস্কৃতি এখন ঘুমিয়ে আছে? এই প্রশ্নের উত্তর তিনি দিয়েছেন অবলীলায় সাংস্কৃতিক দৈন্যতাকে স্বীকার করে নিয়ে। তিনি লিখেছেন, "সমাজের স্বাভাবিক চর্চা, শিক্ষা ও মানবিক উন্নয়নের যতগুলো পথ আছে, সবই বিচ্ছিন্ন থেকে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সেগুলোকে একত্রিত করে মানবিক মূল্যবোধ ও জীবনবীক্ষার দিকে নিয়ে যেতে আমরা পারছি না। কারণ স্বাধীনতার মূল্যবোধের কথা আমরা শুধু মুখে বলি; কিন্তু স্বাধীনতার মূল্যবোধ আমরা ভুলে গেছি, এমনকি তা থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। স্বাধীনতার সংগ্রামে যে দল নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই দল ক্ষমতায় আসার পরও তা হয়নি। কারণ যেভাবে দলটি চলার কথা ছিল, সেভাবে চলতে পারেনি।"

আমি যখন এই প্রবন্ধটি লিখছি তখন দেশে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি বিদ্যমান। কোটা সংস্কারের আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নিজেদেরকে রাজাকার দাবি করে স্লোগান দিচ্ছে। আমাদের সাংস্কৃতিক দৈন্যতার এর চেয়ে বড় উদাহরণ বোধ হয় আর পাওয়া যাবে না। বিশাল এক সময় জুড়ে বাংলাদেশে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা অনুপস্থিত। মানুষের ভেতর রাজনৈতিক চেতনা নেই। এই সময়ের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করলে যতীন সরকারের এই প্রবন্ধটি প্রাসংগিক হিসেবে ধরা দেয় আমাদের মাঝে। যতীন সরকারের চিন্তা সবসময়ই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে ধারণ করে অগ্রসর হয়। তিনি বিশ্লেষণ করেন দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে। অথচ কী সহজ এবং সরল বয়ানে তিনি অবলীলায় নিজের চিন্তাকে প্রকাশ করতে পারেন। এই বিষয়টি যতীন সরকারকে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের থেকে আলাদা করেছে।

এই গ্রন্থের ২৪ টি প্রবন্ধের মধ্যে সবগুলোই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসংগিক। জাতীয়তাবাদ বিতর্ক,  রবীন্দ্রনাথ, মুক্তবুদ্ধি, সাম্রাজ্যবাদ, সংবাদপত্র ও সাময়িকী, গণতন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, শিক্ষা, লেখালেখি, পুলিশ সহ বিভিন্ন বিষয় তার প্রবন্ধগুলোতে স্থান পেয়েছে। এসব প্রবন্ধে কয়েকজন বিপ্লবীর জীবন, লৌকিক ধর্ম ও মানুষের ধর্ম, বামপন্থীদের উদ্ভ্রান্ত বামাচার, মুক্তির সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং নির্দেশনা দিয়েছেন। মানুষের জীবনের নানারকম দৌড় আছে। এই বিষয়টি তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি। তিনি ব্যক্তিগত দৌড় আর সমষ্টিগত দৌড়কে ব্যখ্যা করেছেন চমৎকার ভাবে। 

এই বইয়ের শেষ প্রবন্ধটিতে গণতন্ত্রের মুক্তধারা ও বাদ-প্রতিবাদে তত্ত্ববোধ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, "স্মরণাতীত কাল থেকেই সমাজের উচ্চমঞ্চের বাতায়নের পাশে অবস্থানরত বিভিন্ন গোষ্ঠীভুক্ত কিছু মানুষ নিজের গোষ্ঠীর কথাকেই একমাত্র সত্যকথা বলে গ্রহণ ও প্রচার করেছে, অন্যপক্ষের কথাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চেয়েছে। অনেক মানুষও পরস্পর বিপরীত দুই পক্ষের এক পক্ষের কথায় কান দিয়েছে, অন্যপক্ষের কথাকে কানে ঢুকতে দেয়নি। এ রকম কোনো মানুষ কোনো দিনই সত্যের সমীপবর্তী হতে পারেনি, মিথ্যার আবর্তেই তাকে ঘুরপাক খেতে হয়েছে। তবে সবাই সেই আবর্তে পড়ে যায়নি। যারা পড়ে গেছে, তারাও সবাই সেখানে আটকে থাকেনি; অনেকেই কান খাড়া করে সকল মহলের কথা শুনেছে, সেসব কথার বিচার-বিশ্লেষণ করেছে, ত্যাজ্যকে ত্যাগ ও গ্রাহ্যকে গ্রহণ করে সত্যের কিরণে স্নাত হয়েছে।"

একই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুক্তধারা নাটকের ধনঞ্জয় বৈরাগীর চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন। ধনঞ্জয়ের মুখ দিয়ে উচ্চারিত বিখ্যাত উক্তি- 'পৃথিবীতে কোনো একলা মানুষই এক নয়, সে অর্ধেক। আর একজনের সঙ্গে মিল হলেই তবে সে ঐক্য পায়।' এই উক্তিকে ব্যখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, "এই ঐক্য বা সমষ্টিবদ্ধতাই গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি। জনগণের সেই প্রাণশক্তিকে রুদ্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে রাজশক্তি যখন নিপীড়ন চালিয়ে প্রজাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুলেছিল, তখনই সকল প্রজাকে রাজা হয়ে উঠবার ডাক দিয়ে ধনঞ্জয় বৈরাগী বলেছিল-'রাজত্ব একলা যদি রাজারই হয়, প্রজার না হয়, তা হলে সেই খোঁড়া রাজত্বের লাফানি দেখে তোরা চমকে উঠতে পারিস কিন্তু দেবতার চোখে জল আসে। ওরে রাজার খাতিরেই রাজত্ব দাবি করতে হবে।' ধনঞ্জয়ের এই একান্ত ব্যঞ্জনাগর্ভ ও অপরিসীম তাৎপর্যসহ বক্তব্যের পরিপূরক বক্তব্যই উঠে এসেছে নাটকের আরেকটি চরিত্রের (উত্তরকূট রাজ্যের মন্ত্রীর) মুখে- 'রাজকার্যে ছোটোদের অবজ্ঞা করতে নেই। মনে রাখবেন, যখন অসহ্য হয়, তখন দুঃখের জোরে ছোটোরা বড়োদের ছাড়িয়ে বড়ো হয়ে ওঠে।হ্যাঁ, সব যুগে ও সব রাজ্যেই 'ছোটোদের' অর্থাৎ সবার পিছে সবার নিচে পড়ে থাকা দুঃখজর্জরিত প্রজাদের এমন জাগরণ ঘটে যায় যে তারা রাজত্ব দাবি করে বসে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রজাদেরও যে এমন জাগরণ ঘটবে না-তাই-বা বলি কেমন করে?"      

সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রত্যাশা নামের বইটিতে 'আমার জীবনদর্শন' নামে একটি প্রবন্ধ রয়েছে। এই প্রবন্ধটি পুনপাঠের মাধ্যমে যতীন সরকারের জীবন দর্শন আবিষ্কারের চেষ্টা করা যেতে পারে। তিনি এই প্রবন্ধে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন এভাবে, "আমি দারিদ্র্যের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছি। আমি জানি, ব্যক্তিগতভাবে দারিদ্র্য দূর করা যায় না। এই বিষয়ে আমি শুরু থেকেই সচেতন ছিলাম। তাই পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য নির্মূলের যে দর্শন সেটাকেই আমি জীবনদর্শন রূপে গ্রহণ করেছি। কথায় ও কাজে এই দর্শনেরই প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করেছি এবং করছি। আমি মনে করি, সমাজতন্ত্র ছাড়া মানুষের মুক্তি অসম্ভব। সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি ছাড়া পৃথিবীতে শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে না। তবে আগামীর সময় ও সমাজ নির্ধারণ করে দেবে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের রূপ ও প্রকৃতি। "

তিনি মনে করেন মানুষের সার্বিক মুক্তির লড়াই হচ্ছে প্রকৃত লড়াই। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্যে লুকায়িত আছে উন্নত মানুষের সভ্যতার চাবিকাঠি। তিনি ভারতীয় সাধু বা সুফির দর্শনের বিজ্ঞান ভিত্তিক রূপের প্রতিচ্ছবি। জীবনকে ব্যখ্যা করেন বস্তুবাদী দৃষ্টিতে। সাধু সন্তুর সাথে হয়তো বস্তুবাদ যায় না, কিন্তু যতীন স্যার আপাদমস্তক একজন সাম্প্রয়িকতাবিরোধী চেতনার একজন মানুষ। তাকে অসাম্প্রদায়িক বলা যাবেনা, কারণ তিনি তার জীবন দর্শন এবং লেখায় অন্যান্য বস্তুবাদীদের মতো সম্প্রদায়কে অস্বীকার করেন নি। সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব স্বীকার করে ঘৃন্য সাম্প্রদায়িক মৌলবাদকে অস্বীকার করেছেন। এখানেই একজন যতীন সরকারের বিশেষত্ব।