ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর বল প্রয়োগ ও কূটকৌশলের মাধ্যমে বাংলা বিহার উড়িষ্যা ছাড়াও সমগ্র ভারতবর্ষে তাদের শাসন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ভারতবাসী ব্রিটিশ শাসন শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। ব্রিটিশ বিরোধী সকল আন্দোলনে বাঙালিদের গৌরবময় ভূমিকা ছিলো। ১৯৪৭ সালের ৩ জুনের 'মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা' অনুযায়ী ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই আইন পাশ করে যা 'ভারত স্বাধীনতা আইন' নামে পরিচিত।
'ভারত স্বাধীনতা আইন' অনুযায়ী ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হয়। ১৯৪৭ সালে সুদীর্ঘ প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রে তৈরি হয় সংকট। ফলে পাকিস্তানের একটি অংশ অন্য অংশের দ্বারা শোষিত হয়। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা নিগৃহীত ও শোষিত হতে থাকে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর "দ্বি-জাতি তত্ত্ব বা Two Nation Theory"র ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এক হাজার মাইলেরও অধিক দূরে ছিলো। শুধু ভৌগোলিক দূরত্বই নয় পাকিস্তানের দুই অংশের মানুষের মধ্যেও ছিলো ব্যাপক অমিল। ভাষাগত, সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক কোন মিল ছিলো না। শুধুমাত্র ধর্ম ছাড়া।
১৯৪৭ সালে যখন দেশ ভাগ হলো তখন নতুন দেশ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এই প্রশ্নে নির্ধারণ করা হলো উর্দু ভাষাকে যা ছিলো সমগ্র পাকিস্তানের ৩.৩৭% লোকের ভাষা। এমনকি দেশ ভাগের পর মুসলিম লীগ সরকার অফিস আদালতের পাশাপাশি পোস্টকার্ড, খাম প্রভৃতি জিনিসে ইংরেজি ও উর্দু ভাষা ব্যবহার শুরু করে।
পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বলেন,
"পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু,
অপর কোন ভাষা নয়।"
একই বছর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আবারো জোর দিয়ে বলেন,
"উর্দু এবং শুধু উর্দুই হবে
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।"
জনসভা ও সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এই ঘোষণা শুনে তৎক্ষনাৎ উপস্থিত জনতা না না ধ্বনিতে প্রতিবাদ করে। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে সর্বদলীয় কর্মী সমাবেশে সকল রাজনৈতিক দলের সদস্যদের নিয়ে "সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কার্যকরী পরিষদ" গঠিত হয়। এ পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল, বিক্ষোভ-মিছিল ও সভা হবে। মুসলিম লীগ সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্ররা দশ জন করে মিছিল বের করে। শান্তিপূর্ণ এ মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ, কাঁদানেগ্যাস নিক্ষেপ ও গুলি চালায়। এতে অনেকে আহত ও নিহত হয়। আন্দোলন আরো তীব্র রুপ নেয়। মাতৃভাষার জন্য সর্বপ্রথম রক্ত দিয়েছে বাঙালিরা।
দেশ ভাগের সময় 'কংগ্রেস' নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন, "পাকিস্তান রাষ্ট্র ২৫ বছরের মধ্যে ভেঙে যাবে।" তার ভবিষ্যৎ বাণী সত্য হয়েছিলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের মাধ্যমে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে একুশে ফেব্রুয়ারি। শত্রুদের বিপক্ষে মাথা তুলে দাড়াতে শিখিয়েছে।
১৯৫৪ সালে একুশের শক্তিকে কাজে লাগিয়েছিলো যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্টের নেতাগণ ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদদের স্মৃতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তাদের কর্মসূচিকে ২১টি দফায় লিপিবদ্ধ করেন। যেখানে ১ম দফা ছিলো "বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা।" ২১ দফা সামনে রেখেই নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা করে যুক্তফ্রন্ট। নির্বাচনে জয়লাভ করে যুক্তফ্রন্ট।
ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং তাদের ত্যাগের কথা চিন্তা করে আমরা একুশকে শক্তিতে রুপান্তর করবো। সমাজের সকল অপকর্ম বন্ধে ঐক্যবদ্ধ হবো।
~ মুহাম্মদ আল ইমরান।