লোকলোকার্নো শর্টস উইক ২০২৪ বিখ্যাত লোকার্নো ফিল্ম ফেস্টিভালের অনলাইন সংস্করণ। এখানে ফেব্রুয়ারির ২৯ দিন ধরে ২৯টা ছবি বিনামূল্যে দেখার সুযোগ দেওয়া হয়। এবারের ছবিগুলো মূল উৎসবের ৭৫তম আসরে দেখানো ছবি। বিশ্বের নানা জায়গার বিচিত্র বিষয়ের এই স্বল্পদৈর্ঘ্য ফিকশন ও ডকুমেন্টারি দেখার অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে ভাগ করে নিচ্ছি।
"ওহাস দে কা" বা "কায়ের পাতারা"
কোন সন্দেহ নেই: রাষ্ট্র জরুরী প্রয়োজনীয় সংগঠন, কিন্তু যুগপৎভাবে এটি নিপীড়নের অনন্য কাঠামোও বটে। আইন, আদালত, সামরিক-আধাসামরিক বাহিনী সমস্তের কাজ বিদ্যমান পদ্ধতি টিকিয়ে রাখা। কোথাও প্রতিরোধের সামান্য চিহ্ন পর্যন্ত দৃশ্যমান হলে রাষ্ট্র সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। এই ছবিতে দৃশ্যের পর দৃশ্যে চিত্রিত হয় রাষ্ট্রীয় জুলুমের স্বরূপ।
২০১৮ সালের এপ্রিলে নিকারাগুয়ার স্বৈরাচারী দানিয়েল ওর্তেগার বিরুদ্ধে আন্দোলনরতদের উপর রাষ্ট্রীয় অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়; দুঃশাসনের শিকার কতিপয় মহিলার সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় এই ছবি।
প্রতিরোধের প্রথম সোপান প্রতিবাদ। তাই হয়ত মায়ের নিষেধ স্বত্বেও স্কুল ছাত্রী কা স্বৈরাচার বিরোধী মিছিলে হাজির হয়। পুলিশ ঘেরাও করে ফেলে। নির্বিচার গুলিবর্ষণে তার তিন বন্ধু অকুস্থলে নিহত হয়; গ্রেপ্তার হয় কা! অর্থহীন জিজ্ঞাসাবাদের আরম্ভ! স্বীকারোক্তির জন্য চাপ। ধর্ষণ! ধর্ষণ কেবল ধর্ষকামী যৌনতার ফল নয়; বরং এটা ক্ষমতার দাপটের প্রকাশ ও ঘোষণা হয়ে আসে।
একসময় হুমকিসহ মুক্তি মেলে! আজীবন যন্ত্রণা ও গ্লানি সঙ্গী হয়। তবু বেঁচে থাকাই সত্য। এই ছবির আরেকটি গভীর দিক: নায়িকার ধর্ষণের শিকার হয়েও ধর্ষিতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত হতে না চাওয়ার অঙ্গীকার, এবং জীবনে এগিয়ে যাওয়া অব্যাহত রাখা! এই ছবির শেষ কথা: যখন প্রকাশ্যে অস্ত্র ধারণ করা অসম্ভবপর হয়, তখনও যেন বোবাযুদ্ধ জারী থাকে; এতেই নিহিত থাকবে ভবিষ্যতে প্রতিরোধের অঙ্কুর।
অ্যাগুই
সাগরপাড়ের জেলে-জেলেনীর গল্প "অ্যাগুই"
অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রীকে ফেলে রেখে পরিবারের উন্নত জীবনের আশায় সাগর পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গমন করে জেলে। যাওয়ার আগে নাম রেখে যায় সন্তানের নাম অ্যাগুই।
এই গল্প প্রেমের। এই গল্প অপেক্ষার। এই গল্প ফিরে না আসার। এই গল্প বেঁচে থাকতে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু আস্থার। এই গল্প প্রার্থনার। এই গল্প আশা প্রদীপ বন্ধ হতে না দেওয়ার।
অ্যাসতেরিয়ন
অ্যাসতেরিয়ন এক ভীষণ ছবি। আচরাচর স্তব্ধ করা নীরবতার ভেতর ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠা হাহাকারের সঙ্গীত শুনে উঠি আমরা। একটি ষাড় তার বন্দীদশা হতে মুক্তি পেতে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়। মৃত্যুকে পরাজিত করতে গিয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নেয়। একদম পিনপতন নিস্তব্ধতাময় ছবি; কিন্তু অনুপস্থিত শব্দের কোলাহলেরা ঠিকই ভিড় করে বসে আমাদের মনের কানে। শব্দহীন হয়েও এক তীব্র আর্তনাদ আমাদের বিবশ করে বসে।
ড্যান্সিং কালারস
"ড্যান্সিং কালারস" ছবিতে সমাজ ও জীবনের প্রতি পরিহাসের বয়ানে ইন্দোনেশিয়ার সমকালীন সমাজচিত্রের একটা টুকরো দেখতে পাই।
পরিবারের ধারণা নৃত্যপাগল ডিকাকে নিশ্চয়ই জ্বিনে ধরেছে! অতঃপর চিকিৎসা! জ্বিন ছাড়ানোর জন্য ডাকো পেশাদার জ্বিন তাড়ানিয়া মৌলানা! মন্ত্রে মন্ত্রে ডিকার কাঁপাকাঁপি। ডিকার জ্বিন ছাড়ল! পরে দেখা গেল পুরোটাই ছিল পারফরম্যান্স!
ডে ময়েশকংগ্রেস
"ডে ময়েশকংগ্রেস" বা "নিউট মহাসভা" ছবিটি ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত কারেল চাপেকের ব্যঙ্গাত্মক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী "ভালকা'স মোকে" বা "নিউটদের সাথে যুদ্ধ" অবলম্বনে নির্মিত। একেবারে অনাটকীয় ও ডকুমেন্টারি ঢংয়ে নির্মিত ছবিটি যন্ত্র, নৈতিকতা, বাজার ব্যবস্থা ও জীবনের মর্ম ধরে টান দেয়।
হার্ডলি ওয়ার্কিং
"হার্ডলি ওয়ার্কিং" ছবিতে ভিডিও গেমের ভেতরের যে চরিত্রগুলো নিয়ে খেলা যায় না, অনেক সময় যাদের নাম পর্যন্ত থাকে না, তাদের বিষয় করে নির্মিত প্রামাণ্য ছবি। চরিত্রগুলো নিয়ত কত অকিঞ্চিৎকর কাজ করে যায়! দিনের পর দিন ক্লান্তিকর সব রুটিন কাজ বিরতিহীন করে যেতে থাকে তারা। যারা খেলেন, তারা এই চরিত্রগুলোর দিকে সামান্যতম মনোযোগ পর্যন্ত দেন না। পুঁজিবাদের প্রক্রিয়াতে যেমন সাধারণ মানুষ নামহীন সংখ্যায় পরিণত হয়ে পড়ে, এখানেও স্রেফ গল্পের সম্পূরক হয়েই থাকে তারা। ছবিতে নমুনা হিসেবে "রেড ডেড রিডেম্পশন ২" গেমটিকে ব্যবহার করা হয়।
মিসঅ্যালাইনড
ছয় মিনিটের এক অদ্ভুত নির্বাক, নিঃশব্দ নয়, অ্যানিমেশন ছবি "মিসঅ্যালাইনড" বা "এলোমেলো"। দৈনন্দিতায় জর্জরিত আমাদের জীবন কখনো আপাত তুচ্ছ ঘটনায়ও আন্দোলিত হয়। তুচ্ছ ঘটনাটি বড় কোন কিছুর সংকেতবাহী হয়ে ওঠে। গল্পের কুশীলব: একটি করে মানব, মানবী, টিকটিকি ও কয়েকটি মাছি।
ছবিটি ইতালো কালভিনোর টিকটিকির পেট গল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত। গল্পে দেখা যায়: টিকটিকির মাছিকে গলাধঃকরণ চেষ্টা দেখে নিজেকে অসহায় মাছির জায়গায় কল্পনা করে নর ও নারী এক ধরণের অস্তিত্বের সংকটে ভোগে৷ কিন্তু ছবিতে আমরা অন্য গল্প প্রত্যক্ষ করে উঠি।
মধুরতম সম্পর্কও দৈনন্দিনতায় বিরক্তিকর হয়ে ওঠে; বিরক্তি সংযোগহীনতার দিকে ঠেলে দেয়। একাকিত্বের জন্ম হয়। অতঃপর প্রেমহীনতা। কোন এক পক্ষ সংযোগ চেষ্টা অব্যাহত রাখলে অন্যপক্ষ সাড়া না-ও দিতে পারে৷ এখানে যেমন নারীটির মধ্যে সংযোগহীন হয়ে ওঠা সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা দেখা যায়। বারবার নানান কর্মকাণ্ডে সামনে আসতে থাকে নারী। কখনো কোন পানীয় নাড়ার সময় কাপ-চামচের বাড়তি টুংটাং, কখনো ব্যায়ামের অজুহাতে পুরুষটির চারপাশে ঘোরাঘুরি। কিন্তু সেই উপক্রম যেন মাছি হয়ে বিরক্ত করতে থাকে মানবকে। সম্পর্কের এই চূড়ান্ত সংযোগহীনতা আমাদের কোথায় নিয়ে যায়?
রোজকার দিন গুজরানের যে গ্লানি, তা আমাদেন ভীত, ধৈর্যহীন, জেদী ও মারমুখো করে দিতে পারে।
তাকো সে ইয়ে কনচালো পোলেতে
"তাকো সে ইয়ে কনচালো পোলেতে" বা "যেভাবে গ্রীষ্ম কাটল"
শহরের আকাশে উড়োজাহাজের হুলুস্থুল প্রদর্শনী শুরু হল বলে। রাতের শিফটের ডিউটি সেরে এসে ঘুমাতে পারছে না লোকটি। ইভা নাম্নী এক পূর্ব পরিচিত তরুণী এসে সঙ্গ দেয়। একসাথে জঙ্গলে জলের কিনারে যায়। এতদূর পর্যন্ত বুঝতে অসুবিধা হয় না তাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক আছে। তবে সম্পর্কের প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হতে পারি না। তরুণী তার চাকরি হারানোর গল্প করে। সেই সময় সেখানে এক চৌকস যুবক আসে। ছবির শেষে আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না জঙ্গলে জলের কিনারে ঠিক কী হয়েছিল। ইভা ও চৌকস যুবকের চোখের ভাষায় ধারণা করা যায় তারা পরস্পরের প্রতি আকর্ষিত। যুবক ও ইভা জঙ্গলের আরেকটু গভীরে যায়।
এরপর ছবিটার গল্পের মোড়ক উন্মোচন হয় দ্ব্যর্থকভাবে। একাকিত্বের বোধ দিয়ে ছবিটা শেষ হলেও ইভা ও নায়কের আলিঙ্গনে একটা বোঝাপড়া ও আশ্বাসের স্পর্শ ছিল।
ইল ফো হগার্দে ল্য ফু উ ভুলেহ্ দ্যদঁ
আগুন ভয়াবহ, কিন্তু সেই আগুনই বিদ্রোহ উসকে দেয়। "ইল ফো হগার্দে ল্য ফু উ ভুলেহ্ দ্যদঁ" বা "আগুন দেখো, কিংবা তাতে পুড়ে যাও" ছবিতে আমরা প্রত্যক্ষ করে উঠি আধুনিক মানুষের মনোবিকলনের এক অনন্য চিত্র।
কখনো কখনো সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার তীব্র একটা বাসনা আমাদের সবাইকেই পেয়ে বসে। হঠাৎ মনে হয়ে ওঠে: আমি যা চাই, যেভাবে চাই অন্যরা এক হয়ে, পরিকল্পনা করে, ষড়যন্ত্র করে আমার চাওয়াগুলোকে মিথ্যা করে দিচ্ছে। এরকম ইচ্ছে হয়েছে এই ছবির নায়িকারও। এসব পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদের সংবরণ করি; ইনি করেননি। এই আগুন নায়িকাকে শান্তি দেয়। তাই তিনি মন্ত্রের মতো বলে উঠতে পারেন:
"একজনই দয়িত আমার
সে প্রজ্বলিত অগ্নি
যে কেবল বাড়তে থাকে দাউ দাউ দাউ
আর সমস্ত চরাচর হয় দগ্ধ
এই অশ্রু থামে কেবল ওই স্ফুলিঙ্গে।"
লোম্ব দে প্যাপিয়ঁ
এক অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্নালু ও আপাত অর্থহীন অ্যানিমেশন ছবি "লোম্ব দে প্যাপিয়ঁ" বা "প্রজাপতির ছায়া"। পরিচালক কোন ধারাবাহিক গল্প বলতে চাননি; অতিব্যক্তিগত স্বপ্ন ও হতাশাকে এমন ট্রিটমেন্ট দিয়েছেন যাতে বিষাদ, স্মৃতিমেদুরতা, বাসনা ও আশাকে সচল চিত্রে অনূদিত হতে দেখা যায়।
মিনি-মিনি-পোক্কে নো ওকিনা নিউয়া দে
"মিনি-মিনি-পোক্কে নো ওকিনা নিউয়া দে" বা "পুঁচকে পকেটের ভেতরে বিরাট মাঠ" একটি জাপানি অ্যানিমেশন ছবি। বৃহতের নজরের বাইরে ক্ষুদ্রের যে হরিষ ও বিষাদের বিরাট এক অস্তিত্ব বিরাজ করে।
অন্যান্য ছবিগুলো
এছাড়া "শন্ত পুহ্ লা ভিল অঁফোয়ি" বা "মৃত নগরীর জন্য কান্না" নামে একটি জরুরী প্রামাণ্য ছবি দেখানো হয়। "ফাচ্চা দি কুশ্শিনো" বা "বালিশমুখো" নিষ্পাপ কৈশোর, বয়ঃসন্ধিকালীন প্রবণতা, অহম ও সঙ্গকে বিষয় করেছে। হার্ট ফ্রুট নাগরিক জীবনের হাহাকারের কাছ থেকে পলায়নপর মানুষ কিভাবে মুক্তি খুঁজে নেয়, সেই গল্প বলার চেষ্টা করে৷ "লেইক অব ফায়ার" বা "আগুন পুকুর" জীবন ও মৃত্যুর টানাপোড়েন নিয়ে গল্প। দুই নারীর সমপ্রেম ও জীবন দর্শন নিয়ে ফার্সি, জার্মান ও ইংরেজি ত্রিভাষিক ছবি "মডার তামাম রুজ দোয়া মিখানাদ" বা "মা সারাদিন নামাজ পড়ে"। প্যারাদিসো, ৩১, ১০৮ প্রামাণ্য ছবিতে দেখি যুদ্ধের ভয়াবহতায় মানুষ কতটা শান্ত যান্ত্রিক নিরাবেগভাবে হত্যা ও ধ্বংস চালাতে পারে।
"ওহাস দে কা" বা "কায়ের পাতারা"
কোন সন্দেহ নেই: রাষ্ট্র জরুরী প্রয়োজনীয় সংগঠন, কিন্তু যুগপৎভাবে এটি নিপীড়নের অনন্য কাঠামোও বটে। আইন, আদালত, সামরিক-আধাসামরিক বাহিনী সমস্তের কাজ বিদ্যমান পদ্ধতি টিকিয়ে রাখা। কোথাও প্রতিরোধের সামান্য চিহ্ন পর্যন্ত দৃশ্যমান হলে রাষ্ট্র সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। এই ছবিতে দৃশ্যের পর দৃশ্যে চিত্রিত হয় রাষ্ট্রীয় জুলুমের স্বরূপ।
২০১৮ সালের এপ্রিলে নিকারাগুয়ার স্বৈরাচারী দানিয়েল ওর্তেগার বিরুদ্ধে আন্দোলনরতদের উপর রাষ্ট্রীয় অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়; দুঃশাসনের শিকার কতিপয় মহিলার সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় এই ছবি।
প্রতিরোধের প্রথম সোপান প্রতিবাদ। তাই হয়ত মায়ের নিষেধ স্বত্বেও স্কুল ছাত্রী কা স্বৈরাচার বিরোধী মিছিলে হাজির হয়। পুলিশ ঘেরাও করে ফেলে। নির্বিচার গুলিবর্ষণে তার তিন বন্ধু অকুস্থলে নিহত হয়; গ্রেপ্তার হয় কা! অর্থহীন জিজ্ঞাসাবাদের আরম্ভ! স্বীকারোক্তির জন্য চাপ। ধর্ষণ! ধর্ষণ কেবল ধর্ষকামী যৌনতার ফল নয়; বরং এটা ক্ষমতার দাপটের প্রকাশ ও ঘোষণা হয়ে আসে।
একসময় হুমকিসহ মুক্তি মেলে! আজীবন যন্ত্রণা ও গ্লানি সঙ্গী হয়। তবু বেঁচে থাকাই সত্য। এই ছবির আরেকটি গভীর দিক: নায়িকার ধর্ষণের শিকার হয়েও ধর্ষিতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত হতে না চাওয়ার অঙ্গীকার, এবং জীবনে এগিয়ে যাওয়া অব্যাহত রাখা! এই ছবির শেষ কথা: যখন প্রকাশ্যে অস্ত্র ধারণ করা অসম্ভবপর হয়, তখনও যেন বোবাযুদ্ধ জারী থাকে; এতেই নিহিত থাকবে ভবিষ্যতে প্রতিরোধের অঙ্কুর।
অ্যাগুই
সাগরপাড়ের জেলে-জেলেনীর গল্প "অ্যাগুই"
অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রীকে ফেলে রেখে পরিবারের উন্নত জীবনের আশায় সাগর পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গমন করে জেলে। যাওয়ার আগে নাম রেখে যায় সন্তানের নাম অ্যাগুই।
এই গল্প প্রেমের। এই গল্প অপেক্ষার। এই গল্প ফিরে না আসার। এই গল্প বেঁচে থাকতে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু আস্থার। এই গল্প প্রার্থনার। এই গল্প আশা প্রদীপ বন্ধ হতে না দেওয়ার।
অ্যাসতেরিয়ন
অ্যাসতেরিয়ন এক ভীষণ ছবি। আচরাচর স্তব্ধ করা নীরবতার ভেতর ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠা হাহাকারের সঙ্গীত শুনে উঠি আমরা। একটি ষাড় তার বন্দীদশা হতে মুক্তি পেতে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়। মৃত্যুকে পরাজিত করতে গিয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নেয়। একদম পিনপতন নিস্তব্ধতাময় ছবি; কিন্তু অনুপস্থিত শব্দের কোলাহলেরা ঠিকই ভিড় করে বসে আমাদের মনের কানে। শব্দহীন হয়েও এক তীব্র আর্তনাদ আমাদের বিবশ করে বসে।
ড্যান্সিং কালারস
"ড্যান্সিং কালারস" ছবিতে সমাজ ও জীবনের প্রতি পরিহাসের বয়ানে ইন্দোনেশিয়ার সমকালীন সমাজচিত্রের একটা টুকরো দেখতে পাই।
পরিবারের ধারণা নৃত্যপাগল ডিকাকে নিশ্চয়ই জ্বিনে ধরেছে! অতঃপর চিকিৎসা! জ্বিন ছাড়ানোর জন্য ডাকো পেশাদার জ্বিন তাড়ানিয়া মৌলানা! মন্ত্রে মন্ত্রে ডিকার কাঁপাকাঁপি। ডিকার জ্বিন ছাড়ল! পরে দেখা গেল পুরোটাই ছিল পারফরম্যান্স!
ডে ময়েশকংগ্রেস
"ডে ময়েশকংগ্রেস" বা "নিউট মহাসভা" ছবিটি ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত কারেল চাপেকের ব্যঙ্গাত্মক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী "ভালকা'স মোকে" বা "নিউটদের সাথে যুদ্ধ" অবলম্বনে নির্মিত। একেবারে অনাটকীয় ও ডকুমেন্টারি ঢংয়ে নির্মিত ছবিটি যন্ত্র, নৈতিকতা, বাজার ব্যবস্থা ও জীবনের মর্ম ধরে টান দেয়।
হার্ডলি ওয়ার্কিং
"হার্ডলি ওয়ার্কিং" ছবিতে ভিডিও গেমের ভেতরের যে চরিত্রগুলো নিয়ে খেলা যায় না, অনেক সময় যাদের নাম পর্যন্ত থাকে না, তাদের বিষয় করে নির্মিত প্রামাণ্য ছবি। চরিত্রগুলো নিয়ত কত অকিঞ্চিৎকর কাজ করে যায়! দিনের পর দিন ক্লান্তিকর সব রুটিন কাজ বিরতিহীন করে যেতে থাকে তারা। যারা খেলেন, তারা এই চরিত্রগুলোর দিকে সামান্যতম মনোযোগ পর্যন্ত দেন না। পুঁজিবাদের প্রক্রিয়াতে যেমন সাধারণ মানুষ নামহীন সংখ্যায় পরিণত হয়ে পড়ে, এখানেও স্রেফ গল্পের সম্পূরক হয়েই থাকে তারা। ছবিতে নমুনা হিসেবে "রেড ডেড রিডেম্পশন ২" গেমটিকে ব্যবহার করা হয়।
মিসঅ্যালাইনড
ছয় মিনিটের এক অদ্ভুত নির্বাক, নিঃশব্দ নয়, অ্যানিমেশন ছবি "মিসঅ্যালাইনড" বা "এলোমেলো"। দৈনন্দিতায় জর্জরিত আমাদের জীবন কখনো আপাত তুচ্ছ ঘটনায়ও আন্দোলিত হয়। তুচ্ছ ঘটনাটি বড় কোন কিছুর সংকেতবাহী হয়ে ওঠে। গল্পের কুশীলব: একটি করে মানব, মানবী, টিকটিকি ও কয়েকটি মাছি।
ছবিটি ইতালো কালভিনোর টিকটিকির পেট গল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত। গল্পে দেখা যায়: টিকটিকির মাছিকে গলাধঃকরণ চেষ্টা দেখে নিজেকে অসহায় মাছির জায়গায় কল্পনা করে নর ও নারী এক ধরণের অস্তিত্বের সংকটে ভোগে৷ কিন্তু ছবিতে আমরা অন্য গল্প প্রত্যক্ষ করে উঠি।
মধুরতম সম্পর্কও দৈনন্দিনতায় বিরক্তিকর হয়ে ওঠে; বিরক্তি সংযোগহীনতার দিকে ঠেলে দেয়। একাকিত্বের জন্ম হয়। অতঃপর প্রেমহীনতা। কোন এক পক্ষ সংযোগ চেষ্টা অব্যাহত রাখলে অন্যপক্ষ সাড়া না-ও দিতে পারে৷ এখানে যেমন নারীটির মধ্যে সংযোগহীন হয়ে ওঠা সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা দেখা যায়। বারবার নানান কর্মকাণ্ডে সামনে আসতে থাকে নারী। কখনো কোন পানীয় নাড়ার সময় কাপ-চামচের বাড়তি টুংটাং, কখনো ব্যায়ামের অজুহাতে পুরুষটির চারপাশে ঘোরাঘুরি। কিন্তু সেই উপক্রম যেন মাছি হয়ে বিরক্ত করতে থাকে মানবকে। সম্পর্কের এই চূড়ান্ত সংযোগহীনতা আমাদের কোথায় নিয়ে যায়?
রোজকার দিন গুজরানের যে গ্লানি, তা আমাদেন ভীত, ধৈর্যহীন, জেদী ও মারমুখো করে দিতে পারে।
তাকো সে ইয়ে কনচালো পোলেতে
"তাকো সে ইয়ে কনচালো পোলেতে" বা "যেভাবে গ্রীষ্ম কাটল"
শহরের আকাশে উড়োজাহাজের হুলুস্থুল প্রদর্শনী শুরু হল বলে। রাতের শিফটের ডিউটি সেরে এসে ঘুমাতে পারছে না লোকটি। ইভা নাম্নী এক পূর্ব পরিচিত তরুণী এসে সঙ্গ দেয়। একসাথে জঙ্গলে জলের কিনারে যায়। এতদূর পর্যন্ত বুঝতে অসুবিধা হয় না তাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক আছে। তবে সম্পর্কের প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হতে পারি না। তরুণী তার চাকরি হারানোর গল্প করে। সেই সময় সেখানে এক চৌকস যুবক আসে। ছবির শেষে আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না জঙ্গলে জলের কিনারে ঠিক কী হয়েছিল। ইভা ও চৌকস যুবকের চোখের ভাষায় ধারণা করা যায় তারা পরস্পরের প্রতি আকর্ষিত। যুবক ও ইভা জঙ্গলের আরেকটু গভীরে যায়।
এরপর ছবিটার গল্পের মোড়ক উন্মোচন হয় দ্ব্যর্থকভাবে। একাকিত্বের বোধ দিয়ে ছবিটা শেষ হলেও ইভা ও নায়কের আলিঙ্গনে একটা বোঝাপড়া ও আশ্বাসের স্পর্শ ছিল।
ইল ফো হগার্দে ল্য ফু উ ভুলেহ্ দ্যদঁ
আগুন ভয়াবহ, কিন্তু সেই আগুনই বিদ্রোহ উসকে দেয়। "ইল ফো হগার্দে ল্য ফু উ ভুলেহ্ দ্যদঁ" বা "আগুন দেখো, কিংবা তাতে পুড়ে যাও" ছবিতে আমরা প্রত্যক্ষ করে উঠি আধুনিক মানুষের মনোবিকলনের এক অনন্য চিত্র।
কখনো কখনো সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার তীব্র একটা বাসনা আমাদের সবাইকেই পেয়ে বসে। হঠাৎ মনে হয়ে ওঠে: আমি যা চাই, যেভাবে চাই অন্যরা এক হয়ে, পরিকল্পনা করে, ষড়যন্ত্র করে আমার চাওয়াগুলোকে মিথ্যা করে দিচ্ছে। এরকম ইচ্ছে হয়েছে এই ছবির নায়িকারও। এসব পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদের সংবরণ করি; ইনি করেননি। এই আগুন নায়িকাকে শান্তি দেয়। তাই তিনি মন্ত্রের মতো বলে উঠতে পারেন:
"একজনই দয়িত আমার
সে প্রজ্বলিত অগ্নি
যে কেবল বাড়তে থাকে দাউ দাউ দাউ
আর সমস্ত চরাচর হয় দগ্ধ
এই অশ্রু থামে কেবল ওই স্ফুলিঙ্গে।"
লোম্ব দে প্যাপিয়ঁ
এক অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্নালু ও আপাত অর্থহীন অ্যানিমেশন ছবি "লোম্ব দে প্যাপিয়ঁ" বা "প্রজাপতির ছায়া"। পরিচালক কোন ধারাবাহিক গল্প বলতে চাননি; অতিব্যক্তিগত স্বপ্ন ও হতাশাকে এমন ট্রিটমেন্ট দিয়েছেন যাতে বিষাদ, স্মৃতিমেদুরতা, বাসনা ও আশাকে সচল চিত্রে অনূদিত হতে দেখা যায়।
মিনি-মিনি-পোক্কে নো ওকিনা নিউয়া দে
"মিনি-মিনি-পোক্কে নো ওকিনা নিউয়া দে" বা "পুঁচকে পকেটের ভেতরে বিরাট মাঠ" একটি জাপানি অ্যানিমেশন ছবি। বৃহতের নজরের বাইরে ক্ষুদ্রের যে হরিষ ও বিষাদের বিরাট এক অস্তিত্ব বিরাজ করে।
অন্যান্য ছবিগুলো
এছাড়া "শন্ত পুহ্ লা ভিল অঁফোয়ি" বা "মৃত নগরীর জন্য কান্না" নামে একটি জরুরী প্রামাণ্য ছবি দেখানো হয়। "ফাচ্চা দি কুশ্শিনো" বা "বালিশমুখো" নিষ্পাপ কৈশোর, বয়ঃসন্ধিকালীন প্রবণতা, অহম ও সঙ্গকে বিষয় করেছে। হার্ট ফ্রুট নাগরিক জীবনের হাহাকারের কাছ থেকে পলায়নপর মানুষ কিভাবে মুক্তি খুঁজে নেয়, সেই গল্প বলার চেষ্টা করে৷ "লেইক অব ফায়ার" বা "আগুন পুকুর" জীবন ও মৃত্যুর টানাপোড়েন নিয়ে গল্প। দুই নারীর সমপ্রেম ও জীবন দর্শন নিয়ে ফার্সি, জার্মান ও ইংরেজি ত্রিভাষিক ছবি "মডার তামাম রুজ দোয়া মিখানাদ" বা "মা সারাদিন নামাজ পড়ে"। প্যারাদিসো, ৩১, ১০৮ প্রামাণ্য ছবিতে দেখি যুদ্ধের ভয়াবহতায় মানুষ কতটা শান্ত যান্ত্রিক নিরাবেগভাবে হত্যা ও ধ্বংস চালাতে পারে।