পোস্টস

চিন্তা

শেখ হাসিনার পতন ও ইতিহাসের শিক্ষা!

৫ আগস্ট ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস



একজন রাজনীতিবিদের এমন পলায়ন রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বড় কলঙ্কিত করল। কী বাপের কী মেয়ে! তার অনুধাবন করা উচিত ছিল কারো দয়ায় নিজের প্রাণ বাঁচলেও লাখো আওয়ামী লীগারকে তিনি পথে বসিয়ে গেলেন। কালের বিবর্তনে একদিন হয়ত স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগের নাম-নিশানাও মুছে যাবে। ভুলে যাবে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নাম। 

শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাও আত্মস্বার্থনিমগ্ন ও ক্ষমতালোভী একজন মানুষ বা রাজনীতিকের বাইরে আর কিছু থাকলেন না। ইতিহাস তার বদনামটাই হাইলাইট করবে। শেখ হাসিনার মুখের বেফাঁস কথা, তাঁর দম্ভ ও অহমিকা আকাশ ছুঁয়েছিল। ভিন্নমতের মানুষকে মনুষ্য পদবাচ্যে গণ্য করতে ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। সেটারই অনিবার্য পরিণতি দেখলাম আমরা। 

৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখ গণভবন কিছুক্ষণের জন্য হলেও সত্যিকার অর্থে গণমানুষের হয়ে উঠল। তথাকথিত নিরাপত্তা বলয়ের পাশ দিয়ে সাধারণ মানুষকে চলতে ফিরতে ভবনটিকে সমীহ করতে হয়। নেতা যদি গণমানুষের আপনজন না হন, কাছের মানুষ না হন, সর্বজন শ্রদ্ধেয় না হন -পরিস্থিতি এমনই হওয়ার কথা। 

শেখ হাসিনা সরকার পতনের এই ঐতিহাসিক ঘটনা আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য বড় শিক্ষা দিয়ে গেল যে, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে একজন পলিটিশান আর মহিমান্বিত মানুষ থাকেন না। জনগণের ভালোবাসা পেতে হলে গণমানুষের মন সমঝে চলতে হয়। যদিও দুঃখজনক ঐতিহাসিক সত্যিটা হলো আমাদের দেশের মানুষেরা ইতিহাস থেকে এতটুকু শিক্ষা নেয় না। 

কী দরকার ছিল শেখ হাসিনার ড. মুহাম্মদ ইউনুসের পেছনে লেগে থাকার? যিনি এখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হতে যাচ্ছেন। কী দরকার ছিল সত্তরোর্ধ্ব অসুস্থ মানুষ খালেদা জিয়াকে আইনের ফাঁদে ফেলে জেলে বন্দী রাখবার? কী প্রয়োজন ছিল ২০১৩ সালে উচ্চ আদালতে নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতকে পুনরায় বাতিল করার নাটক করার? কী লাভ হলো ছাত্রলীগকে রাতের আঁধারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর লেলিয়ে দেয়ায়? কী দরকার ছিল পুলিশকে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দিয়ে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবার? 

আমরা জানি না কেন এমন করে ডেমোক্রিটিক কালচার ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। কথিত আয়নাঘর থেকে এখন বন্দী মানুষেরা বের হয়ে আসছেন। যারা বছরের বছর ধরে দুনিয়ার কোনো খবর জানতেন না। কী অবলীলা ও অমর্যাদায় ক্ষমতা ধরে রাখতে এতগুলো প্রাণ কেড়ে নিয়ে অতঃপর অন্ধকারে প্রস্থান! ছিঃ! 

হাসিনা সরকারের আমলে পদ্মাসেতু-মেট্রোরেলের মতো বেশকিছু অবকাঠামো তৈরি হয়েছে দেশের উন্নয়নে। পাশাপাশি শেখানো হয়েছে কিভাবে প্রকল্পের নাম করে বিপুল অর্থ লোপাট করে দেশের বাইরে পাচার করে দেয়া যায়। কিন্তু মানুষের মধ্যে সততা, সহনশীলতা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, মানবিকতা বোধ ও সভ্যতা তৈরি করবার মতো শিক্ষা আওয়ামী লীগ সরকার দিতে পারেনি। একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কাছ থেকে কওমী জননী উপাধি নিয়ে ক্রমাগতভাবে ধর্ম নিয়ে কার্ড খেলে গেছেন। যে কারণে উন্নয়নের সকল ঘটনা জনমনে পাত্তা না পাওয়ায় পর্যবশিত হয়েছে। শেষের দিকে এসে আওয়ামী লীগকে কেউ আর বিশ্বাস করত না। সবাই মনে করতে শুরু করে, হয় আওয়ামী লীগ মিথ্যা বলে, নাহয় কোনো চলমান ইস্যু ঢাকা দিতে নতুন কোনো ইস্যু আনবার বাহানা করে। দেশে লোকনীতি কায়েম না করে এক পাক্ষিক আওয়ামী সরকারি নীতি প্রচলন করা হয়েছিল। 
নির্বাচনের নামে যে নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়েছে সেসবে ভোটারদের এতটুকু আস্থা ছিল না। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে ডামি স্বতন্ত্র ও আওয়ামী লীগের মধ্যে যে ভোটের আনুষ্ঠানিকতা সারা হয় সেটি বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ এবং বিশ্বসমাজ মেনে নেয়নি। এর আগের ভোটেও রাতে ভোট করে নেয়ার বড় অভিযোগ ছিল। সবমিলিয়ে দেশে কার্যত নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের নামে শেখ হাসিনার একনায়কতন্ত্রই বলবৎ ছিল। যে শাসন ব্যবস্থায় সর্বশেষ সরকার তাই ৮ মাসও টিকল না। 

উচ্চ বেকারত্বের মধ্যে প্রবলভাবে লোভনীয় সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণের জন্য আদালতের রুল। অতঃপর বিক্ষোভের সূত্রপাত হওয়ার মধ্য দিয়ে আদালতের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করা হয়। সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করা হলো। তারপরও ওই বিক্ষোভ খুব সময়ে হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনে রূপ নিল। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন একটা উপলক্ষ মাত্র ছিল। এটা যে ফাইনালি সরকারের পতনের আন্দোলনে যাবে এটি আন্দোলনকারী ও তাদেরকে প্রচ্ছন্নভাবে সমর্থন দেয়া রাজনৈতিক দলগুলো বুঝলেও পাত্তা দেয়নি আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে ভরসা করে ছিলেন নিজের অচল ও অযোগ্য গোয়েন্দা সংস্থার ওপর। ভরসা করে ছিলেন দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে থাকা নেতৃবৃন্দের ওপর। যারা শেখ হাসিনার পতন ঠেকাতে কানাকড়ি ভূমিকাও রাখেনি। অগণন মানুষের জীবন নিয়ে এবং অকাতরে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েও শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে পারেনি পুলিশ। অপরদিকে সেনাবাহিনী বিক্ষুব্ধ জনতার মুখোমুখি হয়ে নিজেদের গৌরব ও সম্মানকে ধুলিসাৎ করতে চায়নি। যদিও শেষ সময় পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলপ্রয়োগের পথে থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু পরিণতি হলো গোপনে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া। অথচ দু একদিন আগেও যদি বাস্তবতা মেনে শিক্ষার্থীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতেন তবু সেটি হতে পারতে সম্মানের। তিনি এমন একটি কাজ করলেন নেতারা যা কখনোই করেন না। ১২০৬ সনে পালিয়ে যাওয়া বাংলার শাসক লক্ষ্মণসেনের পর শেখ হাসিনা হলেন দ্বিতীয় পলাতক নেতা। 

এমন এক বাস্তবতায় শেখ হাসিনাকে সমর্থন জানিয়ে আসা ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও তার অদূরদর্শিতার কঠোর সমালোচনা করছেন। শেখ হাসিনার ভুলভাল সিদ্ধান্তের কারণে আওয়ামী লীগের ইমেজ তলানিতে ঠেকেছে। পতনের পর সবচেয়ে অমর্যাদা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। 

বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙা হয়েছে, ভাস্কর্য গুড়িয়ে দিয়ে জুতাপেটা করা হয়েছে, গলায় রশি ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে, ঐতিহাসিক ৩২ নাম্বার বাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। কন্যার কর্মদোষে পিতার প্রতি এতটা আক্রোশ আমরা দেখলাম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালেও পাকিস্তানি মিলিটারিরাও ৩২ নাম্বার বাড়ি বিলীন করেনি। এক ভিডিওতে দেখলাম এক প্রটেস্টার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের মাথায় ওঠে প্রকাশ্য দিবালোকে হাজার মানুষের সামনে শিশ্ন উন্মুক্ত করে 'পি' করছে। সেটা ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিয়ে উল্লাস করছে তার সতীর্থরা। ব্যক্তির প্রতি ক্ষোভ, বিদ্বেষ ও সমালোচনা থাকতে পারে, তাই বলে এতটা? এমন বর্বরতার দ্বিতীয় আর একটি উদাহরণ দেয়া যাবে? এর দায়ভার আমি দাম্ভিক শেখ হাসিনাকে দিচ্ছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতির যতটা ক্ষতি, অসম্মান ও অবমাননার পথ তিনি তৈরি‌ করেছেন -আর কেউ তার ধারেকাছেও নেই। 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের ওপর দ্রুত আস্থা ফিরিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন। লন্ডনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকাকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘দেশ পুনর্গঠনে আমরা একসঙ্গে কীভাবে কাজ করতে পারি, সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব দলের সঙ্গে কথা বলব।’ 

গণ আন্দোলনের পরে নতুন সরকারে প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস কি সমালোচিত আগের সরকারের বদনাম ঘোচাতে পারবেন? শেখ হাসিনা ভিন্নমত ও সমালোচনা সহ্য করেননি, ড. ইউনূস কি বিপরীত পথে হাঁটবেন? আন্দোলনের পরে দেশে বিরাট দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। প্রাণ গেছে শত শত মানুষের। ভাঙা হয়েছে স্থাপনা। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে প্রতিপক্ষ ও হিন্দুদের বাড়িঘর-মন্দির। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়েছে। বিনষ্ট করা হয়েছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এগুলো সব ঠিকঠাক করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে কি নতুন সরকার? বাংলাদেশের মন্দির থাকবে, মসজিদ থাকবে, প্যাগোডা থাকবে, গির্জা থাকবে, বোরকা থাকবে, জিনস থাকবে। সবকিছুই সমান্তরালে সহাবস্থানে থাকবে বহুত্ববাদী সাম্যের সমাজে। যেখানে আর কোনোদিন বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাউকে যেন রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে নামতে না হয়। দুর্নীতি, লুটপাট, ক্ষমতার অপব্যবহারবিহীন সহনশীল ও প্রেমময় এক সমাজ কায়েম হোক। যেখানে মানুষ সর্বমানুষকে ভালোবাসা ও মমতার বন্ধনে জড়িয়ে রাখবে। শিষ্টাচার ও সভ্যতা রপ্ত করবে সবাই। 

আজ আমরা এই কথাগুলো সাহস নিয়ে বলতে পারলাম। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামের বর্বরোচিত আইন দিয়ে এতদিন আমাদের মুখে কুৎসিত স্কচটেপ সাঁটিয়ে দেয়া হয়েছিল। গলাটিপে রাখা হয়েছিল গণমাধ্যমের। আমরা যেন ন্যায়, সততা ও হিতবাদিতার পক্ষে সরব গলা‌য় কথা বলতে পারি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর প্রশাসন যেন আমাদের কড়া সমালোচনাও গ্রাহ্য করেন। তা না হলে ছাত্র জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লব ব্যর্থ ও বেহাত হয়ে যাবে। 

লেখক: সাংবাদিক 
৭ আগস্ট ২০২৪