পোস্টস

চিন্তা

সে যখন ডাকলো, 'ভাইয়েরা আমার'!

১৫ আগস্ট ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

আক্ষরিক অর্থেই আওয়ামী লীগের অনুসারীদের শোক পালন করবার মুখ নেই আজ। মনের নৈতিক জোরও নেই। জুলাই অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রীয় আধিপত্যবাদীদের হাতে যেভাবে ঘরের শিশুসহ অগণন মানুষ বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন, দৃষ্টিশক্তি খোয়ানোসহ মারাত্মক জখম হয়েছেন, পাল্টা আক্রমণে পুলিশ সদস্যরাও প্রাণপাত করেছেন-সভ্যতাবিরোধী এসব ঘটনা কোনো বিপরীতার্থক গল্প দিয়েই জাস্টিফিকেশন দেয়া যাবে না।

পঁচাত্তরে পরিবারসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের Assassination নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক রাজনৈতিক ইতিহাসেই বড় ট্রাজিক ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা দিনটি স্মরণে শোকগ্রস্ত হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এবারের ১৫ আগস্ট এসেছে জুলাইয়ে সংঘটিত ভয়াল ট্রাজেডির ওপর দিয়ে। এক শোকের বিয়োগব্যথা দিয়ে কোনোদিনই আরেক শোককে মহিমান্বিত করা যায় না। বর্তমান সময়ের মানুষ হিসেবে তাই আমাদেরকে ছাত্র-অধিকার সচেতন ছাত্র-জনতার পক্ষে অকাতরে প্রাণ দেয়া বীরদের নামই আগে নিতে হবে। কারণ একাত্তরে যার নেতৃত্বে আমরা বাংলাদেশ নামের স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছিলাম, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, জাতীয় ফুল পাখি বৃক্ষ পেয়েছিলাম সেই বঙ্গবন্ধু ও লাখো বীরের গঠন করা দেশেরই নাগরিক ওই ছাত্র-জনতা।

বঙ্গবন্ধুর জন্য সবাই কি শোক করবে? এক কথায় উত্তর হলো না। সত্তরের নির্বাচনে মেজোরিটি আসনে জিতে যায় বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ। তারপরও দেশের সব মানুষ বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, বাংলাদেশ নামের স্বাধীন ভূখণ্ড চেয়েছিলেন -এমনটা ভাববার কোনো কারণ নেই। সহজ ও সাদাসিধা কথা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ সবাই চাননি। এমন এক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ জাতীয় শোক দিবসের নামে কেন ঢালাওভাবে সবাইকে শোকগ্রস্ত হতে বাধ্য করেছে? কার্যত এখানেই বঙ্গবন্ধুর সম্মান ও গৌরবকে জোরজবরদস্তিতে নিয়ে গিয়েছিল এইসময়ের হাইব্রিড আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণার নামে গরু জবাই করে খিচুড়ি ভোজনের আয়োজনকে আমরা কিছুতেই ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ শোক পালন বলতে পারতাম না। 'The spirit of Independence' জোরজবরদস্তিতে গণমানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। বরং স্বাধীনতার স্থপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বৈষম্য বিরোধী সমাজ গঠনের অঙ্গীকার যদি সততা ও নিষ্ঠার সাথে পূরণ করা হতো -সেটাই হতো সত্যিকারের শোক পালন। শেখ হাসিনা সরকার তা না করে বিভাজিত এক সমাজ কায়েম করবার প্রয়াস পেয়েছিল, যেখানে মানুষের যোগ্যতা নির্ধারিত হতো দলপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি আর ঘুষবাণিজ্যের পারঙ্গমতার ওপর। কার্যত আওয়ামী লীগের আজকের এই নিষ্প্রাণ দিনটি তাদেরই সৃষ্টি করা। কে ধানমন্ডিতে যেতে দিল না, কে ৩২ -এ আগুন দিয়েছে এমনসব বাহানার কথা বলে অন্যের ওপর দায় চাপানোর এতটুকু সুযোগ নেই। বঙ্গবন্ধু শারীরিকভাবে প্রয়াত হয়েছিলেন পঁচাত্তরে। তাঁর আদর্শকে বিলীন করে দিয়েছে দুই হাজার চব্বিশে তাঁর কন্যা ও আওয়ামী লীগ সরকারের দূরাচার সভাসদরাই। ঘরে ঘরে মুজিব কর্ণার, ম্যুরাল বা ভাস্কর্য গড়ে দিলেই দর্শনচর্চা হয় না। সর্বমানুষের প্রতি ভালোবাসাকে স্পিরিট বা ফিলোসফির প্রধান অনুষঙ্গ করতে হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনৈতিক পণ্য বানিয়ে ফেলেছিল আওয়ামী লীগ। যাচ্ছেতাই ব্যবহার ও বাণিজ্যিকীকরণের চাপে পিষ্ট সেই বঙ্গবন্ধুকে গণমানুষ মেনে নেয়নি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের বন্ধ দুয়ার থেকে মুক্তি পেল কি?

দোষ গুণ মিলিয়েই মানুষ। স্বাধীনতার পর দেশের শাসক হয়ে উঠা বঙ্গবন্ধু হয়ত ভালো সেবা দিতে পারেননি। বাকশালের নামে বহুদলীয় রাজনীতির সুযোগ বন্ধ করেছেন। অবাধ গণমাধ্যম রাখেননি। তাজউদ্দীন আহমদের মতো বিশ্বস্ত সহচরকে বেখেয়ালে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে পারেননি। তাই বলে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব দেয়াটা মিথ্যা হয়ে যায় না। ৬৬'র ৬ দফা, ৬৯'র গণ অভ্যুত্থান, ৭ মার্চের তেজোদীপ্ত ভাষণ এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, একটি দেশ, একটি লাল সবুজ পতাকা অস্বীকার করলেই ইতিহাস বাতিল হয়ে যায় না।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে রণাঙ্গনের যোদ্ধা ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে অমিত সাহস দেখিয়ে বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন। মেজর জিয়া একাত্তরের ২৭ মার্চ সুপ্রীম লিডার বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ইতিহাসের এই জাজ্বল্যমান সত্যটা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে মুছে দিতে চেয়েছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া তাজউদ্দীন আহমদের অবদানকেও খাটো করে দেখিয়েছে তারা। এতে যে পুরো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটাই একপেশে এবং অযৌক্তিক বাড়াবাড়ির নামান্তর হয়ে পড়েছিল সেটা বুঝবার ক্ষমতা Despotic শেখ হাসিনা সরকারের ছিল না। অগণতান্ত্রিক ক্ষমতার মোহে তারা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর ওই অন্ধকারটাই দূরীভূত করেছে ২০২৪ এর ৫ আগস্ট।

যারা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন নিশ্চিতই তারা ভিন্নমতকে মর্যাদা দেবেন। যারা বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বার্ষিকীতে শোক পালন করবেন অন্যের ওপর দোষারোপ না করে নিশ্চয়ই তারা ধৈর্যশীল হবেন, নিজের দলের অন্যায় অত্যাচারকে স্বীকার করে নিয়ে অনুতপ্ত হবেন। ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে আইনি ভাষাকেও মর্যাদা দিতে হবে তাদের।

বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে আমরা এই বাংলার তিনজন মনীষীর মতামতকে স্মরণ করতে পারি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম বলেছেন, 'শেখ মুজিবকে আমরা ঈর্ষা করেছি। ঈর্ষা করেছি আমাদের অতিক্রম করে বড় হওয়াতে। নানাদিকে বড়। তেজে, সাহসে, স্নেহে, ভালবাসায় এবং দুর্বলতায়। সবদিকে। এবং এই ঈর্ষা থেকেই আমরা তাকে হত্যা করেছি। কেবল এই কথাটি বুঝিনি যে, ঈর্ষায় পীড়িত হয়ে ঈর্ষিতকে হত্যা করে ঈর্ষিতের স্থান দখল করা যায় না।'

লেখক আহমদ সফা বলেছেন, `আজ থেকে অনেকদিন পরে হয়তো কোনো পিতা তাঁর শিশুপুত্রকে বলবেন, জানো খোকা! আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিল যাঁর দৃঢ়তা ছিল, তেজ ছিল আর ছিল অসংখ্য দুর্বলতা। কিন্তু মানুষটির হৃদয় ছিল, ভালোবাসতে জানতেন, দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোৎস্নারাতে রূপালি কিরণধারায় মায়ের স্নেহের মতো যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি এবং নিশ্চয়তার বোধ জাগিয়ে তোলে তা হলো তাঁর ভালোবাসা। জানো খোকা তাঁর নাম? শেখ মুজিবুর রহমান।'

'নিশিডাক' কবিতায় কবি আল মাহমুদ লিখেছেন
তার আহ্বান ছিল নিশিডাকের শিসতোলা
তীব্র বাঁশির মতো।
সে যখন বললো, 'ভাইসব।'
অমনি অরণ্যের এলোমেলো গাছেরাও সারি 
বেঁধে দাড়িয়ে গেল।
সে যখন ডাকলো, 'ভাইয়েরা আমার।'
ভেঙে যাওয়া পাখির ভিড় করে নেমে 
এল পৃথিবীর ডাঙায়
কবিরা কলম ও বন্ধুকের পার্থক্য ভুলে হাঁটতে 
লাগলো খোলা ময়দানে।

লেখক: সাংবাদিক
১৫ আগস্ট ২০২৪