Posts

গল্প

দৃষ্টি

August 25, 2024

লুলু মারজান দ্বীনা

294
View

-দাদাভাই!

- হুম, বল।

- মেয়েটাকে দেখ।

- কোন মেয়ে?

- ওইযে, ওই বাড়ির জানালায়।

জাওয়াদ এবার বই থেকে মুখ তুললো। ওই বাড়ির জানালায় তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো তার ভাই কার কথা বলছে। তার মনে হলো জানালার পর্দার কাছে একটা আবছা ছায়ার মতো। কিন্তু কোনো মানুষের চিহ্ন সেখানে নেই। মুখে অনেকটা বিরক্তি এনে সে ভাইকে জিজ্ঞেস করলো,

-তোর কি চোখে সমস্যা? নাকি মাথায় সমস্যা? 

দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে রিজওয়ান জবাব দিলো, 

-সমস্যা থাকবে কেন? ওইযে জানালায় দাঁড়ানো মেয়েটা। সবুজ ঘাসফড়িং রং এর শাড়ি পড়া। কপালে খয়েরী রঙের টিপ।

এবার আরেকটু বিরক্তি নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে জাওয়াদ জানতে চাইলো,

-ওই অত দূরের জানালায় দাঁড়ানো মেয়ের কপালে কোন রঙের টিপ তুই তাও দেখে ফেলছিস? ফাজলামো? 

- দাদাভাই, ঝগড়া করছিস কেন? একজনকে দেখলাম তাই তোকে বললাম। এটা নিয়ে এত চুলচেরা বিশ্লেষণের কী আছে? 

বলেই রিজওয়ানের মনে হলো চুলচেরা বিশ্লেষণের দরকার আছে। দূরে হলেও সে মেয়েটার চোখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি ভয়ানক মেয়েটার। খুব খারাপ কিছু হওয়ার আগে মানুষের চোখ যেমন থাকে। বিভ্রান্ত, ভাবলেশহীন আর রক্তবর্ণ চোখ। রিজওয়ানের পেটের ভেতর কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। ভাইকে ডেকেছিলো বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে, কিন্তু ভাই তার সাথে কথা কাটাকাটি করছে শুধু শুধু। ভাবলো সে নিজেই যাবে। বিছানা থেকে নামতেই জাওয়াদ আবারো বলে উঠলো,

-কোথায় যাচ্ছিস? মেয়ে দেখতে?

-হ্যাঁ, যাচ্ছি। বুকের মধ্যে কেমন একটা খচখচানি কাজ করছে।

কি মনে হলো জাওয়াদ বলে উঠলো,

-চল আমিও যাই। 

চারতলা বাড়িটার কলবেল চেপে অপেক্ষা করতে থাকলো দুই ভাই। বাড়িটা কেমন যেন বিষাদগ্রস্ত। মনে হয় একখণ্ড কালো মেঘ বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে। রিনরিনে গলায় কে বলতে বলতে একটা বাচ্চা মেয়ে ছুটে এলো। জিজ্ঞেস করলো,

-কাকে চাই? 

রিজওয়ান কিছু বলার আগেই জাওয়াদ বলে উঠলো,

-তোমার আপাকে একটু ডেকে দেও তো। 

মেয়েটাকে দেখে মনে হলো কেউ তার গালে সপাটে দু'টো চড় মেরেছে। যেমনি চেঁচিয়ে এসেছিলো, তেমনি বাবা বলে চেঁচাতে চেঁচাতে মেয়েটা চলে গেলো। রিজওয়ান অবাক হয়ে তার ভাই এর দিকে তাকালো। এমন গুছিয়ে মিথ্যে বলা তার ভাই কবে থেকে শিখেছে। তাই ভাবতে থাকলো। ততক্ষণে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ নিচে নেমে এসেছেন। সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন,

-তোমরা খুঁজছিলে রিমিকে?

এবারো রিজওয়ানের আগেই জাওয়াদ বললো,

-হ্যাঁ,চাচা। আমরা রিমির স্কুলের বন্ধু। দেখা নেই অনেকদিন তাই আসলাম।

-ও! তোমরা তাহলে খবর পাওনি। আমার মেয়েটা যে আর নেই বাবা।

এই বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন। খুবই অদ্ভুত একটা পরিস্থিতি। কিন্তু রিজওয়ান এর মাঝেও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার ভাই এর দিকে। তার সারাজীবন এর ভালো মানুষ ভাইটি এমন অনর্গল মিথ্যে বলা শিখেছে কোথা থেকে এটাই সে ভেবে পাচ্ছে না। রিমির বাবা ওদের এক প্রকার জোর করেই ওদের বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। ফুপিয়ে কেঁদে চলেছেন। বলছেন মেয়ে কিভাবে মারা গেলো। মেয়ের অমতে জোর করে বিয়ে ঠিক করেছিলেন। মেয়ে তাই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। জাওয়াদ বেশ সহানুভূতি নিয়ে রিমির বাবাকে স্বান্তনা দিচ্ছে। কিন্তু রিজওয়ানের মাথায় এসবের কিছুই ঢুকছেনা। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেয়ালে ঝোলানো রিমির ছবির দিকে। তার গা শিরশির করছে। কারণ রিমিই সবুজ শাড়ি পড়া মেয়েটা। কিছুক্ষণ পর জাওয়াদ বিদায় নিয়ে উঠে এলো। রিজওয়ান এখনো কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। তার সব গুলিয়ে গেছে। 

-দাভাই! মেয়েটাকে আমার ভীষণ চেনা লাগছে৷ কিন্তু মনে করতে পারছিনা। সব কেমন গোলমেলে!

জাওয়াদ কিছু বললোনা। সে জানে রিমিকে রিজওয়ানের চেনা লাগবেই। কারণ রিমিকে রিজওয়ানই গলা টিপে মেরেছে। রিমি রিজওয়ানের প্রেমিকা ছিলো। বাড়িতে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর রিমি বলেছিলো সে রিজওয়ানের সাথে সম্পর্ক রাখবেনা। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে রিজওয়ান গলা টিপে মেরে ফেলে রিমিকে। তার ছোট ভাইটা এরপর লাফিয়ে পড়েছিলো চারতলা থেকে। জাওয়াদের স্পষ্ট মনে আছে। ভাইকে হাসপাতালে রেখে সে রিমির লাশটা ছাদের পিলার থেকে ঝুলিয়ে দিয়েছিলো গলায় দড়ি বেঁধে। মেয়েটা সেদিন ঘাসফড়িং রং এর শাড়ি পড়েছিলো। কপালে ছিলো খয়েরী টিপ। রিজওয়ানের এসবের কিছু মনে নেই। মনে করতেও পারবেনা কখনো। জাওয়াদ মনে করে তার ভাই এর স্মৃতি রেখে রিমি মুছে গিয়ে ভালো হয়েছে। বাড়ি ফিরে রিজওয়ানের ভেতরের অস্বস্তিটা বেড়েই চললো। জানালায় তাকিয়েই দেখলো, ওই বাড়ির জানালায় রিমি দাঁড়িয়ে। স্থির, ভয়ানক দৃষ্টি মেয়েটার চোখে।

Comments

    Please login to post comment. Login