Posts

গল্প

শেষ-প্রহর

August 23, 2024

নিম্পু মণ্ডল

73
View

ভয়ানক অন্ধকার। অমাবস্যার রাতে যেমন চোখের সামনে হাত ধরলেও কিছু দেখা যায় না, চোখে শুধু জোনাকি জ্বলে- তেমন অন্ধকার। ফরহাদ তবুও অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করতে থাকে। তাকে দেখতেই হবে। অন্ধকারে তার ভারী ভয়। ছোটবেলায় তার বাবা একবার শাস্তি দেওয়ার জন্য বাইরের ঘরে দরজা বন্ধ করে আটকে রেখেছিল। ঘরে আলো ছিল না। কয়েক ঘণ্টার জন্য। ফরহাদের জ্বর উঠে গিয়েছিল। সেই ভয়াবহ স্মৃতি আজ তার অবচেতন মনে রয়ে গেছে। ফরহাদ অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায়। হাহাকারের মতো একটা বাতাস তার গায়ে লাগে। চারপাশে অনন্ত শূন্যতার এক অদ্ভুত অনুভূতি। নিজেকে কেমন জানি হালকা লাগে। হঠাৎ অবর্ণনীয় নৈঃশব্দ ফরহাদকে ঘিরে ধরে। চারপাশে কোনো শব্দ নেই। এরকম শব্দহীনতায় ফরহাদের নিজেকে মৃত মনে হয়। সে চোখ বন্ধ করে ফেলে ভয় আর হতাশায়। নিজেকে প্রশ্ন করে আমি কোথায়? আমি কি করি? এই অন্ধকারে কেন আমি? ধীরে ধীরে তার নিঃশ্বাস ধীর হয়ে আসে। শুল্ক কর্মকর্তা পরিচিতিটা তার মনের মাঝে গর্বিতভাবে জ্বলে উঠে। অন্ধকারের রহস্যটা বুঝতে পারে না ফরহাদ। তার মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠে। মনে পড়ে সুমাইয়ার কথা। তার স্ত্রী। মনে পড়ে তার তিন ছেলে-মেয়ে। ছোট ছেলেটা প্রতিবন্ধী। তার বুকে এক ধরনের ক্রোধ জমা হয়। মেয়েটা ড্রাগ এডিক্ট একটা ছেলের সাথে লিভ টুগেদার করছে। বড় ছেলেটা অবশ্য অন্যরকম। সে সারাদিন চুপচাপ ঘরে বসে থাকে। একেবারেই বাজে একটা পরিবেশ থেকে ফরহাদ উঠে এসেছে শুধুমাত্র নিজের চেষ্টায়। আর্থিক সচ্ছলতা কোনোদিন সে দেখেনি। তবে বাবা মায়ের মাঝে এ নিয়ে কোনো ঝগড়া-ঝাঁটির কথা সে মনে করতে পারে না। তার পাগলাটে ছোট ভাইটা। কে যেন মেরে ফেলেছিল। তখন কতো ওর বয়স-১৫/১৬। বড় দুই বোন আজও বেঁচে আছে কি-না জান না। অনেকদিন খোঁজ খবর নেওয়া হয় না। এত উল্টাপাল্টা স্মৃতি আজ একসাথে আসছে কেন ফরহাদ বুঝতে পারে না। আঁধারটা আরও গাঢ় হয়। আঁধার খুব গাঢ় হলে কুয়াশার মতো ঝাপসা একটা আলো সৃষ্টি হয়। ফরহাদ খুব অবাক হয়। নিজেকে খুব একা লাগে। বাবার ম্লান মুখটা মনে পড়ে। ঠোঁটের কোনে একটু হাসি নাকি ঠোঁটটাই এমন প্রসারিত যে হাসি-হাসি লাগে। চোখের তারায় শুষ্কতা ধরা পড়ে ফরহাদের চোখে। বাবার চেহারা এমন নিখুঁতভাবে মনে রেখেছে সে। মায়ের চেহারা মনে পড়ে না। গায়ের গন্ধটা অবশ্য মনে আছে। কেমন মা মা গন্ধ। ৫৭০ সাবানের গন্ধটা নাকে লাগে ফরহাদের। মা-বাবার জন্য ভারী মায়া লাগে ফরহাদের। শহরে চলে আসার পর ফরহাদের মনে পড়ে সেই বৃষ্টির দিনগুলো। বাবা সকালে মারা গেল। ছয় দিন পর মা। পৃথিবীটা বড় অচেনা লেগেছিল সেইসময়। তারপর চাকরি, বিয়ে, সন্তান। আচ্ছা সুমাইয়া কি তাকে সত্যিই ভালবাসে। রাজীবের ম্যানলি চেহারাটা তার চোখে ভাসে। রাজীবের গায়ের গন্ধটা সুমাইয়ার মতো সেও ভাল করে চিনে। রাজীব চলে গেল আমেরিকায় তারপর আর কোনো গন্ধ পায়নি ফরহাদ। ফরহাদ জানে গোপনতম অন্ধকার। সুমাইয়ার অন্ধকার সে জানে। কিন্তু কিছু বলেনি। কারণ অন্ধকার তারও আছে। তার অন্ধকার তো একটা না- অনেক। কবিদের ‘‘অনেক আকাশের’’ মতো তার অনেক অন্ধকার। একটা লাইনে মাথায় আসে ফরহাদের - 

‘‘ আঁধার সরায়ে দেখি আঁধারের সারি

আঁধারের মাঝে তাই আঁধার হয়ে রই’’

ভাল লাগে তার। একসময় নিজেকে কবি কবি লাগত। কিছু কবিতা লিখেছিল। কিন্তু সবকিছুই শেষ হয়ে যায় চাকরিটা পাবার পর। জীবনকে সে চিনে ফেলে জীবনের মতো করে। এই জীবনে কবিতারা নীল হয়ে মিশে যায়। পায়ের নিচে শক্ত মাটি থেকে যায়। মাটির পৃথিবীতে তাই কাব্য চলে না। ফরহাদ তাই গদ্য শিখে ফেলে। একপাতা দু’পাতা করে সে এক মহা-উপন্যাস লিখে ফেলে। 


তার উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ে আছে কুড়িয়ে পাওয়া এক মানিব্যাগের কথা। ব্যাগে টাকা ছিল। কাগজ পত্রও ছিল কিছু। ঠিকানাও সে বের করেছিল। কিন্তু জীবনের শিক্ষায় শিক্ষিত ফরহাদের কাছে শুধু টাকার কাগজই মূল্যবান। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে চাকরী পাওয়ার গল্প। প্রথম অধ্যায়ের সাথে দ্বিতীয় অধ্যায়ের যোগসুত্র খুবই ঘনিষ্ঠ। রাবেয়ার কথা অপ্রাসঙ্গিকভাবে আছে তৃতীয় অধ্যায়ে। রাবেয়া কাজের বুয়া। ছোটা কাজ করে। ফরহাদ তখন একটা মেসে থাকত। তারা ছয়জন একসাথে একটা ফ্ল্যাটের অর্ধেকটা নিয়ে। তখনও তার চাকরী হয়নি। কোনো এক সময়ে রাবেয়ার সাথে তার দেখা হয় আদিমতম উপায়ে। পাঁচ-ছয় মাস পর ফরহাদ হঠাৎ করেই মেস ছেড়ে আরেক মেসে চলে যায়। রাবেয়ার কথা গোপন সত্য, সহ্য করার সাহস তার ছিল না। চতুর্থ অধ্যায়ে আছে প্রমোশনের গল্প।  এই অধ্যায়ের ছোট্ট একটি পরিচ্ছেদে আছে সুমাইয়ার। একসময় যাকে সে প্রাইভেট পড়াত। এই পরিচ্ছেদটা ছোট। কারণ বিয়েটা হয় একদিন হঠাৎ। খালি বাসায় তার নৈতিক স্খলন ঘটে। এটাই যে প্রথমবার তা নয়। সে জানে এটা সুমাইয়ার ষড়যন্ত্র। সুমাইয়া খুব দ্রুতই মা হয়ে যায়। এটাও একটা ষড়যন্ত্র। ফরহাদের কাছে রাবেয়ার স্মৃতি বেশি মূল্যবান মনে হয়। ফরহাদ নিজেকে প্রশ্ন করে যদি সে চাকরী না করত তাহলে কি করত? উত্তরটাও সে নিজেই দেয়। নিঃসন্দেহে হুন্ডি আর তেলের ব্যবসা। অতএব তার প্রমোশন হয় বছর বছর। পঞ্চম অধ্যায়ে আছে বাড়ীর গল্প, গাড়ীর গল্প। ষষ্ঠ অধ্যায়ে ছেলে-মেয়ের গল্প বলা উচিত ছিল। গল্পটা সে উহ্য রেখে দেয়। সপ্তম অধ্যায়ে মা-বাবার ঋণ পরিশোধের অতিরঞ্জিত গল্পটা তার নিজের কাছেই হাস্যকর লাগে। বোনদের কথাও এই অধ্যায়ে সংযোজিত হয়েছে। অষ্টম অধ্যায়ে আছে একজন সজীব যে তাকে ছোটবেলায় ধর্ষণ করেছিল। এই গল্পটা গোপন তবে সজীব কোনোদিন জানবে না যে ফরহাদের পশ্চাদ যন্ত্রণার মাঝেও কেমন আনন্দ ছিল। এই অধ্যায়ের প্রকাশ্য গল্প বর্ষা। বর্ষাকে সে দেখেছিল যখন সে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। বর্ষার চোখ দু’টা তার আজও মনে পড়ে। এমনকি এই অন্ধকারেও সে এই চোখ দেখতে পায়। কেমন বড় বড় ছলছলে বিষণ্ণ একজোড়া চোখ। বর্ষা দেখতে ভারী সুন্দরী ছিল। একজোড়া হালকা পেঁয়াজ রঙের ঠোঁট। শ্যামলা মুখে তার আশ্চর্য মায়া। এই বর্ণনা শুনে কেও কোনোদিন বুঝতে পারবে না যে ফরহাদ চোখ ছাড়া মেয়েটার আর কোন কিছুই দেখেনি। একদিন স্কুল থেকে বাড়ী ফেরার পথে রাস্তার পাশের একটা বাড়ীর অর্ধেক খোলা দরজার পাশে একজোড়া চোখ সে দেখেছিল। কাজলপড়া চোখ। তারপর কতদিন সে এই পথে হেঁটে গেছে। এই একজোড়া চোখ আর দেখা হয়নি। দেখা হয়নি চোখের অধীশ্বরীকেও। ফরহাদ তাকে ভালবেসেছিল। আজ ফরহাদের কান্না আসে। বর্ষা নামটা সেই দিয়েছে। ছলছল চোখের মেয়ে চোখে শুধু জলই এনেছে। নবম অধ্যায়ে আছে সুমাইয়ার প্রতি তার তীব্র মায়া। সুমাইয়ার গল্প একটা বোকা মেয়ের গল্প। যার জীবন কেটে গেছে শুধু শাড়ি আর গয়না গোছানোতে। এখানে ছেলে মেয়ের কথাও আছে। ওরা সবাই খুশি বাবার জমানো সম্পদ নিয়ে। সম্পদ নিঃশেষে তারা জীবন পণ করেছে। ফরহাদ জানে ওরা পারবে না।

দশম অধ্যায়ে এসে ফরহাদের আঁধার রাত্রি শেষ হয়। নাকি শেষের শুরু। ফরহাদ চোখ মেলে দেখে সুমাইয়া ঘুমাচ্ছে মরার মতো। অল্প অল্প নাক ডাকছে সে। হালকা আলোর ঝালরটা ঘরটাকে রহস্যময় করে তুলে। ফরহাদের পিপাসা বোধ হয়। কিছুটা গরমও লাগছে। এসিটাও চলছে। শো শো একটা শব্দ ফরহাদ শুনতে পায়। ফরহাদ উঠতে চায়। উঠতে পারে না সে। তার সারা গায়ে কোন সারা নেই। ফরহাদ বুঝতে পারে না কি হচ্ছে। তার গরম লাগাটা বাড়তে থাকে। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ফরহাদ এখন রীতিমত ঘামছে। অন্ধকারটা সে চোখের সামনে দেখতে পায়। নীল আলোটা থেকে নেমে আসে অন্ধকার। ধীরে ধীরে বাতাসে ভেসে ফরহাদের দিকে এগিয়ে আসে যেন একটা বাঘ চুপিচুপি হরিণের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ফরহাদ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সে সুমাইয়াকে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে উঠে। কিন্তু কোনো শব্দ হয়না। ফরহাদ তার জিভ নাড়তে পারে না। অন্ধকারটা তার উপর চেপে বসে, জড়িয়ে ধরে। ফরহাদ ঢাকা পড়ে যায় গাঢ় সেই অন্ধকারে। তার দম বন্ধ হয়ে আসে। সারা শরীরে আগুন ধরে যায়। তার মনে পড়ে দশম অধ্যায়টা লেখা হয়নি। একটা সুন্দর উপসংহারের কথাও ভাবে ফরহাদ। হঠাৎ ঘামে ভেজা শরীরটা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এক অপার্থিব শীতল শান্তি ফরহাদের সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ে। বুকে একটা ছুরি বিঁধিয়ে দেয় কেউ। চোখে আতঙ্ক নিয়ে ফরহাদ দেখে মা-বাবা-বোন দের। বাতাসে ভাসতে ভাসতে নেমে আসে সুমাইয়া,তার ছেলে-মেয়েরা। ওদের পেছনে রাজীব হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকে। বড় ছেলেটা হঠাৎ হা হা করে হাসতে থাকে। রাবেয়া আসে একটা রক্তাক্ত বাচ্চা কোলে নিয়ে। একটা এলোমেলো চুলের লোক ছুটতে ছুটতে আসে। ভাই আমার ব্যাগটা দেন। জমি বেচার টাকা। লোকটা চিৎকার করে চলে। একটা লোক গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফরহাদ কিভাবে জানি জানে লোকটা একটা রিকশাওয়ালা। ‘‘ভাই আমার টাকা দেন’’ পাঁচটা মেয়ে একযোগে বলে উঠে। উজ্জ্বল রঙের সাজ-পোশাক ওদের গায়ে। ফরহাদের খুব ক্লান্ত লাগে। হতাশ লাগে। ফরহাদের বুকে তীব্র যন্ত্রণা। পিপাসায় গলা শুকিয়ে ব্যথা করে। হঠাৎ ফরহাদ কেঁদে ফেলে। সে চোখ বন্ধ করে। এই অতল শূন্যতায় বর্ষার চোখ দু’টো খুঁজে চলে।

দশম অধ্যায়টা শেষ না হয় হলই না কিন্তু পরিশিষ্টে বর্ষার চোখ দু’টো তার লাগবেই। মায়াভরা চোখের খুঁজে ফরহাদ আবারও হেঁটে চলে চল্লিশ বছর আগের সেই রাস্তায়।
 

Comments

    Please login to post comment. Login