পোস্টস

চিন্তা

আকস্মিক বন্যায় মানুষের মহাবিপদ

২৩ আগস্ট ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

বন্যা যদি ধীরলয়ে আসে মানুষের তবু একটা প্রস্তুতি নেয়ার সময় থাকে। এক রাতে যদি সড়ক তলিয়ে বাড়ি ডুবিয়ে উঠোন পেরিয়ে বসতঘরের মেঝে ছোঁয় -তার চেয়ে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় আর কিছু হতে পারে না। সবকিছু হঠাৎ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ করে দিতে হয়েছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। অকার্যকর হয়ে গেছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। এমন এক মহা বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে কোন মানুষ কী বিপদে যে পড়েছে তা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ছাড়া কেউ জানেন না।

যে ঘরে আজ নতুন শিশু এসেছে সেই মায়ের কোমল আর্তনাদ, যে বয়োবৃদ্ধরা অসুস্থ তাদের দীর্ঘশ্বাস, অবুঝ ও অবোধ শিশুদের হঠাৎ নিরাশ্রয় হয়ে পড়বার ভয়াল কারুণ্য, গবাদিপশুর দুর্বিপাক, বিপুল প্রাণবৈচিত্র্যের বেঘোরে প্রাণপাত; জাস্ট কল্পনা করা যাচ্ছে না। কত মানুষ কাঁদছে, কত হাজার মানুষ না খেয়ে ঘরের চালে বা গাছের শাখায় বসে আছে আমরা তার খবর কিছুই জানি না।

আমাদের জেনারেশন শিশুকালে ১৯৮৮'র বন্যা দেখেছি। চতুর্দিকে ঘোলাজলের দুর্বিপাকে সামান্য খাবার জলের সেকি সংকট। দু'মুঠো খাবার জোগাড়ে সেকি জীবনযুদ্ধ! বিচ্ছিন্ন জনপদে যারা বিপদে পড়েছেন তাদের বেদনা তারা ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবে না।

আমাদের পূর্ব উত্তর সীমান্ত লাগোয়া ভারতের পাহাড়ি রাজ্যগুলোতে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এখনো যা চলমান আছে। কার্যত ভয়াবহ বন্যায় ধুঁকছে সেখানকার অধিবাসীরাও। মারাও গেছেন অনেকে। জল নিচে গড়ায় ওই নিয়মে আমরা যেহেতু নিচের বাসিন্দা আমাদেরকে প্রাকৃতিক নিয়মে ওই বন্যার ধকল সইতে হবে। কিন্তু  বাঁধ উপচে আসা জলে একরাতের মধ্যে আমরা ভেসে যাব -এমনটা প্রত্যাশা করিনি। এর দায় কি ভারত সরকারের? এটা নিয়ে নানামুখী কথা হচ্ছে। আমাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক টানাপোড়েন আছে এটা সত্য। তাই বলে সম্পর্ক তো এমন তলানিতে পৌঁছেনি যে, আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি বা মেনে নিয়েছি যে, বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের চলবে, কিংবা ভারতকে ছাড়াই বাংলাদেশ খুব ভালো থাকবে।

ডয়চে ভেলে জানাচ্ছে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, 'ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেয়ার কারণে বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়ার তথ্য বাস্তবে সঠিক নয়। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গোমতি নদীর অববাহিকা (ক্যাচমেন্ট) এলাকায় কয়েক দিন ধরে এ বছর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বাংলাদেশে এ বন্যা মূলত বাঁধের ভাটির দিকের বৃহৎ অববাহিকার পানির কারণে ঘটেছে।'

কার্যত বাঁধ খুলে দেয়ার কারণে বন্যার খবর নাকচ করে দিয়েছে ভারত। এদিকে সতর্কতা ছাড়া বাঁধ খুলে দেওয়ার মাধ্যমে ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে এবং বাংলাদেশের সাথে অসহযোগিতা করছে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য ও সম্প্রচার এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম।

তবে ভারতের তরফে ওই কথার উত্তর এসেছে ভিন্নতর। উচ্চতার কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাঁধ থেকে পানি বেরিয়েছে বলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা। আজ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যমুনায় মিস্টার ভার্মা বলেন, ত্রিপুরায় অনেক বৃষ্টি হয়েছে। পানির উচ্চতার কারণে বাঁধ থেকে অটোমেটিক পানি রিলিজ হয়েছে। ত্রিপুরায় বন্যা অপ্রত্যাশিত যা দুই দেশেরই সমস্যার কারণ।

বাঁধ খুলে যাওয়ার কারণে হোক আর অতিবৃষ্টিতে হোক বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, খাগড়াছড়ি এখন পানিতে তলিয়ে আছে, লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এটাই বাস্তবতা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় আজ বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) এক তথ্য বিবরণীতে জানিয়েছে, বন্যায় আটটি জেলার প্রায় ২৯ লাখ মানুষ ক্ষত্রিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে বন্যার পানিতে ডুবে দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলেও জানানো হয়। আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও এর সংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসতে পারে। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদীগুলোর সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল থেকে পরবর্তী সময়ে উন্নতি হতে পারে।

বিবিসি বাংলায় পরিবেশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, ভারত থেকে নেমে আসা ঢল ও টানা কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে ফেনী ও নোয়াখালীসহ দেশের আটটি জেলা। মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের স্থল দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করতে থাকায় একের পর এক জনপদ প্লাবিত হচ্ছে। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে ফেনীর বাসিন্দারা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, খাবার সংকট ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে লাখো মানুষ। কেবলমাত্র ফেনীতেই সাড়ে ৩ লাখেরও বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। সব ধরনের যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেছে। এতে চরম দুর্ভোগ ও আতঙ্কে দিন কাটছে নিরাশ্রয় স্থানীয় বাসিন্দাদের।

দুর্গত মানুষকে উদ্ধারে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দরা ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে। কিন্তু এখনো তা খুব অপ্রতুল।

দ্য ডেইলি স্টার জানিয়েছে, আকস্মিক বন্যায় ইতোমধ্যে ৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন, নিখোঁজ আছেন আরো দুইজন। পূর্বাভাস বা আগাম প্রস্তুতি ছাড়াই অন্তত ৩০ লাখ মানুষ বন্যার কবলে পড়েছেন। ৪৩টি উপজেলার ৩৫৭ ইউনিয়নের সাড়ে চার লাখ পরিবার এখন ঘোরতর বিপর্যয়ে আছেন।
এবারের বন্যার সাথে ভারতের নাম জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ ভারতের বেশ কিছু মিডিয়া বাংলাদেশের বন্যা নিয়ে নেতিবাচক শিরোনামে খবর পরিবেশন করেছে। জি ২৪ ঘন্টা খুব উৎসাহ ও তাচ্ছিল্যভরে শিরোনাম করেছে, 'ভারত ছাড়ল জল! হাবুডুবু খেতে খেতে বাংলাদেশের কাতর আর্জি!' মানুষ প্রতিবেশীর প্রতি এমন অনুদার ও অসংবেদনশীল হয়? প্রতিবাদ জানানোর ভাষাও যেন আমরা হারিয়ে ফেলছি।
মানছি বৃষ্টি, বন্যা, বানভাসি ক্রাইসিস ঐশ্বরিক। কিন্তু নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ টোটালি প্রকৃতির স্বাভাবিক গতিবিধির ওপর গুটিকয়েক অমানুষের অশুভ তৎপরতা। আমরা কথা বলব উজানবাসী ভারত কেন নদীর পানি ইচ্ছামতো আটকাবে আর যথেচ্ছাচারে যখন তখন ভাটিতে ছাড়বে? এমনকি সেটি যদি দুই দেশের ব্যবহার উপযোগী বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামেও হয়।

এতদাঞ্চলের রাজনীতিকদেরকে অতি অবশ্যই ভৌগোলিক স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম মেনে সবার স্বার্থ সমান সুরক্ষা করতে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সেটি নদী হোক, সমুদ্র কিংবা সুন্দরবন।

তবে সামষ্টিক ঘৃণা নয়, অহিংস গণমানুষকে ভালোবাসার মন নিয়ে প্রতিবেশী সাধারণ মানুষের সাথে আন্তসম্পর্ক ও সদ্ভাব বজায় রাখতে হবে। যাতে ভৌগোলিক বিবেচনার উর্ধ্বে উঠে সর্বমানুষের হৃদ্যতাপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা যায়। আমরা কোথাও একজন শিশুর কান্নাও আর দেখতে চাই না।

আমরা সবাই যেন দুর্গত মানুষের প্রতি আন্তরিক প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ হাতটা বাড়িয়ে দেই। মহান স্রষ্টা আমাদের সবার সহায় হোন এবং বন্যাদুর্গতদের ভয়াল দুর্ভোগ আশু লাঘব করুন।

ভারত অভিন্ন ৫৪টি নদীতে বাঁধ দিয়ে একচ্ছত্র পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এরমধ্যে ফারাক্কা বাঁধ অন্যতম। এভাবে বাঁধ দিয়ে পানিশূন্য করা বা অতিজলে ভাটি অঞ্চল ভাসিয়ে দেয়া আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং এতদাঞ্চলের ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।

আমরা চাই বড় প্রতিবেশী ভারত যেন পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের জনগণবিরোধী নীতি থেকে সরে আসে। বন্যার মতো অপরাপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রেহাই পেতে দুইদেশ মিলে যেন যৌথ কমিশন গঠন করে। সম্পর্কের ক্রমাগত টানাপোড়েন ও অবিশ্বাস দানা বাঁধতে দিলে এতদাঞ্চলের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ভারসাম্য এবং স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যাবে না। আমরা প্রীতির হাত বাড়িয়ে দিতে চাই, তবে আন্তরিক সম্পর্ক বেগবান করবার বড় দায় ভারতের এটা তাদেরকে উপলব্ধি করতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক
২২ আগস্ট ২০২৪