পোস্টস

সমালোচনা

গণমানুষের ভাষা বোঝার চেষ্টা করুন

৫ আগস্ট ২০২৪

ওসমান এহতেসাম

বাংলাদেশে গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহ দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে এক নতুন বাস্তবতার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতির পটভূমি এক দিনে তৈরি হয়নি, তৈরি হয়েছে এক দশক, কমপক্ষে কয়েক বছর ধরে। বর্তমানে দেশে একটি গণ-অভ্যুত্থান চলছে, যা দেশের রাজনৈতিক কাঠামোকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখনো যাঁরা এই অগ্ন্যুৎপাতের উৎস খোঁজার জন্য গত এক মাসের ঘটনাপ্রবাহের দিকে মনোনিবেশ করে আছেন, সরকারকে আগে জনগণের ভাষা বা দেয়াললিখন পড়তে না পারার জন্য তিরস্কার করছেন, তাঁদের বুঝতে হবে যে, এখন রাজপথের ভাষা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন। তাঁরা এখনো যা বলছেন, ক্ষমতাসীনদের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারকে যা করার পরামর্শ দিচ্ছেন, তা আসলে সরকার যা করেছে-করছে, তার থেকে ভিন্ন নয়।
এসব পরামর্শ ক্ষমতাসীনদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে বলে মনে হয় না। কারণ যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে সিদ্ধান্ত একক ব্যক্তির। যে গোষ্ঠীগুলো এখন শক্তি প্রয়োগ করে এবং একটি রাজনৈতিক শাসনের কুহেলিকা তৈরি করে এই ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে পারবে, তাঁদের ছাড়া আর কারও কথাই সরকারপ্রধানের শোনার কারণ নেই, সম্ভাবনাও নেই। তাহলে প্রশ্ন আসে, কীভাবে এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা যায়? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনেক আলোচনা রয়েছে, কীভাবে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটানো যায়। ভ্যারাইটিস অব ডেমোক্রেসি (ভি-ডেম) ইনস্টিটিউটের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত দুই দশকে আটটি দেশ স্বৈরশাসন প্রক্রিয়া উল্টে দিতে সক্ষম হয়েছে। 
এসব ক্ষেত্রে পাঁচটি প্রধান পথ রয়েছে: বৃহত্তর জনগণের আন্দোলন, বিচার বিভাগের কার্যকর ভূমিকা, বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস, গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতার পালাবদল, এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সুরক্ষা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গত দেড় দশকে দুটি পথ সংকুচিত হয়ে গেছে—বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে কতটুকু কার্যকর, তা সবাই জানেন। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অবসানের পর সুষ্ঠু নির্বাচনও কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এর ফলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়ণের জন্য একমাত্র পথ হচ্ছে বৃহত্তর গণ-আন্দোলন এবং রাজনৈতিক শক্তি ও সিভিল সোসাইটির জোটবদ্ধ প্রয়াস। বর্তমান আন্দোলনেও তরুণদের অংশগ্রহণ এবং সিভিল সোসাইটির উত্থানই এই পথকে প্রশস্ত করছে। ক্ষমতাসীনদের প্রতিক্রিয়ার কারণে নাগরিকেরা এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। যেসব দেশে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটেছে, সেখানে দেখা গেছে ক্ষমতাসীনরা দল ও সরকারের ‘কসমেটিক’ পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্ষোভ-বিক্ষোভ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জনগণের আন্দোলন এবং গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা এ ধরনের পরিবর্তনকে টেকসই হতে দেয় না। 
অতএব, আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে জনগণের ভাষা বোঝার চেষ্টা করা, তাঁদের আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদাকে উপলব্ধি করা। সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী, নীতিনির্ধারক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের উচিত জনগণের দাবির প্রতি সংবেদনশীল হওয়া এবং তাঁদের ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া। গণমানুষের কথা বোঝার চেষ্টা না করলে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে কোনো বাস্তব পরিবর্তন আসবে না। জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনই একমাত্র পথ যা দেশে একটি সুষ্ঠু ও টেকসই গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে এবং গণমানুষের কথাকে বুঝতে চেষ্টা করলেই বাংলাদেশে একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

লেখক: শিক্ষার্থী ও সমন্বয়ক, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন osmangonistudent5@gmail.com