পোস্টস

চিন্তা

শুভ জন্মাষ্টমী: জয় জগদগুরু শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য

২৬ আগস্ট ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

মহাভারতের কৃষ্ণ-কংস উপাখ্যানের সারৎসার 'তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে' -আমরা‌ প্রায় সবাই জানি। প্রাচ্য মানুষ হিসেবে নিজের অস্তিত্বের শেকড় সন্ধান করতে প্রাচ্যপুরাণের খবর রাখতে হয়।

মহাভারত মতে, কংস নিজের বাবা উগ্রসেনকে বন্দি করে মথুরার রাজা হন। কংসের বোন দেবকীর সঙ্গে বিয়ে হয় বসুদেবের। এসময় দৈববাণী হয়, দেবকীর অষ্টম সন্তান কংসকে বধ করবে। প্রজা নিপীড়ক কংস দেবকী ও বসুদেবকে কারারুদ্ধ করে। কারা অন্তরীণ থাকা দেবকী ও বসুদেবের ছয় সন্তানকে মেরে ফেলে খুনি কংস। সপ্তম সন্তান বলরাম দেবকীর গর্ভ থেকে বসুদেবের দ্বিতীয় স্ত্রী রোহিণী দেবীর গর্ভে প্রতিস্থাপিত হয়। সেখানে গোকুলবাসী রোহিণীর গর্ভে ভাদ্রের আজকের দিনে 'কৃষ্ণ' নামে অষ্টমপুত্রের জন্ম হয়। গোকুলের গোপরাজ নন্দের ঘরে গোপনে কৃষ্ণকে রেখে তাঁর কন্যা যোগমায়াকে মথুরায় নিয়ে আসেন বসুদেব। নন্দের স্ত্রী যশোদা কৃষ্ণকে মাতৃস্নেহে লালনপালন করতে থাকেন। যথারীতি যোগমায়াকে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করতে চায় কংস। যোগমায়া আকাশে উঠে গিয়ে প্রোফেসি দেন, তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে। অতঃপর ঘটেও তাই। অশুভ শক্তির প্রতিভূ কংসের বিনাশ ঘটে শুভশক্তির প্রতীক শ্রীকৃষ্ণের হাতে। মোটের ওপর এই হলো কৃষ্ণপুরাণ।

ইমরান ও ইউকাবাদের পুত্র মুসা(আ.) এমন এক সময় আরবভূমিতে জন্মগ্রহণ করলেন, যখন ফেরাউনের ১৮তম রাজবংশ কাবুস বনি ইসরাইলের সদ্যপসূত সব ছেলে শিশুকে খুন করে যাচ্ছিল। ফেরাউন কাবুস এক রাতে ঘুমে স্বপ্নে দেখলেন যে, বায়তুল মুকাদ্দাস তথা জেরুজালেম থেকে বনী ইসরাঈল বংশে জন্মগ্রহণকারী এক পুত্র সন্তান কর্তৃক তিনি বিতাড়িত হবেন। তার রাজত্বের অবসান ঘটবে এবং তার প্রবর্তিত দ্বীনের পরিবর্তন হবে।

এমন বিপজ্জনক সময়ে নিজের প্রিয় সন্তান জন্মের তথ্য গোপন করে মুসার মা স্রষ্টার নির্দেশে তাঁকে লোহার সিন্ধুক মতান্তরে ঝুড়িতে ভরে নীলনদের স্রোতে ভাসিয়ে দিলেন। মুসার বোন মরিয়মকে নদের তীর ধরে হেঁটে গিয়ে খেয়াল রাখার নির্দেশ দিলেন মুসার সিন্ধুক কোথায় যায়। অতঃপর ফেরাউন কাবুসের বাগানের পাশে গিয়ে ভিড়ল মুসার সিন্ধুক। ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়ার তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠা সেই মুসাই‌ নেতিবাচকতার প্রতীক দুষ্টু ফেরাউন সম্রাটকে শায়েস্তা করে সবাইকে শুভবোধের পথে ফিরিয়ে আনেন।

মুসলিম পুরাণের এই ঘটনাটির অন্তর্গত তাৎপর্য কেমন মিলে যায় প্রাচ্যপুরাণের আখ্যানের সাথেও।

প্রাচ্যপুরাণ বেদ ও উপনিষদের সার হল গীতা। কয়েক হাজার বছর আগে মহাভারতের যুদ্ধে অর্জুন নিজের ভাইদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। তখন অর্জুনকে গীতার উপদেশ শিক্ষা দিয়েছিলেন কৃষ্ণ। কৃষ্ণ বলেন, এই জগৎ সংসার একটি যুদ্ধভূমি। আসল কুরুক্ষেত্র তো তোমার অন্তরে রয়েছে। অজ্ঞানতা ও অবিদ্যা হলেন ধৃতরাষ্ট্র এবং প্রতিটি আত্মা অর্জুন। আর তোমার অন্তরাত্মায় শ্রীকৃষ্ণের নিবাস, যে রথ স্বরূপ শরীরের সারথি। ইন্দ্রিয় এই রথের ঘোড়া। অহংকার, লোভ ও দ্বেষই হলো মানুষের পরম শত্রু।

অপরদিকে মুসাও দৈবের নিয়মে তাঁর শিষ্যদেরকে শিক্ষা দেন, কোনো মানুষকে হত্যা করো না। কোনো নারী বা পুরুষ কখনোই ব্যভিচার করবে না। অপরের দ্রব্য অপহরণ করবে না। মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে না। অন্য জিনিসের প্রতি কোনো লোভ করবে না বা যাতে অন্যের অধিকার আছে তা গ্রহণ করবে না।

কী দারুণভাবে আরবি পুরাণের সাথে হিন্দুইজমেরও সমন্বয় সাধিত হয়ে যায়। ভালো কথায় সব ধর্মের মর্মবাণীই প্রায় সমবর্তী। বিভাজন কেবল অবুঝ ও অগভীর চিন্তার মানুষে।

২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর India Times একজন মুসলিম মায়ের ছবি ছাপে। যে মায়ের হাতটি ধরে আছে তাঁর অনিন্দ্য সুন্দর শিশু। যে কিনা কৃষ্ণ সাজে সজ্জিত। মুসলিম ওই মা জানান, We believe that there is no religion or caste in celebrating the festivals. We have been doing this for around 15 years and we want our children to continue the same. We want that Hindu-Muslim lives affectionately all across the country in this same way. Our basic thought is that everyone in society must live with love and brotherhood. Throughout the year we organize different festivals which are celebrated together. If everyone in society lives cordially with love and affection than only nation will progress.'

জানি এমনটা আমাদের এইসময়ের বাংলাদেশে সম্ভব না। এখানে আন্তধর্মীয় সম্পর্ক প্রায় উধাও। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও ঐকতান হারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজতে হয়। ভয়াল কট্টরপন্থা গ্রাস করেছে সহনশীলতা ও ঔদার্যের সহজিয়া সৌন্দর্য।

ইন্ডিয়াতে যদিও ক্ষমতাসীনদের পছন্দ রামায়ণ। জয় শ্রীরাম বলতে বজরং পার্টিজানরা সবাই অজ্ঞান। তবে কৃষ্ণচর্চাটা বাদ দিয়ে নয়। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে প্রীতির রাজপথে এখনও মুসলিম মায়ের হাত ধরে শিশু কৃষ্ণকে হেঁটে যেতে দেখা যায়।

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য সাধনার অন্যতম অন্বিষ্ট ছিল শ্যামাসংগীত ও কীর্তন। আমরাই সবাই জানি কবি নজরুলের প্রথম পুত্রের নাম রেখেছিলেন কাজী কৃষ্ণ মুহাম্মদ। এ জন্য তাঁকে কম ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। বিশের দশকে নজরুলকে কাফের, নমরুদ, ইবলিস, খোদাদ্রোহী ইত্যাদি অপবাদ গঞ্জনায় চরম ধিকৃত করা হয়েছিল। গোঁড়াবাদিদের জুলুম সয়েও ইসলামি সংগীতের অমর স্রষ্টা নজরুলকে শ্যামাসংগীত রচনা থেকে নিবৃত করা যায়নি। কারণ ধর্ম বর্ণ গোত্রের উর্ধ্বে ওঠে নজরুল জীবনভর মানবীয় সম্পর্কের ভিত রচনা করবার প্রয়াস পেয়েছিলেন।

যমুনাপাড়ের গোকুলে বালক কৃষ্ণ গোপাল গরু নিয়ে মাঠে যেত। দিনভর নেচে গেয়ে খেলে বেড়াত। পৃথিবী সমান সর্বসহা ও সর্বজয়া পালক মাতা যশোদার স্নেহ ও প্রেমে বেড়ে ওঠে গোপাল। সেই অভূতপূর্ব দৃশ্যকল্প বর্ননায় নজরুল লিখেন অমর চরণ:

বহিছে উজান অশ্রু-যমুনায় 
হৃদি-বৃন্দাবনে আনন্দ ডাকে, ‘আয়,’
বসুধা যশোদার স্নেহধার উথলায়
কাল্-রাখাল নাচে থৈ-তা-থৈ।।

অপর একটি গানে নজরুল‌ কৃষ্ণ বন্দনায় মাতেন
অনন্য দ্যোতনায়।
ওরে নীল যমুনার জল
বল রে মোরে বল, কোথায় ঘনশ্যাম,
আমার কৃষ্ণ ঘনশ্যাম।
আমি বহু আশায় বুক বেঁধে যে এলাম,
এলাম ব্রজ ধাম।

তোর কোন কূলে, কোন বনের মাঝে
আমার কানুর বেণু বাজে,
আমি কোথায় গেলে শুনতে পাব
রাধা রাধা নাম।

আজ এই শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন। যাকে ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের অনেক মুসলিম প্রিস্টও নিজেদের প্রফেট মানেন। সে যার যা বিশ্বাস করুক। মানুষের বিশ্বাস ছাড়া ধর্ম বাঁচে না। আমরা সবাই মহান ধর্মাবতারদের হিতোপদেশ আত্মস্থ করতে পারি। এতে মঙ্গল বই অকল্যাণ নেই।

শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, জন্মের সাথেই মানুষের মৃত্যু নির্ধারিত, তাই নিজের কর্ম করো যা অনিবার্য তার জন্য দুঃখ করো না। কেবলমাত্র স্বার্থ ত্যাগই হল আনন্দ ও সন্তুষ্টির একমাত্র সহজ পথ। মনের স্থিরতার জন্য শান্তি, ভদ্রতা, নীরবতা, আত্মসংযম এবং পবিত্রতা শিক্ষাগ্রহণ করা আবশ্যক। নিজের সাথে সর্বদা অপরের তুলনাই হল মানুষের দুঃখের প্রধান কারণ। সততার সাথে কর্ম করতে জীবনে বহু বাধার সম্মুখীন হতে হবে, ধৈর্য থাকলে অবশেষে গর্বের সাথে জয় তোমারই হবে।
জয় জয় জগদগুরু শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য।

তথ্যসূত্র: 
IndiaTimes
ভারতীয় দর্শন -দেবব্রত সেন
নজরুল সঙ্গীত ও সাহিত্যকোষ -শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
ইসলাম সংক্ষিপ্ত ইতিহাস -ক্যারেন আর্মস্ট্রং
শিখা সমগ্র -সংকলন ও সম্পাদনা:
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম

লেখক: সাংবাদিক
২৬ আগস্ট ২০২৪