আত্মসমালোচনা না করে ক্রমাগতভাবে অন্যের ভুল খুঁজবার ফল কী? অন্যের ভুল খুঁজে কেউ কখনোই নিজের ভুল সংশোধন করতে পারবেনা। তার মানে দাঁড়ালো যারা নিজেকে সংশোধন করতে চান না তারা অন্যের ছিদ্রান্বেষণে ব্যতিব্যস্ত থাকেন। ইসলামিক মিথোলোজিতে বলা হয়েছে, বিশ্বাসী ব্যক্তি একই ভুল দুইবার করে না। কিন্তু এই পরগণা এখন বিশ্বাসহীনতার অভয়ারণ্য। আমরা চারপাশে কোথাও তো মুমিন দেখি না।
এত ক্ষোভ, খুন, নির্যাতন, হাহাকার , আর্তনাদ, আহাজারি অতঃপর বিশাল মরুভূমে দেখানো সহানুভূতির সামান্য মেঘের ছায়া। কুমিরের চোখেও এতটা কুম্ভীরাশ্রু নেই, যতটা মায়াকান্না ও কপট সমবেদনা আছে আমাতে। বহুমূল্য খুইয়ে, অনেক ত্যাগ আর কান্নায় যে 'কোটা সংস্কার' ইস্যুর অগ্নুৎপাত প্রায় নির্বাপিত করা গিয়েছিল, সেটি খুঁচিয়ে ঘা করছেন কারা? ভুলভাল চুলকাতে এত ভালো লাগে আপনাদের? বুঝবেন না, সব রোগের দাওয়াই একটা না? ক্রমাগত ভুল করতে করতে ভুলের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে যাচ্ছেন সেদিকে হুশ নেই আপনাদের?
আমরা যারা থিয়েটারের স্টুডেন্ট। তারা রীতিমতো 'নাটক' ভুলে যাচ্ছি। স্ক্রিপ্টিংটা ঠিক রাখবেন তো মশাই! নাটকের মাঝখানে এসে নাটকীয়তা করবেন না প্লিজ! আপনারা মর্জিমাফিক যাকে তাকে তুলে নিয়ে দেদারছে কীসব খাইয়ে চলেছেন। এখন খোদ আদালতকেও কথিত 'ভাতের হোটেল' বিষয়ে নাক গলাতে হচ্ছে। এ লজ্জা কার?
কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে খাইয়ে সেটি প্রকাশ করাকে জাতির সঙ্গে মশকরা বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, জাতিকে নিয়ে মশকরা কইরেন না, এগুলো করতে আপনাকে কে বলেছে? কেন করলেন এগুলো? যাকে নেন ধরে, একটি খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন।’
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে জিম্মি করে নির্যাতনের মুখে আন্দোলন বন্ধের স্টেটমেন্ট নেওয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশ। একই সঙ্গে আন্দোলন চলবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
রোববার রাতে টেলিগ্রাম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তারা এ ঘোষণা দেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের টেলিগ্রামে লেখেন, ‘সমন্বয়কদের জিম্মি করে নির্যাতনের মুখে যে স্টেটমেন্ট দেওয়ানো হইছে, সেটা কখনোই জাতির নিকট গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আটককৃত সমন্বয়করা ভয়ভীতির মুখে গোয়েন্দা সংস্থার লিখে দেওয়া যে বক্তব্য কেবল রিডিং পড়ে গেছে, আমরা সেই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করছি এবং একইসঙ্গে জোরপূর্বক বক্তব্য আদায় করার মতো সরকারের এমন জঘন্য কাজের তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’ তিনি আর বলেন, ‘আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই- পূর্বে উত্থাপিত ছাত্র হত্যার দায়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা প্রার্থনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলমান থাকবে। দেশবাসীর প্রতি আহ্বান, আপনারা কোনো প্রকার বিভ্রান্ত হবেন না। যে কোটার জন্য সরকার এতগুলা মানুষকে হত্যা করেছে, সেই হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’
আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার মধ্যে আরও রয়েছেন- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ, মো. মাহিন সরকার, সহ-সমন্বয়ক আব্দুল্লাহ সালেহীন অয়ন, মোসাদ্দেক আলী ইবনে মোহাম্মদ, খান তালাত মাহমুদ রাফি (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)।
আমাদের কথা হলো, আদালতের রায়ের পর এতদিনে কোটা সংস্কার ইস্যুটির সুরাহা হওয়ার কথা। যদিও নারী কোটা বাদ দেয়াটা আমরা কোনোমতেই সমর্থন করি না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখনো নারীর অগ্রযাত্রাকে যথার্থ মূল্যায়ন ও স্বীকার করা হয় না। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নিশ্চিতই পুরুষ নিয়োগকর্তারা কোটার বাইরে গিয়ে নারীকে চাকরি ও ক্ষমতায়ন থেকে বাদ রাখবার বাহানা খুঁজবে। নারী ঘরে থাকবে সমাজে এই সেন্টিমেন্ট এখন প্রবলভাবে দাঁড় করানো হয়েছে। তারপরও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ভাবনায় নারী কোটা বাদ দেয়ার বিষয়টি নিয়ে আমরা কথা বলিনি। তারপরও কোথাও যেন স্বাভাবিকতা ফিরছে না। কারফিউ থামছে না। স্কুলও খুলছে না। আজকেও দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় বিক্ষোভ হলো! এমন এক বাস্তবতায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিয়ে যাচ্ছেতাই করবার প্রবণতা কোথায় কোন শুভফল বয়ে আনবে আমরা জানি না। আমরা কিছুতেই চাইনি স্টুডেন্টরা পুনর্বার আন্দোলনে ফিরুক। শিক্ষার্থীদের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত হয়ে আছে। একজন পরীক্ষার্থীর জন্য এটা যে কতটা বিপর্যয়কর অবস্থা তা যদি আপনারা না অনুধাবন করেন, আপনাদের রাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ হবেই। আপনারা কাজ ও সদিচ্ছায় প্রমাণ করুন যে, কেবল নিজেদের ক্ষমতার ভিত পোক্ত করতে নয়; সত্যিকার অর্থে জনগণের জন্য কাজ করতে চান।
বাংলাদেশের সরকার প্রধানের একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন খুব চলছে। তিনি বলছেন, 'মানুষ কী দোষ করল যে মানুষকে এভাবে খুন করতে হবে? আপনাদেরকে শুধু এইটুকু বলব যে, আপনারা ছবর করেন। আর আল্লাহ্কে ডাকেন। তিনি এই সমস্ত খুনি জালেম এদের হাত থেকে যেন এই দেশটারে রেহাই দেন।'
অপরদিকে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোটা আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে নিহতদের স্মরণে আগামীকাল মঙ্গলবার দেশব্যাপী শোক পালিত হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, 'আজকের বৈঠকে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে।'
সম্প্রতি গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা নিয়ে ‘চুপ না থাকার’ কথা জানান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাথে বৈঠককালে মিজ কমলা হ্যারিস গাজাবাসীর দুর্দশার প্রতি সহানুভূতি জানান। এরপরও ইসরায়েলের প্রতি তাঁর দেশের সমর্থনের বিষয়ে নিজের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন তিনি। এতদবিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর সমাজবিজ্ঞানী এমান আবদেলহাদি মন্তব্য করেছেন, ‘আপনি কারও মাথায় গুলি করছেন, আবার তাঁর প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছেন—এমনটা প্রশংসার যোগ্য নয়। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আমাদের সহানুভূতি দেখানোর দরকার নেই; বরং প্রয়োজন ইসরায়েলকে অস্ত্র ও অর্থ দেওয়া বন্ধ করা, যা সক্রিয়ভাবে এ মানুষদের মেরে ফেলছে। আর এটি করা হলেই তাঁদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো হবে।’
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সমাজবিজ্ঞানী এমান আবদেলহাদির বক্তব্যটিই আমাদেরও কথা। সহানুভূতি নয়, সবার আগে স্থিতিশীলতা দিন। আমরা দেশবাসী কেন মশকরা ও ভুলে ভরা জীবন বয়ে বেড়াব?
লেখক: সাংবাদিক
২৯ জুলাই ২০২৪