পোস্টস

গল্প

রক্ত ক্ষরণ

২১ আগস্ট ২০২৪

ফারহানা মোবারক

একটা দিন সুস্থভাবে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য কত হুলস্থুল, কেউ একটা ভ্রূণ বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে যায় আবার কেউ একটা ভ্রূণ মেরে ফেলে এখানে এসে ছুটাছুটি করে। এখানে আসলে পৃথিবীর সত্যি টা খুব কাছে থেকে দেখা যায়। জীবনে জন্ম মৃত্যুর মতো সত্য মনে হয় আর কোন কিছুতে নেই। সিস্টার রক্ত নিলেন। যার পোষ্ট পড়ে রক্ত দিতে এসেছি সে খুব ভালো যত্ন করে কথা বলছিল। আজকাল তো ভালো আচরন পাওয়া ও দুষ্কর। হসপিটালের বারান্দা দিয়ে বেরোচ্ছিলাম হঠাৎ শূনতে পেলাম কেউ একজন ভাইয়া বলে ডাকছে। পিছন ফিরতেই দেখি অপর্ণা। এই সেই অপর্ণা, যাকে মাথায় দুই বেনী, আর বটল গ্রিন কলেজ ড্রেসে প্রথম দেখেছিলাম। বয়সে যতটা সে ছোট তার চেয়ে বেশি ছোট ছিল আচরণে। আমার ক্লাস ফ্রেন্ডের ছোট বোন। এখন কেমন ম্যাচিউরড হয়েছে। পিছন ফিরতেই বললো, ভাইয়া চলো ঐ কেবিনে, তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেই। ওর হাসি হাসি মুখ দেখে বুঝতে পারলাম কি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে আমার জন্য। 
হসপিটালে সাধারণত খুশির খবর খুব কম শোনা যায়। আর যা শোনা যায় তা শুধু “অপারেশন সাকসেসফুল” আর না হয় নবজাতকের কান্নার শব্দ। নিশ্চয়ই ওর বোন মা হয়েছে আর সেই খুশি ভাগ করার জন্য আমাকে নিয়ে এসেছে। কেবিনে ঢুকতেই দেখলাম অপর্ণার মায়ের কোলে ফুটফুটে একটি শিশু আর ওর বোন অতশী বিছানায় শুয়ে আছে। শিশুটি দেখতে অবিকল তার বাবার চেহারার। শুনেছি বাবার গড়ণের মেয়েরা খুব ভাগ্যবতী হয়। অতশীর মেয়ে, ভাগ্যবতী তো হবেই । অতশী, যার সাথে এক সারিতে বসে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো পার করেছিলাম। ক্লাসের সবচেয়ে মুখচোরা স্বভাবের আমি ঘাপটি মেরে বসে থাকতাম একপাশে। অতশীই শিখিয়েছিল সবসময় সামনে বসতে হয়, তাহলে টিচারের কথা ভালো শোনা যায়। সেই থেকে সামনের সারিতে আমরাই বসতাম। ক্লাসে সবার আগে খাতা জমা দেয়া, সেমিস্টার শেষে বই কিনে ফেলা, রিপোর্ট -প্রেজেন্টেশন সবার আগে সাবমিট করা এগুলো ছিল আমাদের গ্রুপের কাজ। যদিও পরীক্ষার রেজাল্ট আমাদের তেমন ভালো হতো না। অতশী রাত জেগে প্রচুর পড়তো। কিন্তু সেই অনুযায়ী নাম্বার আসতো না। ওর বানান ভুল করার অভ্যাস ছিল। আহারে বানান, বেচারি বানানের টেনশনে আরও বেশি বানান ভুল করতো। আমার হাতের লেখা ওর খুব পছন্দ ছিল। সবসময় বলতো, তোর মতো করে লিখবো , এক পৃষ্ঠা লিখে দে। আমি এক পৃষ্ঠা লিখে দিতাম, ও সেই লেখার উপর হাত ঘুরাতো। একেক টা রিপোর্ট, প্রেজেন্টেশন জমা দেয়ার সময় তার কি তাড়াহুড়া, খাওয়া দাওয়া, ঘুম সব বন্ধ করে কম্পিউটার ল্যাব এ বসে থাকতো। গ্রুপের কাউকে ছাড় দিতো নাএক চুলও। আমি পড়ার প্রতি বরাবর বেখিয়ালী ছিলাম। জোর করে ক্লাসের শীট আমার ব্যাগ এ গুঁজে দিতো। আমাদের পরীক্ষার ফলাফল প্রায় কাছাকাছি ছিল। ও সবসময় বলতো, তুই না পড়লেও অনেক কিছু পারিস, একটু ভালো করে পড়। তারপর একসময় আমাদের ক্লাস ফুরালো, ফুরালো ব্যাচালার ডিগ্রি শেষ করার অপেক্ষারা, রিপোর্ট প্রেজেন্টেশন ফুরালো, আমাদের বাসের জন্য অপেক্ষা করার দিন ফুরালো, দিদির ক্যান্টিনের রিযিক ফুরালো। আমাদের গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়ার পর একদিন ওর মায়ের ফোন পেলাম। ওর আশীর্বাদ এর দাওয়াত দিয়েছিল। নতুন অফিস নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, ব্যস্ত ছিলাম বলে সেদিন আর যাওয়া হয়নি। তার কিছুদিন পর ওর বিয়ের দাওয়াত পেলাম। ওর মায়ের আবদার ছিল আমাকে যেতেই হবে, আশির্বাদ এ না যাওয়ায় খুব কষ্ট পেয়েছেন। ওর বিয়েতে গেলাম, সেদিন ওকে দেখলাম বউয়ের সাজে, দেবীর মত লাগছিল দেখতে, মনে হচ্ছিল এতদিন কাকে দেখেছিলাম । আজকে যাকে দেখছি সে যেন সম্পূর্ণই আলাদা একটা মানুষ। চোখে মুখে বরের জন্য অপেক্ষা আর গহনা শাড়ি সামলানোর কি পরিপক্ক চলাফেরা। সময় গড়িয়ে ওর কাঙ্ক্ষিত লগ্ন আসে। সারাদিন ওপোস থেকে ওর নাকি শরীর খারাপ হয়ে গেছে, তবুও চোখে মুখে প্রাপ্তির নেশা। ওর সিথীতে যখন টকটকে লাল সিঁদুর, তখন আমার পাঁজর জুরেও লালের স্রোতধারা বয়ে চলছিল। কোথা থেকে যেন একেকটা খোঁচা লাগছিলো হৃদপিন্ডে। খত বিক্ষত হচ্ছিল বুকের ভেতর টা।
আজকেও দুই বছর পর সেই একই অনুভূতি। সময়ের সাথে সাথে আমাদের স্মৃতি থেকে দুঃখ গুলো একটু একটু করে ঝাপসা হয়ে যায়। কিন্তু এই অনুভূতি যেন ঝাপসা হওয়ার না।

সেদিন ওর বাবা পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে ঠান্ডা মাথায় অনেক কিছু বলছিলেন।মনে হচ্ছিল আমি কোন ছোট শিশু, খেলনার জন্য বায়না করেছিলাম তার কাছে , তিনি না দিতে পেরে আমাকে স্বান্তনা দিচ্ছেন। আজকে স্বান্তনা টুকুও দেবার মতো কেউ নেই।
অতশীর মা ওর মেয়েকে আমার কোলে দিয়ে হাসতে হাসতে ছড়ার মতো বলতে লাগলো, মামার কোলে গেছো! মামার কোলে!

আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছিল, চোখে সব ঝাপসা দেখছিলাম। সৌজন্যতা শেষ করে কোন রকমে কেবিন থেকে বের হলাম। কয়েক কদম যাওয়ার পর সেই লোকটার সাথে দেখা, মুচকি হেসে বললেন, ভাই আসেন কেবিনে। রোগী আমার বৌদি হয়, আমার বৌদি আর তার মেয়েকে আশির্বাদ করে যান। আমি হতবাক হয়ে ঐ কেবিনের দিকে তাকালাম। যেখান থেকে বের হতে চাচ্ছি , বার বার কেন যেন সেখানে জড়িয়ে যাচ্ছি। বুঝতে আর বাকি রইলো না। আজকে যাকে রক্ত দিলাম, সে আর কেউ নয়। সে অতশী। লোকটাকে নয় ছয় বুঝিয়ে বের হয়ে এলাম। অতশী কোনদিন না জানুক আমার বুকের রক্ত ক্ষরণ, কোনদিন না জানুক একজন মুসলিম এর রক্ত তার শরীরে । কেউ না জানুক আমি জানি ও কতটা ধর্মান্ধ।

বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে, হালকা ঠান্ডা বাতাস বইছে। এ যেন প্রকৃতির কাছ থেকে পাওয়া স্বান্তনা। মনে হচ্ছে প্রকৃতি বলে দিচ্ছে, কেঁদে নাও , কাউকে না বলতে পারা কষ্টগুলো অশ্রু হয়ে ঝরে পরুক। আমি হাঁটছি আর ভাবছি, রক্তের কি কোন ধর্ম হয়? রক্ত দেখে কেন বোঝা যায় না কে কোন ধর্মের?