পোস্টস

গল্প

বন্দিনী

২৬ আগস্ট ২০২৪

নিম্পু মণ্ডল

ভোর রাতে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে সে। আলো ফোটার অপেক্ষায় বসে থাকে । এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে। নিজের ঘরটা দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে। সব ঠিকঠাক আছে। বাইরে নিশীথের শিকারী শ্বাপদেরা ঘুড়ে বেড়ায়। এসবে তার কোনো ভয় নেই। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে আলো ডেকে আনে সে। গলার জোরে রাত শেষ করবে। রাতের আঁধার ধূসর হয়ে যায়। ভোর হচ্ছে। এই রহস্যময় সময়ে সে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। তার মতো আরও অনেকেই ভোরের অপেক্ষায়। সারাটা দিন সামনে পড়ে আছে। দিনের গল্পটা সে ভালই জানে। নিজের কালো গা’টা একবার ঘষে দেখে সে। কঠিন দিবসের শুরু তবে হোক। 

 

খাবারের খোঁজে চষে বেড়ায় অনেক দূর পর্যন্ত। দুপুরে ক্ষণিক বিরতি। সন্ধ্যা পর্যন্ত আবারও খোঁজ খোঁজ। সাধারণত দিনগুলো ভালই কাটে। হঠাৎ এক দু ‘দিন খারাপ যায়। তাছাড়া দু’জন মিলে চেষ্টা করলে খাবার যোগাড় করা কঠিন কিছু নয়। সবাই তা-ই করে। 


 

সরিষা ফুলগুলো তখনও কত সজীব। সারাটা দিন বাতাস বয়। পূর্বদিক থেকে কোনো এক অজানা সুর ভেসে আসে। বহুপরিচিত এই সুর। এই সুরের চক্রে বাধা পড়ে থাকে তার জীবন। আর সবার মত ওরাও লাফায় ঝাঁপায়। একটা ঘর তৈরি করে। ভালবাসে। ছেলে-মেয়ে হয়। ওরা বড় হয়। জীবনটা ভালই কাটে। 

 

কোনো এক সরিষার দিনে আমি একা হয়ে যাই অনেক জীবন আগের মত। জোড়া জীবন দেখে আমার কান্না পায় না অবশ্য। আমার জীবনে কান্নার সময় অতি অল্প। প্রায় ভুলেই গেছি একসময় আমরা ছিলাম। আমাদের ভোর হত একসাথে। আমরা কাজ করতাম একসাথে। সারাটা দিন ঘাসে আর আকাশে। সন্ধ্যায় যখন বিলের জল কালো হয়ে যেত আমরা ফিরে যেতাম আমাদের ছোট্ট ঘরে। সারাটা রাত আমরা ঘুমাতাম জড়াজড়ি করে। বৃষ্টির রাতে যখন পানি পড়ত ওকে বুকে আড়াল করে রাখতাম। বৃষ্টির পানিতে বরং আমরা খুশিই ছিলাম। শীতের রাতে শিশিরের শব্দ ঘুম পাড়ানি গানের মত। আমাদের ঘরে আমরা গা ঘষতাম পাশাপাশি শুয়ে। 

 

প্রেতেরা তাড়া করে আমাকে। এই উজ্জ্বল সকালবেলায় আমি পালাই আতঙ্কে। ভর দুপুরেও ওরা তাড়া করে। আমাকে চিনে ফেলেছে। এবার আর হারাতে চাই না ওকে। একবার যখন পেয়েছি  ওকে মুক্ত করবই। এটা কি স্বপ্ন, বিভ্রম নাকি সত্যি। মাঝে মাঝে মনে হয় সবকিছু কত স্বাভাবিক। আবার মাঝে মাঝে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। আমাকে দেখে ও ছটফট করে আমারই মত।  

অনেক দূর থেকেও ওকে আমি দেখতে পাই। ওর গায়ের উত্তাপ পর্যন্ত আমি টের পাই। প্রেতের জালে আটকা পড়ে যায় সে একদিন। মুহূর্তেই সব শেষ। এমনকি ওর শেষ কথাটাও শুনতে পারিনি আমি। অথচ সেই দিনটা কত স্বাভাবিক ছিল। বাতাসে সরিষার ঘ্রাণ আর অজানা পূবালী সুর। 

 

তারপর আজ এই সরিষা দিবসে আবার তাকে দেখলাম। তাকে পূবালী গান শুনিয়েছি আজ। ভালবাসার কথা বলেছি। আমাদের ঘরটার কথা বলেছি। এখনও আগের মতোই আছে। আমি সব ঠিকঠাক করে রেখেছি। জানতাম ওকে পাবই একদিন। মনে মনে একটা বুদ্ধি বের করেছি ওকে মুক্ত করার। যখন প্রেতেরা থাকবে না দু’জন মিলে দেয়ালটা ভেঙ্গে ফেলব। কাজটা খুব শক্ত আর বিপদজনকও। আমাকে ওরা চিনে ফেলেছে। আমি আরও সতর্ক হয়ে উঠি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ওকে এখনই মুক্ত করে ফেলি। আমার অপেক্ষা দীর্ঘতর হয় শুধু। 


 

মাছের সাথে মিশিয়ে দেয়া বিষে কাজ দিয়েছে। কাকটা আর আসে না। জানালা দিয়ে একটা প্রেত তাকায়। যাক,ঝামেলা শেষ হল। কতগুলো গাছ জড়াজড়ি করে আছে। সেখানে অনেকগুলো কাক  চিৎকার করে। দীঘির পাড়ের গাছগুলোতে বসে। সবাই চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। মৃতের প্রতি ভালবাসার নীরবতা অসহ্য হয়ে উঠে। আকাশের গায়ে একটা গভীর আঁচড়ের দাগ লেগে থাকে। উল্টে থাকা কাকটা আর কোনো অভিযোগ জানায়নি। রাত গভীর হয়। কি জানি কেন, এই জঙ্গুলে জায়গায় কাকের মাংসের কদর কেও বুঝল না। ব্যাঙগুলো ডাকতে থাকে। হঠাৎ বৃষ্টি নামে। জানালার পাশে আরেকটা প্রেত আসে। গায়ে তার বৃষ্টির ছাঁট লাগে। জানালা লাগিয়ে বিরক্ত মুখে শুয়ে পড়ে সেই প্রেত। কর্কশ শব্দে বজ্রপাত হয়। ধীরে ধীরে শব্দটা মিলিয়ে যায়। আমগাছের উঁচু ডাল থেকে একটা কাকের বাসা খসে পড়ে মাটিতে।