পোস্টস

গল্প

অপয়া শম্বুক

২৩ আগস্ট ২০২৪

নীলকর সাহেব

আলো আঁধারিয়া আবছা অন্ধকার কারাগারের এক সংকীর্ণ প্রকোষ্ঠ। ঘরটা এতই ছোট যে আগে পিছে তিনকদম হাঁটলেই দেয়ালের সীমানায় পৌঁছা যায়। স্যাঁতসেঁতে এই ক্ষুদ্র ঘরেই গত পনের বছর ধরে বন্দি সে।সঙ্গী বলতে অন্ধকারের বোকা জীব একজোড়া ছুঁচো। কি অপরাধে সে বন্দি হয়েছিল তা এখন আর ভাল মনে নেই। যদ্দূর মনে পড়ে খুনের দায়ে তার এই সাজা যাবজ্জীবন কারাবাস। সত্যি বলতে এই কারাগারে এখন আর কষ্ট হয় না তার। আগের মত মুক্ত বাতাসের খোঁজে ফুসফুস আর আকুল হয়ে উঠেনা। মনের ভারী কষ্টগুলো কারাঘরের এই পরিবেশের মতই মনে তার গুমোট  হয়ে জমে আছে। এখানে কোন ছিদ্র নেই যে বাইরের একফোঁটা সূর্যের আলোক শিখা প্রবেশ করবে। কারাগারের এই অন্ধকারের সাথে বাইরের আলোর কি এমন শত্রুতা? বুঝেনা সে। বাইরে আলোর ঝলকানি আর এখানে অন্ধকার, মধ্যখানে নিরেট প্রস্তরের দেয়াল। অন্তরে ভালবাসা পুষে রেখে অনুশোচনায় পুড়তে হলে কারাগারের অন্ধকারে আসতে হয়। আঁধারের মমতা পেয়েই বোধহয় ভালবাসারা বেড়ে উঠে। আর আশা-নিরাশার দোদুল্যমান ডালপালাগুলি ছড়িয়ে যায় মনের পুরো ক্যানভাসজুড়ে। 



 

মেয়েটির নাম শিলু। একটি জন্মগত ত্রুটি আছে তার। কথা বলতে পারেনা ও। বোবা। শিশুবেলা থেকেই এজন্য আরেক নাম পেয়েছে সে- মূকি শিলু । কিন্তু এই সমস্যা না থাকলে খুব অল্প বয়সেই হয়তো তার বিয়ে হতো। দেখতে খুবই সুন্দরী শিলু। অমন ডাগর ডাগর চোখ, ফর্সা গায়ের রঙ আর মায়াভরা গোলাকার চেহেরা যে একবার দেখেছে সেই মনে রেখেছে। আশেপাশে দশ গ্রামজুড়েও এমন সুন্দরী মেয়ে নেই। কিন্তু ওই যে সে বোবা? কেইবা বিয়ে করতে চাইবে একটা বোবা মেয়েকে। গ্রাম সমাজে প্রতিবন্ধীদের করুণার চোখে দেখে মানুষ। এখানে সুন্দর ধুয়ে কেউ পানি খায় না। ঘরের সব কাজ, বাচ্চা সামলানো, আগুন রোদে বাইরের ধান মাড়াইয়ের কাজ, ক্ষেতের কাজ সবকিছু করে চেহেরার সৌন্দর্যের কতটুকুই বা বাকী থাকে? গ্রামের নিন্মবিত্ত পরিবারে জন্মানো চাঁদের মতো চেহেরা আর ফুলের মতো পবিত্রতা নিয়ে দরিদ্র শিলুর কুড়ি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। নাহ কুড়িতে বুড়ি সে হয়নি বরং যৌবনের ভরা দিন এখন তার। এক সন্ধ্যায় পিতা আমিন বেপারীকে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে শিলুর মা নসিমন বিবি তামাক সাজিয়ে নিয়ে এল। সহানুভূতিশীল ভঙ্গিতে স্বামীর পাশে বসে বলল, অমন গালে হাত দিয়া কি ভাবতাছো কও তো। ব্যাপারী বলল, ভাবতাছি যে দিন কাল পড়ছে তাতে তো ভবিষ্যতে সংসার চালানো কঠিন অইবো। নসিমন বিবি বলল, বা রে, ঘরে একটা ডাঙর মাইয়া তার কথা কি ভাবেন না আপনে। মাইয়ার বয়স হইছে বিয়া দেওন লাগত না? বলি কি আমার জমানো কিছু টাহা আছে। ওইগুলান শিলুর বিয়ার লাইগা রাখছি। আমিন মাঝি তামাকের নল থেকে মুখ সরিয়ে বলল, মূক মাইয়া পয়দা করছো, কেডা বিয়া করবো এমন মাইয়ারে?


 

দূরে দাঁড়িয়ে শিলু শুনছিল বাবা মার কথা। পরের কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে যায় তার কাছে।  লোনা পানিতে টলমল করছিলো পটলচেরা দুটি চোখ। অন্যরা ওর কথা শুনতে না পেলেও ও পায়। বুকের ভেতর থেকে কে যেন ওর কানে কানে আওড়ায়, তুই যে বোবা কথা বলতে পারিস না তুই! তুই বোবা, তুই মূক। আর ভাবতে পারেনা শিলু। উড়নার কোণা দিয়ে চোখ মুছে ছুটে যায় একটু দূরে মিয়াদের পুকুর পাড়ে। এই পুকুরটা বিশাল বড়। হনু মিয়া বড় সাধ করে কাটিয়েছে বছর সাতেক আগে। পুকুরে মাগুর মাছ হয় খুব। ফি বছর দুই সিজনে দশ বারো কেজি পর্যন্ত ওজনের মাছ তোলা হয়। দুই পাড়ে দুইটা শানবাঁধানো ঘাট। এ পাড়ে শিলুদের বাড়ি, ওপাড়ে হনু মিয়ার। এ ঘাটের পাশে একটা বকুল ফুলের গাছ আছে। বকুল খুব পছন্দ শিলুর। তার মনে যখন খুব দুঃখ থাকে তখন সে এই ঘাটে আসে। গাছটাকে নাড়া দেয় দুহাতে। আর গাছটাও তাতে সাড়া দিয়ে ফুল ঝরিয়ে দেয় শিলুর গায়ে। ঝরা ফুল হাতে নিয়ে ঘাটে বসে শিলুর সব দুঃখ সে গাছটাকে বুঝায়। আজও সে ফুলগুলো নিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। তার কান্না যেন আজ থামছেনা কিছুতেই। এই মূকতার জন্যই তো তার বিয়ে হচ্ছেনা। কিন্তু এ তো স্রষ্টা তার ইচ্ছেমত সৃষ্টি করেছে, যেটা স্রষ্টার ভাল লেগেছে সেটা কেন মানুষের ভাল লাগেনা? আকাশের দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে ও।


 

সন্ধ্যার ঘন আবির মাখা রঙ আকাশের বুক থেকে মুছে দিতে ঝুপ করে নেমে এল আবছা অন্ধকার। বুনো পাখিরা কিচিরমিচির করতে করতে ফিরে যাচ্ছে নীড়ে। সেই ভোর সকালে খালিপেটে বেরোয় এসব বিহঙ্গগুলো। আর সন্ধ্যায় ফেরে পেটভর্তি করে। তাদের সঙ্গী জোড়াটা সবসময়ই একসাথে থাকে। ষড়ঋতুর প্রত্যেক বৈচিত্রেও তাদের ভালবাসার বৈচিত্র হয় না। আহ! কি নির্ঝঞ্চাট জীবন তাদের। শিলু তো এমনই একটা জীবন চেয়েছিল। শান্ত, গতিশীল নদীর মত। স্বাধীন পাখির মত জীবন। হঠাৎ পেছনে কার পায়ের শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে চাইলো সে। শুকনো পাতা মাড়ানোর শব্দ শুনতে পেল। দেখল, দীর্ঘ একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। কে ওখানে! চোখের জোর চাহনি আগুন্তকের চোখে পড়তেই চিনতে পারলো। হনু মিয়ার ছেলে। লম্বা ফর্সা একহারা গড়নের সুদর্শন যুবক। নাম সবুজ মিয়া.....


 

- কিরে শিলু অন্ধকারে কি করিস এখানে?


 

চুপ করে থাকে শিলু। সে তো কথা বলতে পারেনা। কি উত্তর দিবে সে। মনে মনে সবুজ মিয়াকে ভালোবাসে ও। ছোটবেলা থেকেই। যৌবনের প্রথম প্রেম সবুজ মিয়া তার। কিন্তু হায় নিয়তি এ কথা তাকে বলে বুঝানোর ভাষা তার নেই। বড় অসহায় লাগে ওর। 


 

- কিরে কি ভাবছিস? 


 

চমকে উঠলো শিলু। প্রিয় মানুষটা কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ওর। পিলপিল করে সন্ধ্যার অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে পুরো গ্রাম। জোনাকিদের সবুজ বাতি ঝিলমিল করতে শুরু করেছে ঝোপ ঝাড়ে। অন্ধকার নেমে গেছে বলে ঘুম ভেঙ্গেছে ঝিঁঝিঁদের। তারা একসাথে গাইতে শুরু করেছে সবাই৷ নানান সুরে। এ গান, এ সুর, এ বাতি এসব কি আনন্দের কোরাস নাকি বিরহের বুঝতে পারেনা মেয়েটা....