Posts

চিন্তা

বেদনার রঙ হলুদ!

July 30, 2024

রফিকুল ইসলাম কামাল

এক.
জোগো বনিতো কিংবা সাম্বার ছন্দ। উন্মাতাল মানুষ। রিও ডি জেনিরো ছাড়িয়ে হলুদ উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া দুনিয়া। যে উচ্ছ্বাসের তরঙ্গে ভেসে বেড়ায় ফুটবল, স্বপ্ন, আবেগ কিংবা বেঁচে থাকার রসদ! সবুজ মাঠে দুরন্ত গোলকে বাঁধা পড়া হলুদিয়া বাসনা। আহা, কী নান্দনিক! কী অপূর্ব!

এই-ই তো ব্রাজিলের ফুটবল। আমাজন পাড়ের দেশ তো এই এক ফুটবল দিয়েই একই হৃদয়িক বন্ধনের সুঁতোয় বেঁধেছে লক্ষ কোটি প্রাণ। যে প্রাণ সতত জেগে ওঠে জোগো বনিতো কিংবা জিঙ্গার তালে তালে। কিন্তু সময় আর অপেক্ষা বলে যে কিছু আছে! শৈল্পিকতা, নান্দনিকতা জায়গা নিয়েছে তাই সময়ের গহীন গহ্বরে। অপেক্ষার বাহনের চাকায় ধরেছে জং। ব্রাজিলের ফুটবল ঘিরে এখন কেবলই দীর্ঘশ্বাস, বেদনার নীল কষ্ট। সেই বেদনা এতোই তীব্র যে, শাশ্বত নীলকে ছাড়িয়ে কেবল ব্রাজিলের জন্য বেদনার রঙ হয়ে যায় হলুদ!

(ছবি: ইন্টারনেট)

দুই.
ব্রাজিলে ফুটবলের ইতিহাস অনেক পুরনো, প্রায় ১৩০ বছরের। সময় নিয়ে বিতর্ক আছে, তবে চার্লস মিলারের অবদান নিয়ে দ্বিমত নেই কারো। বিলেত থেকে ফুটবলে স্নাতক পাস করে ১৯৮৪ সালে ব্রাজিলে ফেরা মিলার হয়ে আছেন দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির ফুটবল জাগরণের পথিকৃৎ হয়ে। বিলেত থেকে ফেরা মিলারের ফুটবলে ব্রিটিশ-দর্শন থাকাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ব্রাজিলিয়ানরা সেই দর্শন, ধারাকে উড়িয়ে দিয়ে ফুটবল খেলাকে নিজেদের মতো গড়ে নেয়। এক্ষেত্রে দাসপ্রথারও অবশ্য দারুণ ভূমিকা ছিল। একসময় ব্রাজিল ছিল সবচেয়ে বেশি দাস রফতানি করা দেশ। এই কলঙ্ক থেকে ১৮৮৮ সালে ‘মুক্তি’ মেলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পর্তুগিজভাষী রাষ্ট্রের; সেবার দেশটি থেকে বিলুপ্ত হয় দাসপ্রথা। মুক্ত দাসেরা ছড়িয়ে পড়লেন সবখানে। তাদের মন-মননে জায়গা করে নিল ফুটবল। বহু পথঘাট মাড়িয়ে কৃষ্ণাঙ্গ, দরিদ্র শ্রেণি যখন স্বীকৃত ফুটবলে জায়গা করে নিল, কিংবা তাদেরকে জায়গা করে দিতে কর্তাব্যক্তিরা বাধ্য হলেন, তখন তাদের ফুটবল আর প্রচলিত ফুটবলে রাজ্যের ব্যবধান দেখল দুনিয়া। নিজেদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সাম্বা আর জিঙ্গার মিশ্রণে ব্রাজিলের নিম্নবিত্ত শ্রেণি যে ফুটবলের প্রদর্শন করতে লাগলো, তা যেন অর্কেস্ট্রার মোহিত সুরের মায়াজাল সৃষ্টি করলো। যে মায়াজালে আটকে গেল গোটা দেশ; দিকে দিকে শোনা গেল ফুটবলের জয়গান। নিজেদের যাতনা, কষ্ট, বঞ্চিত থাকার হাহাকার সব যেন ফুটবল গোলকে কিক মেরে উড়িয়ে দিতে চাইলো ব্রাজিলিয়ানরা। নৃত্যের সালসা আর শারীরিক কসরত যোগ করে ফুটবলকে নবরূপ দিল ব্রাজিল। সেই রূপ গোগ্রাসে উপভোগ করতে লাগলো গোটা দুনিয়া।

তিন.
ফুটবল ব্রাজিলিয়ানদের কাছে নিছকই একটি খেলা নয়। বরঞ্চ তাদের কাছে ফুটবলে খাওয়া, ফুটবলে ঘুম; ফুটবলে হাসা, ফুটবলে কাঁদা তথা খেলাটি একেবারেই জীবনঘনিষ্ঠ। কিংবা জীবনেরই অন্য নাম! শর্ত আছে অবশ্য—হতে হবে নান্দনিক, শৈলী, ধ্রুপদি ফুটবল।

ব্রাজিলিয়ানরা শৈল্পিক ফুটবলকে পূজো দিয়েছে সর্বদা। তাদের কাছে মন্ত্র যেন একটাই—সাম্বার ঝড়ে প্রতিপক্ষের ব্যুহ ভেদ করো, জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ো! ফ্রিদেনরিচ, ডমিঙ্গোস, লিওনিদাস, গারিঞ্চা, পেলে, জিকো, সক্রেটিস, রোমারিও, রোনালদো, রিভালদো, রোনালদিনহোরা যুগে যুগে সেই মন্ত্রেই সঁপেছেন প্রাণ। রূপকথার সৌন্দর্য নিয়ে যেন তাঁদের পায়ে লুটিয়ে পড়তো ফুটবল। তাঁদের পায়ের কারুকাজেই দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ দেশটি পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। শতদল ফুটিয়ে ব্রাজিলের ফুটবলকে তাঁরাই নিয়ে গেছেন হিমালয়সম উচ্চতায়। কিন্তু পরের গল্পে কেবলই হাহাকার! সেই ২০০২ বিশ্বকাপ জয়ের পর পেরিয়ে গেছে প্রায় দুই যুগ; পাঁচটি বিশ্বকাপ আসর। একেকটি বিশ্বকাপ এসেছে, ব্রাজিলিয়ানদের হলুদ কান্না মিশে গেছে বেদনার নীল রঙে।

এমন নয় যে ওই কিংবদন্তিদের পরের ধাপে আর সেরকম তারকা পায়নি ব্রাজিল। যে দেশের রক্তে-নৃত্যে ফুটবল, সে দেশে তারকা ফুটবলারের অভাব থাকে কী করে! কাকা, রবিনহো, নেইমাররা এসেছেন, কিন্তু কেটে যাওয়া সুরের সুঁতো আর জোড়া দিতে পারলেন কই তাঁরা! হালের ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগো, এনদ্রিক, রাফিনিয়াদের কথাই যদি বলা হয়, সবুজ গালিচায় হলুদ জার্সিতে ফুল আর ফুটে না! বিশ্বকাপ বহুদূর, কোপা আমেরিকায়ও ব্রাজিলকে এখন খুঁজে নিতে হয় কেবল জার্সি দেখে! সবুজের ক্যানভাসে শিল্পের শৈল্পিকতা যেন অতীতের মরচে পড়া গল্প!

চার.
ব্রাজিলের ফুটবল লিগ একসময় দুনিয়াসেরা ছিল। এখন সেই ভিত নড়বড়ে। সেরার মর্যাদা তো সেই কবেই হারিয়ে বসেছে। নাড়ির টান ভুলে গেলে পথ তো বেঁকে যাবেই! গেলবার ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠে গিয়েছিল ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফ্লুমিনেন্স। সেখানে ম্যানচেস্টার সিটির কাছে উড়ে যেতে হয়েছে চার গোল খেয়ে। ব্যবধানটা স্পষ্ট। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির ফুটবলের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাও ছিল অবিশ্বাস্য পর্যায়ের। ভাবা যায়, কোচ নিয়ে পর্যন্ত সংকটে পড়ে গিয়েছিল ব্রাজিল! মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে ছিল নিয়ন্ত্রক ফেডারেশনের অনিয়ম, দুর্নীতি।

ব্রাজিলের ফুটবল এখন নেতার অভাবেও ধুঁকছে। অতীতে দেখুন আর বর্তমানে তাকান। বিস্তর ফারাক সহজেই বোঝা যায়। কোনো এক তারকাকে ঘিরে একতাবদ্ধ দলের ঝাঁপিয়ে পড়ার বিষয়টি যেন আর নেই ব্রাজিলে। নেইমার ছিলেন, কিংবা আছেন। কিন্তু তিনিও নিজের খামখেয়ালিপনায় নষ্ট করছেন অমিয় প্রতিভা। সঙ্গে চোট নামক শত্রুর সঙ্গে নিত্য বাস তাঁর। ফলত নেই দলে। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র থাকলেও দলকে একই সুঁতোয় বেঁধে ফেলার কাজটা তিনি করতে পারছেন কই!

এবারের কোপা আমেরিকা শুরু হওয়ার আগে নিজের দল নিয়ে চূড়ান্ত হতাশা গোপন করার কোনো চেষ্টাই করেননি ব্রাজিল কিংবদন্তি রোনালদিনহো। তিনি বলেছিলেন, ‘এই দলে সবকিছুরই অভাব আছে। দৃঢ়তার অভাব, মনের আনন্দে খেলার অভাব, নিবেদনের অভাব।’ জহুরির চোখ ঠিকই ধরতে পেরেছে সমস্যা কোথায়। মনের আনন্দে খেলে যাওয়া ফুটবলার এখন কোথায় ব্রাজিলের? লাগামহীন ইউরোপমুখীতা, অর্থের ঝনঝনানি ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদেরও শিকড়ের টান ভুলিয়ে দিয়েছে। সাম্বার স্বাতন্ত্রতা পেছনে ঠেলে অঙ্কুরেই ইউরোপের দিকে ছুটছেন এনদ্রিকরা। স্কাউটরা (প্রতিভাবান ফুটবলার খুঁজে বের করেন যারা) বাজপাখির চোখ নিয়ে তাকিয়ে, যেই কোনো কিশোর ফুটবলার ঝলক দেখালো, খবর পৌঁছে যায় ইউরোপের ক্লাবগুলোর কাছে। ডলারের ঠেলায় সেই প্রতিভা আর ব্রাজিলের থাকছে না। শিল্পের মর্যাদা হারিয়ে যাচ্ছে শক্তিনির্ভর ফুটবলে।

দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ নাকি ঘুরে দাঁড়ায়। ব্রাজিলের ফুটবলও আক্ষরিক অর্থেই সে অবস্থানে এখন। ব্যর্থতার বিস্তৃতি, হারিয়ে যাওয়া সেলেসাও, সমালোচনার সাগর পেরিয়ে তাদের তো আর পেছন ফেরার সুযোগ নেই! ব্রাজিলের ফুটবলের এখন লক্ষ্য একটাইÑঘুরে দাঁড়াও! আর যদি তা না হয়, তবে কোটি হৃদয়ের বেদনাস্নাত হলুদিয়া পাখি হয়তো আর উড়বেই না।

(লেখাটি সর্বপ্রথম ক্রীড়াবিষয়ক দেশের একমাত্র সরকারি ম্যাগাজিন পাক্ষিক ক্রীড়াজগত এর ১৬ জুলাই ২০২৪ ইংরেজি তারিখ সংখ্যায় প্রকাশিত)

Comments

    Please login to post comment. Login