পোস্টস

প্রবন্ধ

নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন

১৮ আগস্ট ২০২৪

মুহাম্মদ আল ইমরান

ছবি: সেলিম আল দীন।

সেলিম আল দীন ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনি জেলার সোনাগাজী উপজেলার সেনেরখিল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতামহ হাজী আফতাব উদ্দিন ছিলেন স্কুল শিক্ষক। ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট অব কাস্টমস, মফিজউদ্দিন আহমেদ ও ফিরোজা খাতুনের তৃতীয় সন্তান সেলিম আল দীন। পিতার চাকরির সূত্রে ফেনী, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও রংপুরের বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করেছেন৷ তিনি ফেনীর সেনেরখীলের মঙ্গলকান্দি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে এসএসসি পাস করেন এবং ফেনী কলেজ থেকে ১৯৬৬ সালে এইচএসসি পাস করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন৷ পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ভর্তি হন টাঙ্গাইলের করোটিয়ায় সাদত কলেজে৷ সেখান থেকে স্নাতক পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন ছিলেন।

তার লেখা আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ সম্পর্কে বাংলা প্রবন্ধ 'নিগ্রো' কবি আহসান হাবীব সম্পাদিত 'দৈনিক পাকিস্তান' পত্রিকায় ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয়। বলা যায় এখান থেকেই সেলিম আল দীনের লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। অবশ্য ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর লেখক হওয়ার বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন।
উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম- কিত্তনখোলা(১৯৮৬), কেরামতমঙ্গল(১৯৮৮), চাকা(১৯৯১), হরগজ(১৯৯২), যৈবতী কন্যার মন(১৯৯৩), হাতহদাই(১৯৯৭), প্রাচ্য(২০০০), নিমজ্জন (২০০২)। তার রচিত 'হরগজ' নাটকটি সুয়েডীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এ নাটকটি ভারতের 'রঙ্গকর্মী নাট্যদল' হিন্দি ভাষায় মঞ্চস্থ করেছে।

রেডিও-টেলিভিশনে প্রযোজিত নাটকে সেলিম আল দীনের নাম স্মরণীয়। দেশ স্বাধীনের আগে ১৯৬৯ সালে রেডিও পাকিস্তানে বিপরীত তমসায়, ১৯৭০ সালে পাকিস্তান টেলিভিশনে ঘুম নেই। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে রক্তের আঙ্গুরলতা, বাংলাদেশ টেলিভিশনে অশ্রুত গান্ধার(১৯৭৫), শেকড় কাঁদে জলকণার জন্য(১৯৭৭), এনটিভিতে নকশীপাড়ের মানুষেরা(২০০০) সহ আরো অসংখ্য নাটক বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।

শুধু নাট্য অঙ্গনেই নয় চলচ্চিত্র অঙ্গনেইও রয়েছে সেলিম আল দীনের অবদান। তার রচিত 'চাকা' নাটক অবলম্বনে ১৯৯৪ সালে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, 'কীত্তনখোলা' নাটক অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ২০০০ সালে, 'যৈবতী কন্যার মন' নাটক অবলম্বনে সরকারি অনুদানে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র 'একাত্তরের যীশু'তে সংলাপ রচনা করেন। এজন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার(শ্রেষ্ঠ সংলাপ) লাভ করেন সেলিম আল দীন।

সেলিম আল দীনের গান সংগীতশিল্পী ফাহমিদা নবীর কণ্ঠে 'আকাশ ও সমুদ্র অপার' শিরোনামে সিডি প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়াও তিনি পঞ্চাশের অধিক গানের কথা ও সুর সৃষ্টি করেছেন।

১৯৯১ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি সৈয়দ শামসুল হক মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত সেলিম আল দীনের "চাকা" নাটকের ভূমিকায় লিখেন, "সেলিম আল দীন,...,বাংলা নাটকের এক প্রধান পুরুষ; সেলিম অনবরত সন্ধান করে চলেন প্রকাশের নতুনতর মার্গ।" জনপ্রিয় নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও নাট্য নির্দেশক মাসুম রেজা ২০২৪ সালের ১১ জুলাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, "সেলিম আল দীন আমার শিল্পভাবনার গুরু।..." একজন মানুষের জীবনে কতটা পরিমাণ অন্য একজনের প্রাধাণ্য থাকলে তাকে শিল্পভাবনার গুরু হিসেবে অভিহিত করা যায় তা বর্ণনাতীত।

সেলিম আল দীনের শিক্ষার্থী বা তার সান্নিধ্য পাওয়া অনেকে বাংলা নাটকের অগ্রসরে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। সেলিম আল দীনের স্ত্রী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা সেলিম। তাদের একমাত্র সন্তান মইনুল হাসানের মৃত্যু হয় অল্প বয়সে।

নাটকের প্রতি আগ্রহ থেকে তিনি গবেষণায় মনোনিবেশ করেন মধ্যযুগের বাংলা নাট্যরীতি নিয়ে। গবেষণা করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার গবেষণা গ্রন্থ বাংলাদেশে একমাত্র বাংলা নাট্যকোষের ভূমিকা অবতীর্ণ। সেলিম আল দীন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণকেন্দ্রিক "নিও এথনিক থিয়েটার" এর উদ্ভাবনকারী। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেন "নাটক ও নাট্যতত্ত্ব" বিভাগ। তার সম্পাদনায় 'থিয়েটার স্ট্যাডিজ' নামে পত্রিকা প্রকাশিত হতো নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ থেকে। যা এখনও চলমান। এতে বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ ও রচনা স্থান পায়। তিনি ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। এমনকি সেলিম আল দীন ১৯৮১-৮২ সালে নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফকে নিয়ে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার। সেলিম আল দীনের নাটকে বাংলা জনপদের গ্রামীণ মানুষের অসামান্য দৃশ্যপট ফুটে উঠেছে। তিনি তার নাটকে গ্রামীণ জনজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা বা ঘটনা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। তার 'চাকা' নাটকটি বর্ণনা মূলক কাব্যনাট্য। পাঠকের দৃষ্টি থেকে পড়লে মনে হবে এ যেন উপন্যাস পড়ছি। তার সৃষ্টিশীল নিরীক্ষা বাংলা নাটক তথা সাহিত্যের জন্য অন্যান্য।

বাংলা নাটকে তথা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য দেশে বিদেশে তিনি বহুবার বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পুরস্কার হলো- ২০২৩ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার(সাহিত্য), ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৪ সালে নান্দিকার পুরস্কার(আকাদেমি মঞ্চ কলকাতা), ১৯৯৪ সালে শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন নাট্যকার, ১৯৯৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ২০০৫ সালে মুনীর চৌধুরী সম্মাননা ও ২০০৭ সালে একুশে পদক।

সেলিম আল দীন ২০০৮ সালের ১৪ই জানুয়ারি ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীয় মসজিদের কাছে সমাহিত করা হয়। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন তার সৃষ্টিশীল সাহিত্য কর্মের মাধ্যমে আমাদের মাঝে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বাংলা নাটক তার জন্য নিজস্ব দেশজ উৎস খুঁজে পেয়েছে। তাই সার্বিকভাবে সেলিম আল দীনের কর্মময় জীবন সম্পর্কে জেনে সৈয়দ হকের কণ্ঠের সঙ্গে মিলিয়ে বলতে হয়, বাংলা নাটকের এক প্রধান পুরুষ সেলিম আল দীন।

 

মুহাম্মদ আল ইমরান

৩রা ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৮ই আগস্ট ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ।

 

তথ্যসূত্র: 
- সেলিম আল দীন, বাংলা পিডিয়া।
- সেলিম আল দীন, উইকিপিডিয়া।
- ফেইসবুক পোস্ট- মাসুম রেজা: 

- চাকা, সেলিম আল দীন।