পোস্টস

চিন্তা

প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি ২

৩ আগস্ট ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

জানি না আপনার মন্ত্রীরা আপনাকে কী পরামর্শ দিচ্ছে। প্রায় সবকিছু বন্ধের মুখে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কোনো উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আছে কিনা সেটাও ঠিক অনুভব করা যাচ্ছে না। জনগণের ম্যান্ডেট লাগে না এমন একটা অলীক আত্মবিশ্বাস আপনার দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে এখনো আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কথায় বলে বয়সে বুদ্ধি বাড়ে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষিত আলাদা। বয়স হলে এখানকার মানুষেরা সবকিছু গুবলেট পাকিয়ে ফেলে, লেজেগোবরে অবস্থায় নিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ এখনো ভেবে বসে আছে কোনো এক অদৃশ্য ম্যাজিকে আওয়ামী লীগের এইসময়ের কঠিন বেদনা আপনিই দূর করে দেবেন! আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আপনার 'কোটা কথায়' ভয়াল অগ্নিগিরির যে অগ্নুৎপাত ঘটে গেছে সেখানে সামান্য জল ঢালবার মুরোদও নেই আপনার মন্ত্রী, উপদেষ্টা বা পরামর্শকদের। 

আপনারা খুব ফলাও করে প্রচার করেন যে দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটে গেছে। অবকাঠামো বিশ্বমানে পৌঁছে গেছে। কিন্তু একবারও কি ভেবেছেন মানুষের মানসিক বা আত্মিক কোনো উন্নয়ন ঘটেছে কিনা? মানুষ শুদ্ধ ভাষায়, নির্ভয় ও অসঙ্কোচে প্রাণখুলে মনের কথা বলতে পারছে কিনা? মানুষ সভ্য হয়ে উঠছে কিনা? মনের গহিনে জমিয়ে রাখা পাশবিকতা অবলোপন করে মনুষ্যত্ববোধে উদ্দীপ্ত হচ্ছে কিনা। মানবিক মানুষ হয়ে উঠছে কিনা? না এর কিছুই হয়নি। আপনি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে জীবনের মূল্যবান সময় ও মেধা ক্ষয় করে যা কিছু করেছেন এক কথায় তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে চলেছে। কারণ আপনি আসল কাজ মানে মানুষকে মানুষ হয়ে উঠবার সুযোগ তৈরি করেননি। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের একটা উদাহরণ দেই। সাতদিন আগে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে এক বখাটে বিয়ে করে বউ বাড়িতে নিয়ে এসে দুই বন্ধুকে আহ্বান করেছে ধর্ষণ করে যেতে! বনের পশুদের মধ্যেও এতটা অনাচারের উদাহরণ পাওয়া যাবে না। এক চাল টিপলে সব ভাতের খবর পাওয়া যায়। কালিহাতীর বাছেদ মিয়া দিয়েই সমাজ ভরিয়ে তোলা হয়েছে। তো এমন অমানবিকতা ও অমানুষিতা থেকে বাঁচতে কেউ যদি প্রতিবাদী হয় তার প্রতি দোষারোপ কেন করবেন? 

আপনি প্রায় বিনাভোটে স্বতন্ত্র ও আওয়ামী লীগ নাম দিয়ে যাদেরকে সংসদের মতো পবিত্র অঙ্গনে ঠাঁই করে দিয়ে মহিমান্বিত করেছেন, তাদের কয়জন আইন প্রণয়ন করবার সক্ষমতা রাখে? দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, মুনাফাখোর, ঝুট দখলকারী, অন্যের ভূমি জবরদখলকারী, মাস্তান, চাঁদাবাজরাও সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। গায়ক, নায়ক, সঙ, ভাঁড়েরা এসেম্বলিতে মেম্বারশিপ পেয়েছে। আইন প্রণয়ন তো বহুত দূর কি ভাত, সামান্য চিঠি ড্রাফ্ট করবার যোগ্যতাও তারা রাখেন না। এক লাইন বাংলা বাক্য শুদ্ধ করে বলতে পারে না এমন মানুষকেও আমরা এমপি'র মতো মহান পদ অলংকৃত করতে দেখেছি। কী মনে হয়? বাংলাদেশে যোগ্য মানুষের অভাব পড়েছে? আপনাদের অবস্থা দেখলে তাই মনে হয় দেশটা বুঝি মেধাশূনতায় ভুগছে। তাই যদি না হবে, হাটহাজারীর মতো চরম পশ্চাৎপদ পরগণাকে আপনারা ধর্মের মক্কা করবার প্রয়াস পেতেন না। একটি উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর কাছ থেকে 'কওমী জননী' উপাধি গ্রহণ করে চরম মিসোজিনিস্ট ধর্মগুরুকে রেলের মূল্যবান জমি উপহার দিয়ে মন পেতে চাইতেন না? বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নার্সিং করে ২০১৩ সালে আদালত কর্তৃক নিবন্ধন বাতিল হওয়া অন্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করাটা তাই বিরাট রিডিকুলাস ঠেকে! 

আপনারা চাননি বাঙালি মানুষ প্রকৃতার্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, সংস্কৃতি সচেতন, বুদ্ধিবৃত্তিক, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক, সাহিত্য সমঝদার বা শিল্পপ্রেমী হয়ে উঠুক। প্রতিটি উপজেলায় লাইব্রেরী, খেলার মাঠ, মুক্তমঞ্চ না গড়ে বহমূল্য ব্যয়ে ধর্মীয় প্রার্থনালয় বানিয়েছেন। অথচ দেশে কোথাও কেউ কোনোদিন মস্ক বা টেম্পল বানিয়ে দেয়ার দাবি করেছে এমনটা শুনিনি। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় উগ্র ডানপন্থার চাষ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাওয়া সাংবিধানিক চার মটো বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে কথা বলাটা আপনাদের সাজে না। ২০০৮ সালে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসা দলটি বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক, সাম্যবাদী, দুর্নীতিমুক্ত, মানবতাবাদী সভ্য দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারত। কিন্তু গেল ১৫ বছরে দেশ হেঁটেছে পুরোই বিপরীত পথে। এমন একটা দেশে আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ ১৫ আগস্টের শোকাবহ দিনকে উৎসবের দিন বলে ঘোষণা দেয়ার প্রয়াস পাচ্ছে। তারা গুগল ম্যাপে গণভবনের নাম নারীর প্রতি চরম অবমাননাকর শব্দবন্ধে বদলে নিয়েছে। এর সমস্ত দায়ভার আপনার দলের মতো আপনাকেও বহন করতে হবে বৈকি। 

আপনি দেশটাকে আওয়ামীকরণ করতে চেয়েছেন। ভিন্নমতের মানুষদেরকে শত্রুজ্ঞান করেছেন। আওয়ামী লীগের লোকদের একচ্ছত্র ব্যবসা বাণিজ্য দিতে চেয়েছেন। এই সুযোগে হাইব্রিড নামের দুষ্কৃতিকারীরা মুজিবকোট পরে এসে আপনাদের স্তাবক বনে গেছে। ত্যাগী আওয়ামী লীগাররা এখন আপনাদের 'চোখের বালি'। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাজনীতির চরমপন্থা ভর করেছে এটা সত্য, কিন্তু আপনাদের একদেশদর্শী চিন্তায় এমনসব মানুষেরা বঞ্চিত হয়েছেন যারা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে। আপনারা ক্ষমতাসীন দলকে যেনতেনভাবে শক্তিশালী করতে গিয়ে বন্ধুহীন হয়ে পড়েছেন। গণমানুষের বন্ধুতা ছাড়া রাজনীতির দুস্তর পারাপার পাড়ি দেয়া সহজ নয়। 

আপনি পারতেন স্বাধীন বিচার বিভাগ গড়ে নিতে। আপনি এটাও পারতেন নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী, কার্যকর ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অযোগ্য দলদাসদের প্রাধান্য না দিয়ে মেধা ও যোগ্যতার বেসিসে শিক্ষক বা উপাচার্য নির্বাচন করতে। মন্ত্রী, আমরা ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের দুর্নীতি কমিয়ে আনতে। কিন্তু তাতো হয়নি। এমন বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় থাকবে না তখন ওই দলটির কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে ভেবেছেন কি? আপনি পারতেন নির্দিষ্ট একটি দলের স্বার্থ না দেখে দেশটাকে শক্তিশালী করতে, দেশের সকল সিস্টেম বদলে দিতে। এমন একটা ব্যক্তি বা দল নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তুলতে পারতেন যারা দেশের শুদ্ধ, সৎ ও মেধাবী মানুষদের যথোপযুক্ত জায়গায় বসিয়ে দিয়ে সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করবে। বিশ্বের বুকে আমাদের সভ্যতারও জয়গান হবে। 

বহুত্ববাদী ভাবনাই হলো গণতন্ত্রের আসল সৌন্দর্য। সবকিছু নিয়ন্ত্রণের আবরণে ঢেকে রেখে গণতন্ত্র চর্চা হয় না। মানুষের সমালোচনার ভাষাকে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট কিংবা পুলিশি দমনপীড়নে স্তব্ধ করে দিয়ে গণমানুষের মন পাওয়া যায় না। আরোপিত সংকোচন মানুষের মনকে বিক্ষিপ্ত করে বিষিয়ে তুলে। আমরা বর্তমান সময়ে তারই বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাচ্ছি। 

সামান্য একটা ভুলে দেশটা আহত মানুষে ভরে উঠতে পারে, স্বজনহারা পরিবারে কান্নার রুল উঠতে পারে এর সর্বশেষ ও সবিশেষ উদাহরণ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। আশা করি আপনি আমাদের ভাষা বুঝবেন। 

আজ রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা মিলিত হয়েছিলেন ন্যায়বিচারের দাবিতে। এই অবস্থায় প্রত্যাশা করি আর একটাও প্রাণহানিতে না গিয়ে ছাত্র-জনতার প্রতিবাদের ভাষা বুঝুন। প্রতিবাদী ছাত্র-জনতাকে তাদের অধিকার ও ক্ষমতা বুঝিয়ে দিন।

 

নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া আপনার দল আওয়ামী লীগকে শুধরে নিন। জনতার ভালোবাসা অন্তর দিয়ে অনুভব করুন। 

-ফারদিন ফেরদৌস
লেখক ও সাংবাদিক
৩ আগস্ট ২০২৪