পোস্টস

চিন্তা

বৈষম্যের বিষাক্ত বীজ: সমাজের ক্ষয় ও সমাধানের পথ

১১ আগস্ট ২০২৪

দেলোয়ার হোসেন সবুজ

মুহূর্তেই ফেয়ারনেস হ্যান্ডসাম! সত্যি কি তাই ? নাকি পূর্বের ন্যায় এখনও আমাদের অস্থিমজ্জায় কলোনিজমে আড়ষ্ট ? ত্বক নিয়ে ফর্সা হওয়ার রাজনীতি তথা বর্ণবাদ নীতি আমাদের মানব সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে শিরায়- উপশিরায় , শাখায়-প্রশাখায় বহুকাল ধরে প্রবাহিত হয়ে আসছে এবং বর্তমানেও প্রবাহিত। কথিত আছে , বহুকাল আগ থেকে মানুষ সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য সীসা ব্যবহারের মাধ্যমে নিজ জীবনকে করেছেন উচ্ছন্ন।সুদীর্ঘ কাল ধরে চলে আসছে রূপচর্চার পণ্যসামগ্রীর রমরমা ব্যাবসা , বাজারে ছড়াছড়ি দিয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে অসংখ্য সৌন্দর্য বর্ধনের সামগ্রী। তদ্রুপ, বিশ্ব সাদা চামড়ার মানুষ দ্বারা কালো চামড়ার মানুষদের উপর অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন, শোষণ , বৈষম্য ও পাশবিক আচরনের শিকারের সাক্ষী হয়েছে বারংবার। গায়ের রং কালো হওয়ার দরুন ৮০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গদের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩৪২ বছর ধরে শ্বেতাঙ্গদের শাসন ও শোষণ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি করা বৈষম্য, অন্যায়, অত্যাচার এবং নিপিড়নের ইতিহাসের রেশ এখনও কাটেনি। মানবাধিকারের বড় বড় বুলি আওড়ানো ,মানুষের অধিকারের কথা বলে বিশ্বকে সবক দেওয়া পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতেও দেখা মিলে বর্ণবাদের করাল গ্রাস।

 

সমাজে শুধু যে সাদা চামড়া এবং কালো চামড়ার বৈষম্য বিদ্যমান তা নয় বরং বৈষম্যের বিষ বাষ্পের প্রসার ব্যাপক । শ্রেণী বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্য , রাজনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষাগত বৈষম্য, সাংস্কৃতিক বৈষম্য, কর্মসংস্থান বৈষম্য এবং বয়স ভিত্তিক বৈষম্য সহ বিভিন্ন বৈষম্যের বিষে জর্জরিত বর্তমান সভ্যতা ও সমাজব্যবস্থা।

 

ধনী ব্যক্তিটিই আজ টাকার জোরে হয়ে উঠছে সমাজের মধ্যমণি , পৌঁছে যায় ভোগবাদের চরম পর্যায়ে, ভুলে যায় সমাজের দরিদ্র,কাঙ্গাল ও হতভাগাদের অধিকার, হারিয়ে ফেলে সমাজের দরিদ্রদের প্রতি উদার মানবিকতা ও সহমর্মিতার ভাষা, হয়ে উঠে রক্ষক নামের ভক্ষক, করে সমস্ত কাঙালীর ধন চুরি। চালায় বৈষম্যের স্টিমরোলার দরিদ্রদের প্রতি, ভাঙতে চায় সমস্ত আইন কানুন রীতিনীতি যেগুলো কল্যাণকর দরিদ্রদের প্রতি। খুঁজে বেড়ায় আইনের ফাঁক ফোকর, টাকার জোরে হলেও হতে পারে সাত খুন মাফ !অন্যদিকে , গরীব, হতভাগা ও হতদরিদ্ররা দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্রে পরিশ্রান্ত। বৈষম্যের সুবিশাল পাথর ভাঙতে আর দুবেলা দুমুঠো খাবার সহ যৎসামান্য মৌলিক অধিকার এবং সম্মানের সাথে বাঁচতে তারা ক্লান্ত,পথের পথিক। তাদের দেখা যায় ত্রাণ আনতে গিয়ে , যাকাত নিতে গিয়ে এবং কুলখানিতে গিয়ে পায়ে পদদলিত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে; মিথ্যা মামলায় টাকার অভাবে ভালো উকিল ধরতে না পারায় বিনা অপরাধে বছরের পর বছর সাজা ভোগ করতে; শিক্ষা লাভের যাত্রায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে । কেউ বা নানা ঘাত-প্রতিঘাত, বৈষম্য সহ্য করে প্রচণ্ড ইচ্ছা শক্তি আর উদ্যমের সাথে দেশপ্রেম, দেশ সেবা , দেশের সিস্টেম পরিবর্তন করার আশায় ব্যক্ত হয়ে নিজ দুঃখ লাগব ও জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের নিমিত্তে হন্যে হয়ে বাঁচা মরা উপেক্ষা করে নেমে পড়ে চাকরি অথবা ক্যারিয়ারের পিছনে। কিন্তু বিধিবাম, তাদের সমস্ত আশা ভরসা ধুলিস্যাৎ হয় ; যখন দেখে চাকরি নামক মরীচিকা বাজারে ঘুষ, মামা-খালুর সুপারিশ না থাকার দরুন তাদের সারা জীবনের পরিশ্রম, সাধনা, ও মেধা অন্তঃসারশূন্য।কেউ বা ব্যবসা বাণিজ্যে করার অভিপ্রায়ে , উদ্যোক্তা হওয়ার আশায় ব্যাংক ঋণের বিভিন্ন জটিলতায় অনুধাবন এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করবে – কিন্তু কেন, কীভাবে এবং কী উপায়ে দুর্নীতিবাজ, ঋণ খেলাপি এবং টাকা পাচারকারীরা ঋণ পায়?; দেশের বাইরে টাকা পাচার করে ; দশের অধিকার হরণ করে স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য দেশ ও দেশের জনগণকে ধোঁকা দেয়, প্রতারিত করে। এমনকি জীবনের কোন একটি পর্যায়ে , সরকারি হাসপাতালে গিয়ে যখন একটা বেডের প্রয়োজন পড়বে তখনও তারা খানিকটা মর্মাহত হবে, গরিবের জন্য তৈরি করা হাসপাতালের বেডটাও আজ গরীবের জন্য সোনার হরিণ, এইখানেও রাঘব বোয়াল এবং ধনী গুষ্টির আধিপত্য!

 

সমাজে নারী পুরুষের বৈষম্য পূর্বের তুলনায় কিছুটা হ্রাস পেলেও প্রান্তিক দরিদ্র্য ঘরের মেয়ের জন্য তা সমভাবে প্রযোজ্য নয়। বর্তমানেও আমাদের সমাজে অনেক অবহেলিত নিষ্পেষিত নারী বিদ্যমান, যারা কিনা পরিবার, স্বামীগৃহ, সমাজ থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এখনও পরিবারে মেয়ে ও ছেলের ভিতরে ছেলেকে প্রাধান্য বেশি দেয়ার বিষয় চোখে পড়ে। যৌতুক প্রথার মত সামাজিক সমস্যার পাশাপাশি দেখা মিলে ঈদে, উৎসবে মেয়ের পক্ষ থেকে ছেলে পক্ষের অন্যায় আবদার। সমাজে কালো বর্ণের মেয়েদের অনেক উপেক্ষা বৈষম্যের মধ্যে পার হতে হয়, তাদের বিয়ে নিয়ে অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। সমাজে নারী পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক বৈষম্য এত প্রকট যে ,সমাজের মন জুগিয়ে চলতে নারী ছুটে চলে মেকআপের পিছনে আর সমাজ ছুটে মেকআপহীন চেহারার পিছনে নারীকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য ।

 

শিক্ষা ব্যাবস্থায় সাধারণভাবে লক্ষ্য করা যায়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্র ছাত্রীর মেধা আর পড়ালেখার প্রতি আগ্রহের থেকে তাদের বাবার পেশার গুরুত্ব মুখ্য হয়ে ওঠে । তুলনামূলক মেধা কম ছাত্র-ছাত্রীকে সেভাবে গুরুত্ব সহকারে দেখা হয় না যেমন টা দেখা হয় একজন মেধাবীকে।প্রায় অভিযোগ উঠতে দেখা যায়,শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়া ছাত্র ছাত্রীদের বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে । সরকারি, বেসরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, এমপিওভুক্ত এবং ননএমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ বিভিন্ন ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গুণগত শিক্ষা, ছাত্র-ছাত্রীদের মান উন্নয়ন কর্মসূচি, শিক্ষকদের বেতন ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধায় ব্যাপক বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়।অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত, শিক্ষক সংকট, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ ও পৃথক পরীক্ষা হলের অভাব, এবং প্রশাসন ও শিক্ষকদের অযাচিত সিদ্ধান্তের কারণে লাখ লাখ শিক্ষার্থী ভুক্তভোগী হচ্ছেন। এর ফলে তাদের সেশনজট দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং শিক্ষা গ্রহণে ব্যাঘাত ঘটছে।মাদরাসায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা থাকার পরও সরকারি চাকরির লাভের পর্যাপ্ত সুযোগের আশায় ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার দরুন অনেকেই দাখিল ও আলিম পাশ করে কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করছেন।চাকরির বাজারে অনেক সময় প্রার্থীর মেধা ও যোগ্যতা থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।

 

রাজনীতিতে বৈষম্যের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কিত । নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলোতে বিদ্যমান নিয়মকানুন , কোরাম, ব্যক্তিস্বার্থ , স্বজন প্রীতি , দুর্নীতি এবং নমিনেশন বাণিজ্যের দরুন প্রায়শই যোগ্য প্রার্থীরা নমিনেশন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। রাজনীতিতে নিবেদিতপ্রাণ, নেতার অনুগত আস্থাভাজন কর্মীটি দেশ সেবায় ব্রতী হয়ে নিজের পড়ালেখা, ক্যারিয়ার, পরিবারের মতামত কে অগ্রাহ্য করে, অনেক সময় রাজনৈতিক হামলা মামলার শিকার হয়ে অদৃষ্টের পরিহাস কে বরণ করে নেয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, যোগ্যতার চেয়ে প্রভাবের খেলাই বেশি ; দিন শেষে নেতার ছেলে বা আত্মীয়স্বজনকে নেতা হতে দেখা যায় ।অর্থ, আধিপত্য ও ক্ষমতার বলপূর্বক প্রয়োগে,রাজনীতির ‘র’ না জানা ব্যক্তিটিও আজ রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিতে পরিণত হচ্ছেন।রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থের তাণ্ডব ও সংঘাতে রাজপথে অসংখ্য সাধারণ মানুষ প্রাণ হারায়। প্রিয়জন হারানোর শোকে স্বজনদের আর্তনাদ বিরাজমান, কিন্তু অপরপক্ষ বিজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা থাকে। ক্ষমতার লোভে একদিন হাতে হাত, কোলাকুলি দিয়ে মিলিত হন তারা, কিন্তু প্রতিদান হিসেবে নিরীহ কর্মীদেরই বলি হতে হয়।

 

অনেক পরিবারে দেখা যায় যে, পরিবারের দায়িত্ববান সদস্যরা একাই সংসারের ভার বহন করেন, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ভরণপোষণ করে। কিন্তু এক সময় এই পরিবারেরই তারা অবমূল্যায়িত ও অবহেলিত হন। জায়গা, জমি ও সম্পত্তি ভাগবাঁটোয়ার বৈষম্যের জের ধরে দ্বন্দ্ব, কলহ ও সংঘাত দেখা দেয়, এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।অনেক কর্মক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয় যে, পুরুষ ও নারী একই কাজ করলেও পুরুষের তুলনায় নারীর বেতন অনেক কম। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বারা অধস্তন কর্মকর্তারা অবমূল্যায়িত, হয়রানি ও শোষণের শিকার হন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাগজে কলমে চুক্তিতে ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারিত থাকলেও নিজের চাকরি বাঁচানোর জন্য এবং পদোন্নতির আশায় অনেক কর্মকর্তাকে নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত কাজ করতে হয়।

 

পরিচিত ও অপরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যেও বৈষম্য উদীয়মান। দেখা যায়, কোন এক পর্যটন ভ্রমণ বা দর্শনীয় স্থানে স্থানীয় ব্যক্তির কাছে একজন ব্যবসায়ী যা বিক্রি করে, বাইরের ব্যক্তিদের কাছে তার থেকে অনেক বেশি দামে বিক্রি করছে।এক জেলার লোক যখন অন্য জেলায় বসবাস করতে যান, তখন তাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ দেখা যায়।প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া, ছিনতাই, ত্রাস, সন্ত্রাস এমনকি রাহাজানির শিকার হতে হয় অনেককে।বয়সের ক্ষেত্রেও বৈষম্য স্পষ্ট।বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কলেজে এবং এমনকি অনেক স্কুলেও জুনিয়র-সিনিয়র বিভাজনের মাধ্যমে জুনিয়রদের ম্যানার্স শেখানোর নামে র‍্যাগিং কর্মকাণ্ড চলছে। 

 

শিক্ষিত টাইটেল লাগানো , আত্মকেন্দ্রী, অবিবেচক, খামখেয়ালী, চতুর, কৌশলী, হৃদয়হীন, পাষাণ, দুর্জন জ্ঞানপাপী ব্যক্তিদের দ্বারাই সম্ভবত আজ জুলুম-নিপীড়ন ও বৈষম্যের ঘটনা বেশি ঘটছে।চারপাশে দুর্জন ব্যক্তিরা আজ শিক্ষাকে বৈষম্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য  তৎপর।যারা কিনা , কলমের কালির আঘাতে অন্যায়ভাবে দুর্বলের শেষ সম্বল ও জীবিকার উপর আঘাত হানতেও পিছপা হয় না। 

 

সমাজে বৈষম্যের প্রসার এত ব্যাপক যে বৈষম্য শিকার হওয়া ব্যক্তির বিরুদ্ধে এবং বৈষম্য করা ব্যক্তির পক্ষে আজকাল ফপর দালালি করার লোকের অভাব হয় না। স্বৈরাচারী, অন্যায়, শোষণকারী ও জুলুমকারী ব্যক্তিদের দ্বারা শোষিত, বঞ্চিত, উৎপীড়িত ও নিম্নশ্রেণীর মানুষ যখন শোষণের শিকার হয়, তখন কিছু লোক নিরপেক্ষ দর্শক হয়ে ট্র্যাজেডির সাক্ষী হওয়ার অমানবিক আনন্দ লাভ করে। অন্যদিকে, আরেকদল অন্যায়কারী ও বৈষম্যমূলক আচরণকারী ব্যক্তিদের পক্ষ নিয়ে তাদের সমর্থন করে। এই একই চিত্র আমাদের সমাজজীবনের প্রতিটি বৈষম্যের ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়। আমরা অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার চেয়ে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন এবং মৌন অবলম্বন করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কারণ, আমরা আত্মকেন্দ্রিক, আমাদের পরিবার আছে, তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব রয়েছে, আমাদের সময় কম, এবং কারো বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের রোষানল ও  চক্ষুশূল হতে আমরা বড্ড অপরাগ।কিন্তু আমরা বড়ই বিচিত্র ও অদ্ভুত, যখন কিনা আমরা নিজেরাই বৈষম্যের শিকার হই; তখন অন্য ব্যক্তিদের সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করি; অতঃপর , সবশেষ সমাজের নিন্দা করি।

 

মানব সমাজে বৈষম্য সার্বজনীন এবং সর্বগ্রাসী । অতীত সমাজ জীবন থেকেই বৈষম্য প্রবাহিত হয়ে আসছে, বর্তমানে যুগেও প্রবাহমান এবং ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে।কেন নয়,আমরা আকড়ে ধরি পুরানো ধ্যান ধারনার বৈষম্যের নীতি ,হলে হোক সেটা অকল্যাণকর সমগ্র মানব সমাজের প্রতি; হলেও হতে পারে নিজের লাভ এবং অন্যের ক্ষতি।পুঁজিবাদকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে সাম্যবাদ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গুলোতেও পরবর্তীতে শোষণ ও বৈষম্যের নীতি পরিলক্ষিত হয়। দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট, বর্ণ, বংশ, ধর্ম, জাতিগত ও ভাষাগত বৈষম্যে আড়ষ্ট ব্যক্তিটিও আজ বৈষম্যের বেড়াজাল ডিঙিয়ে সমাজের অনুকূল পরিবেশে অবস্থান করে, সুযোগ বুঝে অন্য আরেকজনের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করছে।আমরা নিজেদের ভিতর পার্থক্য এবং ভেদাভেদ দেখানোর মত বিষয় গুলো ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছি; মিথ্যা গৌরব অহংকারের বড়াই উড়াচ্ছি ;কার টাকা-পয়সা, ধন-সম্পত্তি, জায়গা-জমি, বাড়ি-গাড়ি বেশি , কার রাজনৈতিক আধিপত্য বেশি, কার বংশ মর্যাদা বেশি, কার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দক্ষতা বেশি, কে মেধাবী বেশি, এমনকি কার গায়ের জোর বেশি ইত্যাদি। অতঃপর, দুর্বলদের প্রতি শোষণ বৈষম্য করি এবং শক্তিশালী ধারা শোষণ বৈষম্যের শিকার হয়।


সমাজ স্বীকৃতি দিয়েছে বলেই আজ ধনী, বিত্তবান, জমিদার, শাসক, প্রভাবশালী, অভিজাত, বীর, শক্তিশালী, জ্ঞানী ও মেধাবী ব্যক্তির কদর বেশি।যদিও কোন ব্যক্তি নিজেকে সৎ, চরিত্রবান, নীতিবান, মর্যাদাবান, ধার্মিক, উদার, দয়ালু, দানশীল, পরোপকারী, আত্মত্যাগী, বিশ্বস্ত, সহানুভূতিশীল ও ক্ষমাশীল মানুষ হিসাবে মনে করতে পারে, কিন্তু তার এমন বিশ্বাস অন্যের প্রতি জোর, জুলুম, অন্যায়, অত্যাচার ও বৈষম্য করার অধিকার প্রদান করে না। তদুপরি , কারো কাছে অঢেল পরিমাণ ধন-সম্পদ থাকলেও সমাজ তার উপর নির্ভরশীল নয় ; বরং, সেই ব্যক্তিই সমাজের উপর নির্ভরশীল। উপরন্তু, সমাজ আমাদের সকলকে আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে।কৃষক তার মেধা, বুদ্ধি, শ্রম ও সাধনা দিয়ে ধান উৎপাদন করে, রিক্সাওয়ালা তার শ্রম, শক্তি, ধৈর্য ও সময় দিয়ে যাতায়াত ব্যবস্থায় সহায়তা করে, দুধওয়ালা গাভীর দুধ সরবরাহ করে, শ্রমিক, কুলি, মজুর ও দিনমজুররা তাদের শ্রম দিয়ে বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করে এবং পেশাজীবীরা তাদের জ্ঞান, বুদ্ধি ও শ্রম দিয়ে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখেন। সর্বোপরি, সমাজের সকল স্তরের মানুষ তাদের অর্জিত মেধা, বুদ্ধি ও শ্রম দিয়ে আমাদের সকলকে সমাজের উচ্চ স্তরে পৌঁছাতে অনুপ্রাণিত করে। সমাজের চাকা সচল রাখতে সমাজের প্রতিটি সদস্যের কাজের সমান গুরুত্ব রয়েছে। তবে , তদনুসারে কেউ সমাজ থেকে বেশি সুবিধা পাচ্ছে আবার কেউ কম সুবিধা পাচ্ছে।এই  বৈষম্যের ফলে সমাজে অন্যের অধিকার খর্ব করে অসম ব্যবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে ।সমাজে বিদ্যমান হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, আত্ম-অহমিকা, দাম্ভিকতা এবং দ্বন্দ্ব-কলহের মতো ইত্যাদি নেতিবাচক দিকগুলির নেপথ্যে কাজ করছে; সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।আমার, আপনার এবং আমাদের সকলের মধ্যে যে রকম আত্মসম্মান ও স্বাধিকারের অধিকার বিদ্যমান, অন্য ব্যক্তিদেরও ঠিক তেমনই অধিকার রয়েছে। তাই , যার ভিতর বিন্দুমাত্র আত্মসচেতনতা ও আত্মসম্মানবোধ বিদ্যমান, সে কখনই অন্যের আত্মসম্মান, স্বাধিকার, চলার পথে জোর জুলুম, শোষণ, অত্যাচার, বৈষম্য এবং বাধা সৃষ্টি করতে পারে না।প্রাচীন বাঙালি কবি ভুসুকুপা যথার্থই বলেছিলেন, “ আপনা মাংসে হরিণা বৈরী (হরিণের মাংসই তার জন্য শত্রু )”।তদ্রূপ, মানুষ হিসেবে আমাদের স্বজাতির প্রতি করা অন্যায়, বৈষম্য, জোর-জুলুম ও অত্যাচার আমাদের নিজেদের জন্যই অকল্যাণকর।আমাদের উচিত চোখ থেকে মিথ্যা অহং এবং ভেদাভেদের চশমাটি নামিয়ে ফেলা। প্রত্যেককেই নিজ নিজ ভোগকে নিয়ন্ত্রণ করা। ইদুর-বিড়াল প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসা। প্রত্যেক ব্যক্তিকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন এবং যোগ্য অধিকার প্রদান করা; বৈষম্য ও শোষণ থেকে বিরত থাকা এবং সকল প্রকার বৈষম্য ও শোষণকে নিরুৎসাহিত করা। সর্বোপরি, অল্পপ্রাণ, স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন, জোর-জবরদস্তিপ্রিয়, আত্মকেন্দ্রিক, অবিবেচক এবং নীতি ও আদর্শহীন ব্যক্তিদের স্থলে সুস্থ, সূক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন, বিজ্ঞ-প্রজ্ঞাবান, সহানুভূতি ও সহমর্মিতাপূর্ণ, সুবিবেচক এবং নীতি ও আদর্শবান ব্যক্তিদের স্থান করে দিতে হবে।

 

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে জাতি, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ, সম্পদ, শিক্ষাগত যোগ্যতা অথবা অন্য কোন মানব-নির্মিত মানদণ্ডের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বৈষম্যের বেড়াজাল ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন: “অনারবের উপর আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই এবং আরবের উপরও অনারবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কালোর উপর সাদার এবং সাদার উপর কালোরও কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই।” বৈষম্যের বিষাক্ত বীজ সমাজের বুকে বিদ্বেষ ও অসন্তোষের বীজ বপন করে। এটি ঐক্য ও সংহতি ভেঙে ফেলে। সমাজের ভিত্তিকে ক্ষয় করে। আমাদের উচিত সকলকে ঐক্যবদ্ধ করা, যেখানে প্রত্যেকেই হবে অন্যের আশ্রয় ও সহায়ক। আসুন আমরা সকলে মিলে এই বীজকে উপড়ে ফেলে ঐক্য ও ভালোবাসার বীজ বপন করি। তবেই আমরা একটি সত্যিকারের মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে পারব, যেখানে সকলের জন্য বিরাজ করবে শান্তি ও সমৃদ্ধি।