Posts

গল্প

যুদ্ধ ফেরত

April 29, 2024

রাশিকুর রহমান রিফাত

Original Author রাশিকুর রহমান রিফাত

                    ১

"ভাইজান আপনে কি মুক্তিযোদ্ধা?”
পাশে হেঁটে চলা লোকটার কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো দিদার। কোনো কথা বললো না। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে হাঁটছে সে। পাড়ি দিতে হবে আরো বহু পথ। শুধু যে সে একা বা তার পাশের লোকটি হাঁটছে তা কিন্তু না। হাঁটছে শ'য়ে শ'য়ে লোক। প্রত্যেকের গন্তব্য নিজের বাড়ি। নাড়ির টান বড় টান। এ থেকে মুক্তি পাওয়া বেজায় কষ্টের। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি। এরমধ্যেই সকলে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে। প্রায় নয় মাস ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার পর সবারই মিলে-মিশে একত্রে থাকার জন্য মন আনচান করছে। কাছের মানুষদের মাঝে কে কে হারিয়ে গেছে চিরতরে সেটাও তো জানতে হবে। সকলের চেহারায় একটা চাপা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা যাচ্ছে। আসলে এটাকে ঠিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বলা যাবে না। একই সাথে বাড়ি ফেরার আনন্দ ও প্রিয়জনকে হারাবার অজানা আশংকা চেহারায় প্রকাশ পাচ্ছে। এক্ষেত্রে কি বিশেষণ ব্যবহার হতে পারে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। 
"আপনের বাড়ি কই ভাইজান?” লোকটা উত্তর না পেয়ে আবার প্রশ্ন করে বসলো। যেন দিদারের সাথে ভাব জমাতেই হবে তাকে। আসলে এর পিছনে একটা কারণও আছে। এ পথ দিয়ে যারা হেঁটে যাচ্ছে তাদের সাথে দিদারের একটা পার্থক্য আছে। না,দিদারের তিনটে হাত বা দুটো মাথা নেই। উড়বার জন্য কোনো ডানাও নেই। তবে কাঁধে একটা এসএমজি দৃশ্যমান অবস্থায় রয়েছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে তার পাশাপাশি চলতে থাকা লোকটির তাই বুঝতে বাকি নেই যে দিদার একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাই বেশ খানিকক্ষণ ধরেই দিদারের সাথে কথা বলার জন্য উশখুশ করছিলেন তিনি। কিন্তু ঠিক কীভাবে কথা শুরু করবেন বুঝতে পারছিলেন না। তাই জানা প্রশ্নটাই করলেন। যুদ্ধের নয়মাস পালিয়ে পালিয়ে বেরিয়েছেন তিনি। সত্যি বলতে কাপুরুষের মতো দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তাই চাক্ষুষ মুক্তিযোদ্ধা দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি। আজ স্বাধীন দেশে যুদ্ধ ফেরত একজন মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি হেঁটে তার সাথে কথা বলার সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়!
লোকটার সাথে কথা বলতে খুব একটা ইচ্ছে করছিলো না দিদারের। নাহ, এটা কোনো অহংকার বা অন্যকে ছোট করে দেখার বহিঃপ্রকাশ নয়। আসলে তার ভালো লাগছিলো না। এতদিন পরিবারের থেকে দূরে ছিলো সে। এই কমাসে বাপ-মা,ভাই-বোনদের কথা ভাবার সময় অব্দি পায়নি। মাথায় শুধু ছিলো দেশের চিন্তা। তাই কালকে দেশটা স্বাধীন হবার পর থেকেই তাদের কথা বড্ড বেশী মনে পরছে। তখন থেকেই মোটামুটি চুপ হয়ে গেছে সে। ওস্তাদের থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে খুব একটা দেরী করেনি তাই। 
"হ্যাঁ,আমি মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি হরিপুর।"
"জীবনে এই পরথম সামনা সামনি মুক্তিযোদ্ধা দ্যাখলাম। কি যে ভালা লাগতেছে! তো ভাইজান আপনে কয়টা পাক সেনা মারছেন?”
"কয়টা মারছি সেটা তো ঠিক জানিনা তয় সম্মুখ যুদ্ধে প্রচুর গোলাগুলি করছি। অনেকগুলাই মরছে। তো আপনি মুক্তিযুদ্ধে যান নাই কেন?”
এবার লোকটার চেহারায় বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। যেন কাঁটা ঘায়ে কেউ নুনের ছিটে দিয়েছে। দিদারের প্রশ্নে সম্ভবত বেশ বিব্রত হয়েছে সে। বাকিটা পথ আর কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। একটা সময় দিদার আর লোকটার গন্তব্যের পথ আলাদা হয়ে গেল।

                         ২

দীর্ঘ পথ ভ্রমণ শেষে নিজের গ্রামে এসে পৌঁছালো দিদার। মাত্র ছ-সাত মাস গ্রামে ছিলো না সে। কিন্তু মনে হচ্ছে কত কত কাল পর নিজের গ্রামে ফিরলো। চারিদিক সুনসান। কোথাও কোনো জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। অবশ্য এখন প্রায় রাত্রির শেষ প্রহর। এ সময় তেমন একটা মানুষজনের দেখা পাবার কথাও না। একটু পরেই সূর্যোদয়। তখন হরিপুর ফিরে পাবে তার চিরচেনা রূপ। আচ্ছা স্বাধীন হরিপুরকে দেখতে কেমন লাগবে? আবারো কি একসাথে আজান আর শঙ্খের ধ্বনি শুনতে পাওয়া যাবে? এসব ভাবতে ভাবতে অবচেতন মনেই নিজের ভিটেবাড়ির কাছে চলে আসলো দিদার। আকাশ একটু একটু করে ফর্সা হতে শুরু করেছে। সামনে চোখ যেতেই থমকে দাঁড়ালো দিদার। তাদের বাড়িঘর আধপোড়া অবস্থায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। যেন করুণ চোখে তাকে দেখছে। অজানা ভয় উঁকি দিলো দিদারের মনের ভেতর। এমন সময় বয়োজ্যেষ্ঠ একজন বিধবা মহিলাকে উদ্দেশ্যেহীন ভাবে হাঁটতে দেখা গেল। 
"দাদি।" 
দিদারের ডাক শুনে কিছুটা চমকে গেল বৃদ্ধা। দিদার ছুটে গেল তার কাছে। আলিঙ্গন করলো তাকে। 
"বাপধন,তুই আইছস?”
"হ দাদি।"
দিদারকে দেখেই কান্নায় ভেঙ্গে পরলো বৃদ্ধা। যেন অনেকদিন ধরে এই কান্না জমিয়ে রেখেছিল সে। আজকে দিদারকে দেখে কান্নার স্রোত বইয়ে দিলো।
"জানোয়ারের বাচ্চাগুলা কাউরে বাঁচায় রাখে নাই রে বাপ। সব্বাইরে মাইরা ফালাইছে। এই গেরামে তুই আর আমি ছাড়া একটা মানুষও বাইচ্চা নাই।" কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো বৃদ্ধা। 
"এসব তুমি কি কও।" কিছুই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না দিদার।
“এই অজপাড়া গাঁয় মিলিটারিরা আইবো আমরা কল্পনাও করতে পারি নাই। সারাদেশে গণ্ডগোল লাগলেও আমরা কিছুই টের পাই নাই। কিন্তু কয়েকদিন আগে কিছু বেজন্মা রাজাকার মিলিটারিগোরে পথ দেখায় এইহানে নিয়া আইসে। তর বাপ আর ভাইরে এই গাছের লগে বাইন্দা মারছে। তোর বইন আর মারে আমার চক্ষের সামনে নষ্ট করছে। তারপর ওগোরেও মারছে। গ্রামের সব হিন্দুগোরে ধইরা কুরবানির গরুর মত পাকিস্তানের নামে জবাই দিছে। কি রক্ত! আল্লাহ তুমি আমারে কি দেখাইলা এইসব! ওগোর পায়ে ধরছি আমারে মাইরা ফালাইবার জন্য। কিন্তু আমার কথা রাখলো না। চক্ষের সামনে সবার লাশ শিয়াল-কুকুররে খাইতে দেখলাম। একটু মাডি দিতে পারলাম না অগোরে।" অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো বৃদ্ধা। আর কিছু শুনতে পারলো না দিদার। ঝাপসা দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। হরিপুর গ্রামে স্বাধীনতার নতুন সূর্য উদিত হচ্ছে। কিন্তু সেই পবিত্র দৃশ্য দেখার মতো কেউ নেই।

Comments

    Please login to post comment. Login