পোস্টস

চিন্তা

প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি!

৩১ জুলাই ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

প্রধানমন্ত্রী জানি আপনি ভালো নেই। দেশের এই বিচিত্র সংকটকালে ভালো থাকবার কথাও নয়। আমরাও একদম ভালো নেই। কোটা সংস্কারের সামান্য বিষয়টিকে যেভাবে জটিল পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়া হয়েছে তা পুরোদস্তুর অভাবনীয় ও অনভিপ্রেত।

আপনি রাজনীতি করেন। এটি আপনার পেশা। আপনার সেই পেশাদারিত্ব এখন ভয়াবহভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। আপনারা ক্ষমতায় থাকবার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। আমার বড় কন্যা এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। ৬টি পরীক্ষা শেষ হতেই দেশকে কারফিউ পরিস্থিতিতে নিয়ে গেছেন। আমার মেয়েদের মতো লাখো শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা চরম উৎকন্ঠায় দিন গুজরান করছে। কে জানে কখন তাদের অবশিষ্ট পরীক্ষাগুলো অনুষ্ঠিত হবে?

আমরা জানি আপনাকে অনেক পরামর্শ নিয়ে চলতে হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে যেসব সিদ্ধান্তগুলো আপনার পরামর্শকদের কাছ থেকে এসেছে, তা মোটেই বর্তমান উত্তেজিত সময়কে প্রশমিত করতে ভূমিকা রাখেনি। বরং ছাত্রদেরকে উত্তেজিত করে যেভাবে পলিটিক্যাল অপজিশনকে সুযোগ করে দেয়া হলো তা নজিরবিহীন। মাঝখান দিয়ে অনেক মায়ের বুক খালি হলো, নিঃস্ব হয়ে গেল অনেক পরিবার, সম্পদহানি হলো, বদনাম হলো দেশটার। সম্পদ গড়ে নেয়া যাবে। প্রাণকে ফেরানো যাবে না কখনোই। হাজার সান্ত্বনায় এই শোকও কোনোদিন ঘুচবে না।

আপনারা আজ রাষ্ট্রীয় শোক পালন করলেন। গেল সপ্তাহখানেক ধরে দেশে যত বড় বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটল -এরজন্য কোনো শোকই আসলে দুঃখকে প্রশমিত করে না। তবে এ শোক পালনটা তখনই বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে, যখন আপনারা বিপর্যস্ত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারবেন, প্রতিটি ঘটনার অনুপুঙ্খ তদন্তসাপেক্ষে দায়ীদেরকে বিচারের আওতায় আনবেন এবং সবখানে সর্বোতভাবে আইনের শাসন বলবৎ করবার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করবেন।

আপনি কি তদন্তের নির্দেশনা দেবেন যে, কেন পুলিশ নির্বিরোধ শিশু, পথচারী, দোকানদার, প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের দিকে বুলেট ছুড়ে যমদূত হতে গেল? দেশে কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, বহিশত্রুর আক্রমণও ঘটেনি; তারপরও সাধারণ প্রতিবাদী মানুষের প্রতি দেখামাত্র গুলির নির্দেশনা কেন দিতে গেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক?

নিঃসন্দেহে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ন্যায্য আন্দোলনটি পলিটিসাইজ হয়েছে। আমরা মনে করি এটি‌ খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। আপনার দল যেমন দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় আছে, তেমনি আপনার অপজিশন অপরাপর রাজনৈতিক দলও ক্ষমতার স্বাদ পেতে ইচ্ছুক। টেস্টি ও ডেলিশাস জিনিস নিজেদের বাগে আনতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবেই। আপনার দল ক্ষমতার বাইরে থাকলে একই কাজ করত। আপনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে আমাদের বিশ্বাস ছিল এমন রাজনৈতিক সংকট রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করবেন। কিন্তু আমরা দেখলাম উল্টোচিত্র। বিরুদ্ধমতকে পশ্চাতে ফেলতে গণতান্ত্রিক পন্থায় না গিয়ে দমনপীড়নের পথ বেছে নিলেন। যেটি আসলে একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলটির সাথে একদম মানানসই হয়নি।

আমরা মনে করি, এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। পৃথিবীর কেউ ভুলের উর্ধ্বে নয়। এমনকি ঈশ্বরের সমালোচনায়ও স্যামুয়েল বেকেট 'ওয়েটিং ফর গডো' নাটক লিখেছেন। কাজেই আপনাদেরকেও সমালোচনার বাণ সইতে হবে। আত্মসমালোচক হয়ে উঠতে হবে। ডিনায়াল কখনো কোনো সমস্যার সমাধান বয়ে আনে না। ভুল স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশ করলে মানুষ হিসেবে আত্মমর্যাদা বাড়ে।

আপনার অধীনে থাকা বেনজীর-মতিউর-আবেদ-জাহাঙ্গীরের মতো মানুষে ভরে উঠেছে বাংলাদেশের চারিধার। আপনার ঢাকা ডিবি দ্বিতীয় সরকার কায়েম করে বসেছে। আপনার দলের সাধারণ সম্পাদক ছাত্রলীগকে সাধারণ ছাত্রের ওপর হামলা করবার অনুমোদন দিয়ে মারাত্মক ভুল করেছেন। এসব সমস্যা ও সংকট মেনে নিয়ে সমাধানের পথ বেছে না নিলে আপনার গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে না, বরং কমবেই।

কে ক্ষমতায় থাকল না থাকল সেটি নিয়ে আমাদের সাধারণের মাথা ব্যথা নেই। আমরা সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নই। আমরা চাই যেকোনো মূল্যে দেশটা ভালো থাকবে। এখানে সবাই সবাইকে বিশ্বাস করবে। একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসবে। মায়া ও মমতা দেখাবে। সবার সুন্দর সহাবস্থান নিশ্চিত করা হবে। সভ্য সমাজ কায়েম হবে। ধর্মান্ধতা ও কূপমন্ডুকতা ভুলে মানুষ হয়ে উঠবে মুক্তচিন্তক, সংস্কৃতিবান ও দেশাত্মবোধে উদ্দীপ্ত‌। বর্জন, বয়কট বা নিষিদ্ধ করা রাজনীতিতে টেকসই কোনো সমাধান নয়। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই বরং মানুষের দুর্নিবার আকর্ষণ তৈরি হয়।

এরচেয়ে এই ভালো সুশাসন নিশ্চিত করুন। শিক্ষার্থীদেরকে হয়রানি বন্ধ করুন। ঢালাও গ্রেফতারের পথ পরিহার করুন। সকল সেক্টরের দুর্নীতি ও লুটপাটের রাশ টেনে ধরুন। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করুন। ধর্মীয় রাজনীতির সভ্যতা ও মানবতাবিরোধী অপকারিতা সবাইকে শেখান। হীন রাজনৈতিক স্বার্থে এমন কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবেন না, যারা প্রত্যক্ষভাবে সভ্যতা বিরোধী, নারীবিদ্বেষী ও চরম পশ্চাৎপদ। মানুষকে বিশুদ্ধ, যুক্তিভিত্তিক ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষায় শিক্ষিত করুন। বিভাজন ভুলে সবাইকে আপন ভাবুন। আপনাদেরকেও সবাই ভালোবাসবে।

দয়া করে এখনি এইচএসসি পরীক্ষার রিশিডিউল ঘোষণা করুন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিন। কারফিউ তুলে নিয়ে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিন। পুলিশকে মানবতা ও সভ্যতা শিক্ষা দিন। সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ সকল পেশাজীবী যেন আপনাদের লেজুড়বৃত্তি না করে এমন পরিবেশ ও প্রতিবেশ গড়ে তুলুন। আপনাদের ইচ্ছায় দেশের গণমাধ্যমের ভাবমূর্তি ইতোমধ্যে তলানিতে পৌঁছে গেছে। সাংবাদিকরা বাইরে গেলে সাধারণ মানুষ তাদেরকে মারতে আসে। গণমাধ্যমকে গঠনমূলক সমালোচক ও ক্ষমতাকে জবাবদিহি করবার সুযোগ না দিলে আপনাদের ভুল কখনোই বুঝতে পারবেন না। মানুষ নিজের ভুল নিজ চোখে দেখে না। কাজেই একগুঁয়েমি ছেড়ে নিজেদের ভুলগুলো মেনে নিয়ে বিশুদ্ধতা চর্চায় মনোনিবেশ করুন।

সকল শুভবোধের পতনের আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীটা আপনার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে আরেকবার স্মরণ করতে বলি, "জনাব নুরুল আমিন কত বড় অপরিণামদর্শী কাজ করলেন! গুলি ছুঁড়লেন, তাও আবার ছাত্রদের উপরই? মানুষের যখন পতন আসে, তখন পদে পদে ভুল করতে থাকে।"

ইতিঃ
ফারদিন ফেরদৌস
সাদা, লাল ও কালোর বাইরে
একজন সাধারণ নাগরিক
৩০ জুলাই ২০২৪