এক.
ঐতিহাসিক এক সময় পার করছে বাংলাদেশ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বদলে গেছে দৃশ্যপট। পুরনো সরকারের বিদায় হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। সামনে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আরেকটি নির্বাচিত সরকার হয়তো আমরা দেখতে পাবো। এই যুগসন্ধিক্ষণে চারদিকে পরিবর্তনে সুর শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনও বাদ যাচ্ছে না এই সুরের মুর্ছনা থেকে। এই অঙ্গনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন নিয়ে কানাঘুষা চলছে। অতীতের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনাও চলছে জোরেশোরে। সবাই চাচ্ছেন সুপরিবর্তন, ইতিবাচকতা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়েছেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া। জীর্ণ-পুরনোকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে তার নেতৃত্বে দেশের ক্রীড়াঙ্গন ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকেই এগোবে--এমন প্রত্যাশা এখন আর বাহুল্যতা নয়। এই তরুণ তুর্কি তথা নতুন সরকারের কাছে মোটা দাগে দুটি প্রত্যাশা রাখতে চাই। প্রথমত, গোটা ক্রীড়াঙ্গন রাজনীতি, দুর্নীতি আর অনিয়মের কলুষতা থেকে মুক্তি পাক। দ্বিতীয়ত, সমস্যাগুলো সারিয়ে ক্রীড়াঙ্গন হোক স্মার্ট।
দুই.
বস্তুত দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতির যে কলুষতা, সেটা ক্রীড়াঙ্গনেও চেপে বসে। বাংলাদেশের কথা যদি স্পষ্ট করে বলা হয়, ক্রীড়াঙ্গনের একটা খাতও পাওয়া যাবে না যেটা রাজনীতিমুক্ত। সঙ্গে যোগ করেন দুর্নীতি। এ দুইয়ে মিলে ক্রীড়াঙ্গনে চলছে হরিলুট। কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। দুর্নীতিতে অভিযুক্ত, দেশ ছেড়ে পলাতক পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে দাবা ফেডারেশনের সভাপতি পদ আকড়ে আছেন। মুমিনুল হক সাঈদ ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত। অথচ আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছায়ায় তিনি হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক!
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে (বিসিবি) নির্বাচনের মাধ্যমে পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হয়। কিন্তু দলীয় প্রভাব না থাকলে কেউই এই পর্ষদে আসতে পারেন না। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন যদি আওয়ামী লীগদলীয় এমপি বা নেতা না হতেন, তার পক্ষে এই পদে আসা সম্ভব ছিল না, এক যুগ কাটানো ছিল অসম্ভব। শেখ কামালের বন্ধু পরিচয়ে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতির পদ আকড়ে আছেন কাজী সালাউদ্দিন। একই পরিচয়ে এক যুগ ধরে বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের মহাসচিব পদে আছেন সৈয়দ শাহেদ রেজা। এম বি সাইফ মোল্লা সাঁতারু ছিলেন, সাঁতার সংগঠকও ছিলেন না; অথচ তিনি আওয়ামী লীগদলীয় প্রভাবে সাঁতার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বনে আছেন বহুদিন ধরে।
বিলুপ্ত আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রী নসরুল হামিদের ছোট ভাই পরিচয়ে শুটিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে তিন মেয়াদ ধরে বসে আছেন ইন্তিখাবুল হামিদ। অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনেও রাজনীতির ছায়া; এখানে আওয়ামী লীগ পরিচয়ে আব্দুর রকিব মন্টু সাধারণ সম্পাদকের চেয়ার দখলে রেখেছেন। ভলিবল ফেডারেশনের সভাপতি আওয়ামী লীগদলীয় (সদ্য অপসারণকৃত মেয়র) আতিকুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক একই দলের আশিকুর রহমান মিকু। উশু ফেডারেশনের সভাপতি দুর্নীতিতে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সোবহান গোলাপ। কোনটা রেখে কোনটা বলবেন, তালিকা যে অনেক লম্বা! দেশের জেলা বা বিভাগীয় প্রত্যেকটা ক্রীড়া সংস্থায় যে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে, সেটা বলাই বাহুল্য। এর আগে যারা সরকারে ছিলেন, সে সময়ও একই দৃশ্যপট ছিল।
যদি সুফল আসতো, স্বচ্ছতা আর জবাবদিহিতা থাকতো, তাহলে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে কথা না বললেও চলতো। কিন্তু ফলাফল কোথায়? এক ক্রিকেট ছাড়া আর ফেডারেশন বা সংস্থা ন্যুনতম ভালো করতে পারছে? ফুটবল, অ্যাথলেটিকস সবই তো ধ্বংস। এই যে প্যারিস অলিম্পিক গেল, বাংলাদেশের অর্জন ডাবল জিরো! নামেই কেবল অংশগ্রহণ, একটা ইভেন্টেও ন্যুনতম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেই আমাদের কারো নাম। প্রত্যেকটা ফেডারেশনে অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি জেঁকে বসেছে। অনেকেই হয়তো বিসিবিতে স্বচ্ছতা আছে, এই দাবি তুলবেন। অথচ দেখুন, দেশের সকল ক্রীড়া স্থাপনা নির্মাণ, সংস্কারের দায়িত্ব জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের। কিন্তু বিসিবি পরিষদকে পাশ কাটিয়ে নিজেরাই স্থাপনা নির্মাণ ও সংস্কারে টাকা খরচ করে। কারণ কী? কারণ, নিজেরা টাকা খরচ করলে নয়-ছয়ের সুযোগ সহজ হয়। বাংলাদেশ জাতীয় দলের মিডিয়া রাইটস, টিভি সত্ব, ফ্র্যাঞ্জাইজি লিগ বিপিএলসহ নানা আর্থিক উৎস বিসিবির পরিচালকদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়। আইসিসি, এসিসি কিংবা স্পন্সর বাবদ বিপুল অর্থের আয় কিংবা ব্যয়ের প্রতিবেদন প্রকাশ করে না বিসিবি।
আমাদের যে নতুনের হাওয়া লেগেছে সর্বত্র, এই হাওয়ায় ক্রীড়াঙ্গনের দূষিত গন্ধ যেন দূর হয়ে যায়। রাজনৈতিক বিবেচনায় যারা বছরের পর বছর ধরে পদ আকড়ে আছেন, সর্বেসর্বা বনে গেছেন, তাদের যেন বিদায়ঘন্টা বেজে ওঠে; ইতিমধ্যে কেউ কেউ নিজ থেকে পদত্যাগ করে মান বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। যারা প্রকৃত ক্রীড়া সংগঠক, যারা নিবেদিতপ্রাণ, যাদের মাধ্যমে ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাদেরকে ক্রীড়াঙ্গনের নেতৃত্বে নিয়ে আসা হোক। দুর্নীতির যে কালো ছায়া ফেডারেশনগুলোকে ঘিরে আছে, এর অবসান জরুরি। প্রত্যেক ফেডারেশনে যাতে স্বচ্ছতার সাথে আয়-ব্যয়ের প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশ করে, নতুন সরকারের দায়িত্বশীলদের এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জেলা ক্রীড়া সংস্থার নেতৃত্বে আছেন, এমন অনেক ব্যক্তি আবার ফেডারেশনের দায়িত্বেও আছেন। এই প্রবণতা বন্ধ করা প্রয়োজন। যিনি ফেডারেশনে থাকবেন, তিনি জেলায় থাকবেন না; জেলায় থাকলে ফেডারেশনে নয়--এমনটা হলে ক্রীড়াঙ্গনই উপকৃত হবে; কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের বিষয়ও থাকবে না। খুব বেশি দক্ষ, যোগ্য না হলে কোনো ফেডারেশনেই যাতে একক ব্যক্তি এক যুগ, দেড় যুগ নেতৃত্বে না থাকেন, সেটাও নিশ্চিত করা দরকার।
আলাপকালে যেমনটি বলছিলেন সাবেক ফুটবলার শেখ মোহাম্মদ আসলাম, ‘একেকজন ব্যক্তি একেক জায়গায় ১০-১২ বছর ধরে বসে আছেন। কিন্তু কোনো ফল নেই। সেসব জায়গায় পরিবর্তন আনতে হবে। ক্রীড়াঙ্গনে জবাবদিহিতা জরুরি। প্যারিস অলিম্পিকে বাংলাদেশের যে দলটি গেল, তাদের কী জবাবদিহি ছিল? ছিল না। যোগ্য লোককে যোগ্য স্থানে লাগবে। তাতেই আসবে পরিবর্তন।’
সবচেয়ে বড় বিষয়, বিসিবি, বাফুফে বা অন্য কোনো ফেডারেশনেই যাতে যেনতেন নির্বাচন না হয়। ‘আমরা আমরাই’ নির্বাচন করে দলীয় লেজুড়বৃত্তিতা প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা যেন এবার থামে। একদল বিদায় নিয়েছে, আরেক দল এসে যাতে গেড়ে বসতে না পারে। ক্রীড়াঙ্গন প্রকৃত ক্রীড়া সংগঠকদের আবাস হতে হবে।
রাজনীতিমুক্ত ক্রীড়াঙ্গনের দাবি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন সাবেক হকি তারকা রফিকুল ইসলাম কামাল, ‘রাজনীতিমুক্ত ক্রীড়াঙ্গন চাই। যারা খেলাধুলা ভালোবাসেন, খেলার লোক, এমন ব্যক্তিরাই ফেডারেশনে আসুক। এমন কেউ থাকা ঠিক না, যারা এসে গ্রুপিং করবেন, বিভেদ তৈরি করবেন।’ ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে কয়েকদিন আগে নিজের এক কলামে খ্যাতিমান ক্রিকেট বিশ্লেষক নাজমুল আবেদীন ফাহিম লিখেন, ‘স্বচ্ছতার একটা সংস্কৃতি দরকার, যেখানে হিসাব-কিতাব থাকবে কাজের। উন্নতি-অবনতির হিসাব-কিতাব থাকবে, জবাবদিহি থাক।ে এমন একটা জিনিস দেখতে চাইব, যেখানে পেশাদারি আছে, জবাবদিহি আছে।’
তিন.
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সমস্যা অনেক। সাফল্যের জন্য এখানে নেই সুপরিকল্পনা, নেই পর্যাপ্ত অবকাঠামো। মুখের কথায়ই যেন এখানে সাফল্য চলে আসবে! মাত্রই শেষ হলো অলিম্পিকের মহাআসর। পার্শ্বস্থ ভারতের সাথে যদি একটামাত্র ইভেন্টের তুলনা করা হয়, প্রতি বছর দেশটি শুটিংয়ের জন্য খরচ করে ৫০ থেকে ৬০ কোটি রুপি। আর বাংলাদেশে এক্ষেত্রে খরচের কোটা মাত্র ১০ থেকে ১১ লাখের মতো! জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরনো ভবনের পাশেই নতুন সুরম্য অট্টালিকা হয়েছে। কিন্তু সেখানে অ্যাথলেটদের জন্য নেই একটি আধুনিক পরিপূর্ণ জিমনেসিয়াম। পুরনো জিমনেসিয়ামে গাদাগাদি করে একাধিক ডিসিপ্লিনের খেলোয়াড়েরা অনুশীলন করেন। জায়গা পাওয়া নিয়ে প্রায়ই মনোমালিন্যও হয় সেখানে। সাউথ এশিয়ান গেমসে দুটি স্বর্ণপদক এনে দেওয়া ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার একটি মানসম্পন্ন অনুশীলন স্থান ও জিমের কথা বহুবার বলে ক্লান্ত।
পরিকল্পনাহীন ফুটবল তো এখন মৃতপ্রায়। দুর্নীতিগ্রস্ত বাফুফে কর্মকর্তারা খোদ ফিফার শাস্তি পেয়েছেন। নতুন ফুটবলার তুলে আনার লক্ষ্য নেই, জেলা ফুটবল লিগ নিয়মিত রাখার আগ্রহ নেই, কর্তাব্যক্তিরা দলাদলি আর প্রভাব বিস্তারেই ব্যস্ত। ফুটবল থেকে স্পন্সররাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ক্রিকেটও ভালো নেই খুব একটা। মাঝেমধ্যে সাফল্য এলেও ভিত যেন ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। রাজনীতির অপচ্ছায়ায় খোদ সিনিয়র ক্রিকেটাররাই জড়িয়ে পড়ছেন। জাতীয় দল নিয়ে শোনা যায় পক্ষপাতিত্বের নানা অভিযোগ। আর্থিক ভিত্তি শক্ত হলেও দেশজুড়ে ক্রিকেট একাডেমি গড়তে পারেনি বিসিবি। ঘরোয়া ক্রিকেটের মান প্রশ্নবিদ্ধ। পাতানো খেলার অভিযোগ ওঠে প্রত্যেক মৌসুমে। দেশে সেই ১৯৯৮ সালে প্রথমবার জাতীয় ক্রীড়া নীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল। নতুন ক্রীড়া নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটি বেশ কয়েক বছর ধরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
অরুণোদয়ের তরুণ আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ক্রীড়া উপদেষ্টা হিসেবে এসব প্রত্যেটা বিষয়ে নজর দেবেন বলে আমরা প্রত্যাশা রাখতে চাই। ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের চেয়েও অলিম্পিকের একটা পদক যে অনেক দামি, এটা অনুধাবন করে দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। সাঁতার, শুটিং, তায়কোয়ান্দো, রেসলিং, ভলিবল, ভারোত্তোলন, জিমন্যাস্টিক প্রভৃতি ইভেন্টের দিকে বাড়তি মনোযোগ দেওয়া হোক। আধুনিক জিমনেসিয়াম, অনুশীলনের মানসম্মত স্থান, অভিজ্ঞ কোচের বিষয়গুলো নিশ্চিত করা ছাড়াও অ্যাথলেটদের যাতে নিয়মিত সম্মানজনক সম্মানী প্রদান করা যায়, সেই ব্যবস্থাও নিতে হবে। বিকেএসপি থেকে কেন মানসম্মত অ্যাথলেট বের হয়ে আসছে না, এটিও খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ নেওয়া জরুরি। সুনির্দিষ্ট, সুপরিকল্পিত আর দূরদর্শী রোডম্যাপ ধরে ক্রীড়াঙ্গন হবে স্মার্ট, এগিয়ে যাবে সাফল্যের পথে--এমনটাই সকলের চাওয়া।