পোস্টস

চিন্তা

সহিংসতা ও গুলি: এটা কোন নিয়ম?

২৭ জুলাই ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস



জন অসন্তোষ কমবেশি পৃথিবীর সব দেশেই আছে। কিন্তু কোন দেশে এমনটা আছে যে সংক্ষুদ্ধ জনগণ প্রথমেই হামলা করে ধ্বংস করে রাষ্ট্রীয় স্থাপনা এবং সেই অসন্তোষ দমন করতে নির্বিচারে গুলি চালায় রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা বাহিনী? এটি যে আমাদের দেশটাই হবে, এর সবিশেষ ও সর্বশেষ উদাহরণ হলো বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন। গুলির কারণে এত মৃত্যু! আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এর ব্যাখ্যা কি আমরা তার কিছুই জানি না। 

বাংলাদেশের সহিংস ও সংক্ষুদ্ধ মানুষ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করতে ভুলে গেছে। সরকারও আন্দোলনকারীদের ওপর সর্বোচ্চ সহনশীলতা দেখাতে পারছে না। কেউ কাউকে আর গুণছেই না। 

কোটা আন্দোলনকেন্দ্রিক সহিংসতায় মারা গেছেন দুই শতাধিক প্রাণ। পেটে, বুকে, হাতে, পায়ে গুলি নিয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে কয়েকশত মানুষ। ছররা গুলিতে চোখ খুইয়েছেন হাজারো মানুষ। দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা নিয়েই জীবন কাটাতে হবে তাদের। 

খুব দুঃখজনকভাবে আন্দোলনে যাদের ন্যূনতম সম্পৃক্ততা নেই এমন কয়েকজন কোমলমতি শিশুও প্রাণ হারিয়েছে চলতি আন্দোলনে। ওইসব পরিবারে নেমে এসেছে শোকের অমানিশা। 

২৪ জুলাই ২০২৪ তারিখের প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠার খবর থেকে জানা যাচ্ছে, মিরপুরের সংঘর্ষে জানালায় দাঁড়াতেই গুলি এসে কেড়ে নিল শিশু সামিরের প্রাণ। ১৯ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে মিরপুরের কাফরুল থানার সামনের সড়কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশের কাঁদানে গ্যাস থেকে বাঁচতে জানালা বন্ধ করতে গেলে জানালার বাইরে থেকে আসা গুলিতে বিদ্ধ হয় শিশুটি। গুলিটি তার চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে যায়। 

এরপর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেলে বড় বিপাকে পড়ে শিশুটির পরিবার। এলাকার মানুষজন শিশুর মরদেহ নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল করতে চান। অপরদিকে স্থানীয় থানার পুলিশ এসে কাগজ ধরিয়ে দেন স্বাক্ষর দিতে। কাগজে লেখা ছিল, 'এ ঘটনায় আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি মামলা করতে চাই না। আমি আমার ছেলের লাশ নিয়ে দাফন করতে চলে যাব।' শিশুটির বাবা সাকিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আমরা সরকারবিরোধী কোনো কাজ করিনি। প্রশাসনের নিয়ম মেনেছি। কারফিউ জারি করার পর আমরা পরিবারের সবাইকে ঘরের মধ্যে রেখেছি। ঘরেও যদি আমরা নিরাপদ থাকতে না পারি, তাহলে আমরা কোথায় যাব? আমরা আওয়ামী লীগ করি, পরিবার ও এলাকার বেশির ভাগ মানুষ আওয়ামী লীগ সমর্থন করে। গত নির্বাচনেও আমরা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছি। এখানে বড় ধরনের গন্ডগোল করার মতো কেউ নেই। আমাদের কেন এমন হবে! আমাদের বাসায় কেন গুলি করবে! এটা কোন নিয়ম।' 

২৫ জুলাই ২০২৪ তারিখে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় নারায়ণগঞ্জ সংঘর্ষের খবরে বলা হয়েছে, 'বাসার ছাদে গুলি খেয়ে বাবার কোলে ঢলে পড়ে ছোট্ট মেয়ে রিয়া গোপ।' দুপুরে খাওয়ার পর ছাদে খেলতে গিয়েছিল মেয়েটি। খানিক পরেই রাস্তায় সংঘর্ষ বাধে। বাসার সামনে হইহল্লা শুনে বাবা ছুটে যান ছাদ থেকে মেয়েকে ঘরে আনতে। মেয়েকে কোলে নিতেই একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় মাথায়। মুহুর্তেই ছোট্ট দেহটি ঢলে পড়ে বাবা কোলে। স্থানীয় ক্লিনিক হয়ে নেয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেই প্রাণ গেল মেয়েটির। একমাত্র মেয়েকে হারানোর শোকে যেন পাথর হয়ে গেছে রিয়া গোপের বাবা দীপক কুমার ও তাঁর পরিবার।
২৬ জুলাই ২০২৪ তারিখে প্রথম আলো শেষ পাতায় সংবাদ পরিবেশন করেছে, 'পুলিশ সদস্যরা আহত বেশি মাথায় আঘাতে।' ওই সংবাদে বলা হয়েছে, হাসপাতালে এখনো চিকিৎসাধীন ৫৮ জন পুলিশ। আহতরা বেশিরভাগই মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত। অনেকের হাত-পা দুই-ই ভেঙেছে। সংবাদের প্রথমেই ঢাকা উত্তরা পশ্চিম থানার এএসআই মো. মহিউদ্দিনের কেসস্টাডি ছাপা হয়েছে। ১৮ জুলাই উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে গেলে একদল আন্দোলনকারী তাঁকে ধাওয়া দেয়। ভয়ে পিছিয়ে গেলেও প্রটেস্টাররা ধরে ফেলে ব্যাপক মারধর করে। ওই পুলিশ সদস্য দৌড়ে পালিয়ে এসে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের রান্নাঘরে ঢুকে দরজা আটকে দেন। সেটির দরজা ভেঙে আবার মারধর করা হয়। এক পর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়েন ওই পুলিশ। বিক্ষোভকারীদের কয়েকজন তাকে উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠালেও সেখানে পুলিশ পরিচয় পেয়ে আবারো হামলার স্বীকার হন। জ্ঞান ফেরার পর সেখান থেকে দৌড়ে হাসপাতালে আশ্রয় নিলে ওই হাসপাতালে আগুন ধরিয়ে দিতে যায় বিক্ষুব্ধরা।
হাত-পা ভেঙে যাওয়া ওই পুলিশ সদস্য মাথায় গুরুতর আঘাত নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। 

উত্তরা জন বিস্ফোরণে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের সহযোগী জুয়েল মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা করে যেভাবে গাছে ঝুলিয়ে রাখে তরুণ প্রজন্ম, সেটি সভ্যতার স্বাভাবিকতাকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করেছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে ওই তরুণদের স্পষ্ট মুখ দেখা যাচ্ছে। জানি না এটা দেখবার পর ওই তরুণদের মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হবে কিনা? এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনার দায়ভার কাদের সেটি নিয়ে আমাদেরকে কথা বলতে হবে। বিশুদ্ধ রাজনীতির স্বরূপ সন্ধান আমাদেরকে করতেই হবে। নইলে‌ সভ্য মানুষ হিসেবে বিশ্বসমাজে আমরা আর পরিচয় দিতে পারব না। 

২৪ জুলাই ২০২৪ তারিখে দ্য ডেইলি স্টারে খবর পরিবেশন করা হয়েছে, 'একজনকে মারতে কতগুলো গুলি লাগে, স্যার?’ 

খবরে বলা হয়, মর্গে তাঈমের মরদেহ খুঁজে পাওয়ার পর ফোনে ময়নালকে বলতে শোনা যায়, ‘স্যার, আমার ছেলেটা মারা গেছে। ওর বুক ঝাজরা হয়ে গেছে, স্যার। আমার ছেলে আর নেই।’ 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ছোটাছুটি করছিলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের উপপরিদর্শক ময়নাল হোসেন ও তার স্ত্রী। তাদের হাতে ছিল ১৭ বছরের ছেলে ইমাম হোসেন তাঈমের একটি ছবি। যাকেই পাচ্ছিলেন ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন, এই ছেলেকে তারা কি কোথাও দেখেছেন? 

পরে ছবি দেখে একজন সাংবাদিক তাঈমের বাবাকে মর্গে খোঁজ নিতে বলেন। সঙ্গে সঙ্গে জরুরি বিভাগের লাশঘরের উদ্দেশে দৌড় দেন তিনি। একজন লাশঘরের দরজা খুলে দিলে ভেতরে ঢোকেন তারা। সেখানে পড়ে ছিল রক্তে ভেজা ছররা গুলিবিদ্ধ তাঈমের নিথর দেহ। 

ছেলের মরদেহ দেখে স্তব্ধ হয়ে যান ময়নাল হোসেন। তার স্ত্রী মেঝেতে পড়ে মূর্ছা যাওয়ার আগে চিৎকার করে বলছিলেন, 'ও আল্লাহ! আমার পোলারে কে মারল! তুই আমারে না বইলা কেন বাইর হইছিলি?' 

রাষ্ট্রীয় নীতির এ এক চরম পরিহাস যে, বিনা দোষে পুলিশের গুলিতে পুলিশ সদস্যসেরই সন্তান প্রাণ হারিয়েছেন। 

শৃঙ্খলা রক্ষা মানে কি যত্রতত্র যেদিকে খুশি সেদিকে গুলি‌ করা? শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ন্যূনতম প্রশিক্ষণ থাকবে না? কারা দুষ্কৃতিকারী আর কারা নির্বিরোধ তারা সেটা বুঝবে না? বন্দুকের নল মানুষের জানালা গলিয়ে শিশুর মাথায় পৌঁছে যেতে পারে? সভ্যতার মাথা খেয়ে ভুলেও কি তা যাওয়া উচিত? 

সরকারের নিয়ন্ত্রকরা সবাই পড়ে রয়েছেন বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে। যেসব রক্ষা করতে না পারার ব্যর্থতার দায়ভার যদিও তাদের ওপরই বর্তায়। অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি বেঁচে থাকলে পুনর্গঠন করা সম্ভব। কিন্তু যে অমূল্য প্রাণ অকালে হারিয়ে গেল তার কি কোনো ক্ষতিপূরণ হয়? পুলিশ, ছাত্র, পথচারী, শিশুসহ যারা এভাবে মারা পড়ল তাদের নিয়ে, তাদের পরিবার ও স্বজনদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে নীতিনির্ধারকরা হয়ত বলবেন সহিংসতায় নিহতদের পরিবারের দায়িত্ব তারা নেবেন। কিন্তু স্নেহ, মায়া, মমতা ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ একজন মানুষের অপূর্ণতা কোনোদিন আপনারা পূরণ করতে পারবেন? রাজনীতি করলেই মানুষকে এতটা অসংবেদনশীল হয়ে যেতে হয়? যেকোনো খুনেরই এমন দায়মুক্তি দিয়ে দিতে হয়? ইতিহাস আমাদের কাউকেই কি ক্ষমা করবে? কী জবাব দেব জীবনদাতার কাছে? এই মহাপ্রকৃতি আমাদের কাছে জবাবদিহি চাইবে না? আপনাদের অনৈতিকতা, আইনের শাসন ও জবাবদিহিতার অভাব আমাদের জাতিরাষ্ট্রকে কোন তলানিতে নিয়ে যাচ্ছে, সেটা কি আপনারা খেয়াল করবেন না? 

লেখক: সাংবাদিক
২৭ জুলাই ২০২৪