দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের মস্তিষ্কের গোঁড়ায় হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিকতার শিকড় ছড়িয়ে আছে। কেবল বাংলাদেশে নয়, ভারতে, পাকিস্তানে, নেপালে, ভুটানে, শ্রীলঙ্কা সহ অন্যান্য এলাকাতেও। এখানে পুরুষ মহান, সর্বশক্তিমান, ঈশ্বরতুল্য শ্রদ্ধাভাজন। এখানে নারীদের অবস্থান দাসীতুল্য, পুরুষের দাসী। পুরুষ যা বলবে, নারীরা অবাধ্য না হয়ে তাই করবে- এমন ধ্যান-ধারণা মননে পুষে রেখেছে এই ভৌগলিক অবস্থানের পুরুষেরা।
কলকাতায় মৌমিতার ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে কলকাতায় 'মেয়েরা রাত দখল করো' কর্মসূচির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ১৬ই আগস্ট রাজু ভাস্কর্যের সামনেও একই কর্মসূচি পালন হয়েছে। উল্লেখ্য যে এই শহরে মেয়েদের রাত দখল করার জন্য আলাদাভাবে একটি কর্মসূচি ঘোষণা করতে হয়, কিন্তু এই শহরের প্রতিটি রাতই ছেলেদের দখলে থাকে। মহাসড়কে মধ্যরাতে বন্ধুরা মিলে মোটরবাইকে ঘুরে বেড়ায়, টিএসসিতে বসে আড্ডা দেয়, নাজিরা বাজারে মহাভোজ করতে যায়, আরো কত কি। এক বাক্যে, ছেলেরা রাতের মহারাজ হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে নারীদের জন্য হল, মেস, সাব-লেট, এমনি আত্মীয় বা নিজের বাসায়ও সান্ধ্য আইন থাকে। অনিচ্ছাকৃত সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করলেও তাদের বাড়িওয়ালা, মা-বাবা, অভিভাবকগণ সহ বয়জ্যেষ্ঠ অনেকের কাছেই জবাবদিহিতা করতে হয়। অগ্রজদের মন মতো উত্তর দিতে না পারলেই পাড়ায় পাড়ায় শোনা যায় 'ওই বাড়ির মেয়ে খারাপ'। কারণ? মেয়েটি দেরি করে ঘরে ফিরেছে। কোনোদিন কোনো ছেলে তাল-বেতাল হয়ে ঘরে ফিরলেও তা ঘরের বাইরে কখনোই যায় না। সর্বোচ্চ নিজ বাড়িতেই ঘরোয়া শাস্তির ব্যবস্থা হয়। ঠিক এভাবেই যুগে যুগে পুরুষতান্ত্রিকতার কাছে নারীদের নিপীড়িত হতে হচ্ছে, হারাতে হচ্ছে তাদের মৌলিক অধিকার- স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকার, স্বাধীনভাবে মনভাব প্রকাশ করার অধিকার, ব্যক্তিগত ইচ্ছার প্রতিফলনের অধিকার। নারীদের অবশ্য প্রতিবাদ করার অধিকারও থাকে না এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে।
পুরুষতান্ত্রিকতার জন্ম পিতৃতান্ত্রিকতা থেকে। একজন কিশোর পিতৃতান্ত্রিকতার অভিজ্ঞতা অর্জন করে নিজ পরিবার থেকেই- যখন সে তার বাবাকে তার মা-বোনের ওপর কর্তৃত্ববাদী হতে দেখে। এমনকি তার মা-বোনকে এই কর্তৃত্ব মেনেও নিতে দেখে। কিশোরের মস্তিষ্কেও তখন নারীদের ওপর কর্তৃত্ববাদের বীজ স্থাপন হয়। পরবর্তীতে এই চর্চা সে কেবল তার স্ত্রী-কন্যা-বোনের উপরই নয়, বরং প্রতিটি নারীর ক্ষেত্রেই করতে চায়। এই কর্তৃত্ববাদী চৈতন্য জন্ম দেয়- 'নারীর তুলনায় পুরুষকে মহান' ভাবার চৈতন্য। এভাবেই পিতৃতান্ত্রিকতা থেকে জন্ম নেয় পুরুষতান্ত্রিকতার।
পুরুষের মস্তিষ্কের এই রোগের জন্যই তারা নারীকে মানুষ না ভেবে, মনে করে কোনো অনুভূতিহীন নিষ্ক্রিয় জীব। নারীদের নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছা থাকতে পারে- এটা তারা ভাবতে পারে না। নারীদের ভিন্ন কোনো অনুভূতি থাকতে পারে বলেও তারা মনে করে না। নারীদের নিজস্ব মন-মনন থাকতে পারে- এটা তাদের কল্পনার উর্ধ্বে চলে যায়। পুরুষরা মনে করে নারীদের মস্তিষ্ক পুরুষের আদেশ-নির্দেশ দ্বারা পরিচালিত। তাই পুরুষের মানসিক কিংবা দৈহিক চাহিদা পূরণ করতে নারীরা বাধ্য বলেও মনে করে তারা। পুরুষের কোনো আদর্শ-দর্শন-মতামতের সঙ্গে নারীরা দ্বিমত পোষণ করলে পুরুষদের মানসিক রোগের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। নিজের মানসিক চাহিদা পরিপূর্ণ করতে তারা যেমন নারীদের ওপর বল প্রয়োগ করে, তেমনই তাদের দৈহিক চাহিদা পূরণেও বল প্রয়োগ করে নারীদের ওপর। উভয় ক্ষেত্রেই নারীদের মতামতকে অগুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করে তারা। এভাবেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের ওপর যুগে যুগে ঘটে আসছে অগণিত ধর্ষণ-নিপীড়ন।
কলকাতার মৌমিতাকেও তাই ঘুমন্ত অবস্থায় বল প্রয়োগ করে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করেছে পৈশাচিক দানবেরা। ২০১৯ সালে ভারতজুড়ে প্রতি ১৬ মিনিটে একটা ধর্ষণ রিপোর্ট করা হয়েছে। বাংলাদেশেও প্রতিদিন যৌননিপীড়নের শিকার হচ্ছে অগণিত নারী। পুলিশে মামলা-জিডি-ডাইরিতে যে কয়েকটি রিপোর্ট উঠে আসে, তার থেকেও যৌননিপীড়নের শিকার নারীদের সংখ্যা যে আরো অনেক বেশি- তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। হত্যার হুমকির মুখে অনেক নারীই তাদের যৌননিপীড়নের অভিজ্ঞতা লুকিয়ে রাখে। নাহলে হয়তবা তাদের পরিণতিও মৌমিতার মতো- 'ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার' হতো।
এখন সময় কেবল ধর্ষণের প্রতিবাদ নয়, পুরো পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ভেঙে ফেলা। বৈষম্যমূলক সান্ধ্য আইন, নারীদের প্রতি পারিবারিক ও কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ, নারীদের ওপর মানসিক এবং দৈহিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময় এখনই। পুরুষতান্ত্রিকতার রোগ ঝেড়ে ফেললে এই সমাজের নারীরা পাবে সমমর্যাদা-সমঅধিকার, অর্জিত হবে সাম্য-সমতা। কেবল সেই ক্ষেত্রেই নারীরা মুক্তি পেতে পারে ধর্ষণ-নিপীড়ন-নির্যানত সহ সকল অন্যায়-অবিচার-অত্যাচার থেকে। পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বিদ্রোহ করতে হবে নিজ ঘর থেকেই। ঘরের পিতৃতান্ত্রিকতা ধ্বংস করলে, ধ্বংস হবে পুরুষতান্ত্রিকতা। নাহলে পিতৃতান্ত্রিকতাই বারবার ফিরে আসবে 'ঘরের শত্রু বিভীষণ' হয়ে।