১৯৬৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সুহার্তো’র নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়ায় একটি অভ্যুত্থান পরিচালিত হয় ও ইন্দোনেশীয় কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপর সেনাবাহিনী সমাজতন্ত্র বিরোধী তৎপরতা চালায় যাকে সিআইএ বিংশ শতকের অন্যতম নিকৃষ্টতম গণহত্যারূপে আখ্যায়িত করে। সুহার্তো ১৯৬৭ সালে দেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত হয় ও পরের বছর স্থায়ীভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।
বেশ কয়েকবার অর্থনৈতিক সঙ্কটের কবলে পড়ে ১৯৯৮ সালের মে মাসে ইন্দোনেশিয়ায় দেশব্যাপী গণবিক্ষোভের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৬ সালের বেশ কিছু মাস ধরে ইন্দনেশিয়ায় গণহত্যা ঘটেছিল, যার মাধ্যমে ইন্দনেশিয়ার ডানপন্থী সরকার ও সৈন্য বাহিনী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন এবং অন্যান্য পশ্চিমা সরকারগুলির সমর্থনে গণ-হত্যা চলেছিল। এতে খুন হয় অন্তত ১,০০০,০০০ (দশ লক্ষ) ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি (পিকেআই) সদস্য, ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক, বামপন্থী, গেরওয়ানি মহিলা, জাতিগত জাভাদেশীয় অবাঙ্গন, নাস্তিক, "কাফির" এবং "জাতিগত চীনা" মানুষ। ১৯৬৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আন্দোলনের উপর অভ্যুত্থানের মিথ্যা অভযোগ দাগিয়ে দিয়ে এটি কমিউনিস্ট বিরোধী হত্যাকাণ্ড হিসাবে শুরু হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হয়েছিল যে ৫০০,০০০ (পাঁচ লক্ষ) থেকে ১,০০০,০০০ (দশ লক্ষ)-এরও বেশি লোক মারা গিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনুমান করা হয়, ২,০০০,০০০ (বিশ লক্ষ) থেকে ৩,০০০,০০০ (ত্রিশ লক্ষ) মানুষকে সে সময় হত্যা করা হয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ড নিউ অর্ডারে রূপান্তর এবং পিকেআইকে রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে নির্মূল করার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল যা বিশ্বব্যাপী স্নায়ুযুদ্ধে প্রভাব ফেলেছিল।
বেশিরভাগ ইন্দোনেশীয় ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকগুলিতে হত্যার বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে এবং সুহার্তো শাসনের অধীনে তাদের দমন করার কারণে ইন্দোনেশীয়রা এই বিষয়ে আলোচনার খুব কম সুযোগ পেয়েছে। কমিউনিস্টরা আবার শক্তিশালি হতে পারে এই সতর্কতা ও ভীতি সুহার্তোর মতবাদের একটি প্রধান চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং এটি আজও কার্যকর আছে।
২০১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নথিভুক্ত দলিল প্রকাশের পর জানা গেছে, মার্কিন সরকার শুরু থেকেই গণহত্যার সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান রাখে এবং ইন্দোনেশীয় সেনাবাহিনীর পদক্ষেপের সমর্থক ছিল। ১৯৬৮ সালের সিআইএ-র একটি গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে এই গণহত্যা বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা হিসাবে প্রথম সারিতে পড়ে।
সুহার্তো ২১ মে ১৯৯৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে। রাষ্ট্রপতি থেকে পদত্যাগের পর দূর্নীতি ও গণহত্যার দায়ে তাকে দোষারোপ করা হয়। কিন্তু দূর্বল স্বাস্থ্য ও ইন্দোনেশিয়ায় তার জনসমর্থনের কারণে তাকে অভিযুক্ত করা যায়নি। ২৭ জানুয়ারি, ২০০৮ তারিখে তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে এবং ভিন্নমত দমন করতে হাসিনা সরকার গুম, খুন, হত্যা, মতপ্রকাশে বাধা সহ বিভিন্ন আর্থিক দূর্নিতির মাধ্যমে দেশে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম করে।
১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরোধিতা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার অভূতপূর্ব গণঅভুত্থানের ফলে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা পদত্যাগে বাধ্য হয় এবং দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। একসাথে একটি দেশের গোটা পার্লামেন্টের পলায়ন ইতিপূর্বে বিশ্বে আর ঘটে নি। আন্দোলন ও ভিন্নমত দমন করতে হাসিনা সরকার মৌলবাদী শক্তি ও জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান ঠেকাতে স্বাধীনতার চেতনা নামে একটি গণহত্যা পরিচালনা করে। শেখ হাসিনার শাসনামলে অগণিত মানুষ নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়। তার নির্দেশে গণহত্যায় অসংখ্য শিশু, ছাত্র, জনতা নিহত হয়েছে। এমনকি নিজের বাসস্থানে বা পিতার কোলেও সন্তান নিরাপদে থাকে নি। আহত হয় লাখ লাখ জনতা।
গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হাসিনা পলায়ন করে ভারতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সরকারের প্রত্যেকটি জনপ্রতিষ্ঠানে ও সচিবালয়ে যারা স্বৈরশাসকের অপশাসনকে সায় দিয়ে, গণহত্যাকে সমর্থন দিয়ে এবং সরকারের পক্ষে দালালি করে জনমানুষের উপর জুলুম নিপীড়ন নির্যাতন ও দুর্ভোগকে প্রলম্বিত করেছে সেইসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানসহ অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীরা বহাল তবিয়তেই আছে। এইসব দালালরা পদচ্যুত না হওয়ায় এখনো বিভিন্ন ভাবে জনমানুষকে হয়রানি করছে এবং নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নে ক্রিয়াশীল। তাদের রোষানলের শিকার হচ্ছে গণঅভুত্থানের অগণিত সমর্থনকারী। মৌলবাদীরা আবার শক্তিশালি হতে পারে এই সতর্কতা ও ভীতি হাসিনার স্বাধীনতার চেতনা মতবাদের একটি প্রধান চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং এটি আজও কার্যকর করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে গণ অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং তাদের মিডিয়া বিষয়টি ভিন্ন খাতে নেয়ার চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে এবং এদেশের কিছু কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার দোসর হাসিনার হারানো জনমত ফিরিয়ে এনে তাকে প্রতিষ্ঠা করার প্রচার প্রপাগান্ডায় লিপ্ত আছে। এর পূর্বে পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে গঠিত ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সক্রিয় আওয়ামী লীগের বিলুপ্ত সশস্ত্র শাখা জাতীয় রক্ষীবাহিনী, রাজনৈতিক হত্যা, ডেথ স্কোয়াড দ্বারা গুলি এবং ধর্ষণের অসংখ্য অভিযোগে জড়িত ছিল। তিনি ১৯৭৫ সালে সামরিক বাহিনীর কিছু অফিসারের অভ্যুত্থানে নিহত হন। এই দলটির বিরুদ্ধে ইতিপূর্বেও গণহত্যার অভিযোগ আছে যার কোনপ্রকার আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার সম্পন্ন হয় নি।
এমন পরিস্থিতিতে আমাদের মনে এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠছে, হাসিনা কি ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তোর মতো পার পেয়ে যাবে?