পোস্টস

নন ফিকশন

একটা সত্যি কথার ওজন সারা দুনিয়ার চাইতেও বেশি

১২ আগস্ট ২০২৪

অরিত্র আহমেদ

মূল লেখক আলেক্সান্ডার সলঝেনিৎসিন

অনুবাদক অরিত্র আহমেদ

আমার মনে হয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থকদের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ সত্ত্বেও এই ভয়ঙ্কর সময়ে বিশ্বসাহিত্য মানুষকে তার যথাযথ আত্মদর্শনে সাহায্য করতে পারে। মানুষের ঘনসংবদ্ধ অভিজ্ঞতাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বিশ্বসাহিত্য এমনভাবে বয়ে নিয়ে যেতে পারে যে, এর ফলে বিবিধ মূল্যবোধের সম্মিলন সম্ভব হয়ে ওঠে, এবং এক জনপদের মানুষ অল্প কথায় এতো নিখুঁতভাবে এবং এমন এক প্রখর সচেতনতা ও স্বীকৃতিদানের মানসিকতা নিয়ে অন্য একটি জনপদের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে যে তাদের মনে হয় ওই ইতিহাস তাদের নিজেদেরই যাপিত ইতিহাস- এবং এরই ফলশ্রুতিতে অতীতের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তির হাত থেকে তারা বেঁচে যায়। একই সঙ্গে, বিশ্বসাহিত্যের হাত ধরে আমরা হয়তো অন্য যেকোনো মানুষের মতোই আমাদের নিজস্ব বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ করতে সক্ষম হবো, যার ফলে নিকটবর্তী চারপাশের ঘটনাই আমাদের মনোযোগের কেন্দ্র হলেও বিশ্ব জুড়ে যা কিছু ঘটে চলেছে, তা-ও আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে না। আমরা বিভিন্ন ঘটনার আন্তঃসম্পর্কের দিকে খেয়াল রাখবো এবং সর্বক্ষেত্রে বজায় রাখবো এক বিশ্বজনীন মানদণ্ড।

লেখকরাই যদি তাদের মুখ বন্ধ রাখেন, তো ব্যর্থ সরকারকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে কে? কিংবা গোটা সমাজের কাপুরুষোচিত লজ্জা এবং আপন দুর্বলতা জেনেও সমাজের আত্মতুষ্ট থেকে যাওয়া, তরুণ প্রজন্মের লঘুচিত্ত ও হঠকারী আচরণ, এবং বেপরোয়া চোর-ছ্যাঁচড়দের ছুরি-ঘোরানো আস্ফালন নিয়েও লেখকরা ছাড়া আর কে-ইবা জোর গলায় কথা বলবে?

এখন প্রশ্ন উঠবে: নির্জলা হিংসার (violence) এই নিষ্ঠুর আক্রমণের বিরুদ্ধে সাহিত্যের কীইবা করতে পারে? একটা জিনিস আমরা যেনো কিছুতেই ভুলে না যাই। হিংসা কখনো নিজে থেকে বিকাশ লাভ করে না এবং করতে পারে না: হিংসা অনিবার্যভাবেই ‘মিথ্যা’-র উপর নির্ভরশীল। দুনিয়ার সবথেকে নিবিড়, সবথেকে গভীর এবং সবথেকে স্বাভাবিক বন্ধনের দ্বারা হিংসা আর মিথ্যা একে অন্যের সঙ্গে আবদ্ধ। মিথ্যা ছাড়া কোনো কিছুই হিংসাকে রক্ষা করতে পারে না, আবার মিথ্যা নিজে টিকে থাকে কেবল হিংসার সাহায্যেই। একবার কেউ হিংসাকে তার পদ্ধতি হিসেবে বেছে নিলে মিথ্যাকে মূলনীতি হিসেবে বেছে নেওয়া ছাড়া তার আর উপায় থাকে না। জন্মলগ্নে হিংসা বেশ অকপটে ও সগৌরবে কাজ করে। কিন্তু যতোই সে শক্তিশালী এবং দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে, ততোই সে বুঝতে পারে যে তার চারপাশের হাওয়া ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে এবং সে আর নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। এরপর থেকে মিথ্যার কুজ্ঝটিকায় নিজেকে আচ্ছন্ন না করে এবং মিথ্যার মধুর ভাষণে নিজেকে আবৃত না করে হিংসা আর টিকে থাকতে পারে না। এর জন্য অবশ্য সবসময় নিজের মুখে মিথ্যা বলার দরকার হয় না- হিংসা এতোটাও দাবি করে না। হিংসার যারা ভুক্তভোগী, মিথ্যার প্রতি তাদের আনুগত্য, এবং মিথ্যায় তাদের অংশগ্রহণই সচরাচর যথেষ্ট হয়ে থাকে।

মিথ্যাকে সমর্থন না করা এবং মিথ্যায় অংশগ্রহণ না করা- এ হলো একজন সাধারণ সাহসী মানুষের কাজ। তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এরকম: সারা জগতে মিথ্যা নেমে আসুক, এমনকি চাইলে মিথ্যা তার রাজত্ব স্থাপন করুক, কিন্তু আমি নিজে যেনো কিছুতেই মিথ্যার মাধ্যম না হই! কিন্তু শিল্পী-সাহিত্যিকরা চাইলে আরো বেশি কিছু করতে পারেন: তারা মিথ্যাকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারেন। কারণ মিথ্যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শিল্পকলা সবসময়ই জিতেছে এবং জিতবে। এটা সুস্পষ্ট ও নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই দুনিয়ায় মিথ্যা প্রায় সবকিছুরই মোকাবেলা করতে পারে, কিন্তু শিল্পকলার সামনে সে দাঁড়াতে পারে না। একবার মিথ্যাকে দূর করা গেলে হিংসার কদর্য, নগ্ন রূপ সবার সামনে উন্মোচিত হয়ে যাবে- এবং শূন্যগর্ভ হিংসার ইমারত তখন ধ্বসে পড়বে।

এই কারণেই, আমার ধারণা, এই চরম উত্তপ্ত সময়ে আমরা পৃথিবীকে সাহায্য করতে পারি: ‘আমাদের কাছে অস্ত্র নেই'- জাতীয় কথা বলে কিংবা সবকিছু ছেড়েছুড়ে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটানোয় নিজেকে সঁপে দিয়ে নয়, বরং মিথ্যার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে নামার মাধ্যমে।

রুশ ভাষায় সত্য-সম্পর্কিত প্রবাদগুলি খুবই জনপ্রিয়। মানুষের তিক্ত, নির্মম ও গুরুত্বপূর্ণ বিবিধ অভিজ্ঞতাকে এই প্রবাদগুলি যথার্থভাবে প্রকাশ করে, এবং প্রায়ই সেটা করে থাকে খুব বিস্ময়করভাবে, যেমন: 
একটা সত্যি কথার ওজন সারা দুনিয়ার চাইতেও বেশি

বস্তুর ভর ও শক্তির সংরক্ষণ নীতির এই আপাত-উদ্ভট লঙ্ঘনের উপরই আমার যাবতীয় কার্যকলাপ এবং সারা দুনিয়ার লেখকদের প্রতি আমার এই আহ্বান দাঁড়িয়ে আছে।

 

 

[ লেখক পরিচিতি: আলেক্সান্ডার সলঝেনিৎসিন (১৯১৮-২০০৮) ছিলেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একজন বিখ্যাত সোভিয়েত ও ইতিহাসবিদ। সোভিয়েত সরকারের রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে দেশ থেকে বিতাড়িত হন। তাঁর বিখ্যাত রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য The Gulag Archipelago, Cancer Ward, One Day in the Life of Ivan Denisovich, In the First Circle, August 1914, প্রভৃতি। ১৯৭০ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর ইউরোপে ও আমেরিকায় তিনি বহু বক্তৃতা দেন। ‘একটা সত্যি কথার ওজন সারা দুনিয়ার চাইতেও বেশি’ তেমনই একটি বিখ্যাত বক্তৃতা।