পৃথিবীতে সভ্যতা, প্রগতির চাকা ঘুরেছে যে সমস্ত বিষয়ের ওপর ভর করে বোধ করি ব্যবসা জ্ঞান-অর্থনীতি সে সমস্ত বিষয়ের মধ্যে অগ্রগণ্য। এই জ্ঞান অথবা ব্যবসা কিংবা সাহিত্য-সঙ্গীত যাই বলি না কেন, সেসব যখন ছড়ায় সেটাই সভ্যতা, প্রগতি এগিয়ে নেবার মূল অনুঘটক। যারা অন্যের সৃষ্ট সৃষ্টি অথবা কাজ বেচে ব্যবসা করেন তাদের প্রতি আমার প্রশ্ন এবং কৌতুহল হচ্ছে, তাদের ঠিক কোন অথবা কোন কোন কারণে মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত শিল্পকর্ম নিয়ে ব্যবসা করার তালুকটা তারা নিয়ে রেখেছেন?
দেখেন সমগ্র দুনিয়াতে শিল্পকর্ম নিয়ে ব্যবসার সময়-সিদ্ধ এবং অবশ্যই নিয়ম মাফিক কিছু প্ল্যাটফর্ম, ভেন্ডরশিপ সিস্টেম, এজেন্টশিপ এই জাতীয় বিষয় আশয় আছে। আপনি সেই সমস্ত নিয়মের নিরিখে আমাদের দেশের শিল্পকর্ম বেচাবিক্রি নিয়ে কথা বলতে গেলে গল্পের আগা এবং গোড়ার হিসেব মিলবে না। কারণ আমাদের দেশে পদ্ধতিগত কিংবা কাঠামোগত ভাবে শিল্পকর্ম বেচাবিক্রির কোন মডিউলেশন নেই।
এই যে শিল্পকর্ম, এটার তো শিল্পজ্ঞান বিচারের বাইরেও মূল্যমান থাকতে পারে। যেমন ধরুন চে গ্যেভারার পোর্ট্রেট কিংবা ছবি থেকে শিল্পকর্ম তৈরি করলে সেটার শিল্পমূল্যের বাইরে বিপ্লব কেন্দ্রিক একটা মূল্যমান বিবেচনার বিষয় থাকে। সেই বিবেচনা আপনি করুন অথবা না করুন, সেটার অস্তিত্ব রয়েছে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে রনবীর কার্টুন, পরবর্তী সময়ে শিশির ভট্টাচার্যের কার্টুন, ঐ সময়গুলাতে ঐ সময়ের আন্দোলনগুলোর জরুরী প্রতীক ছিল, ভাষা ছিল। আপনি, আমি চাইলে সেই সমস্ত কার্টুনগুলোকে ব্যবহার করে অনলাইন অথবা অফলাইনে ব্যবসা করতেই পারি। প্রথম কারণ হল, আমাদের দেশে এই জাতীয় কাজগুলোর ক্ষেত্রে কোন যথাযথ মডিউলেশন কিংবা বিধি-নিষেধ নেই। দ্বিতীয় কারণ হল, আমরা রিফর্মেশন অথবা নিয়মাচারের গল্প মুখেই করি, কাজে করি না। অথচ যে কোন পরিশীলিত সমাজে অন্য একজনের সৃষ্টি ব্যবসা ছাড়া ভিন্ন কাজে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সাধারণত অনুমতি নেয়ার সংষ্কৃতি বিদ্যমান। আমরা এই ২০২৪ এ এসেও পৃথিবীর পরিশীলিত সংষ্কৃতির অংশ হতে পারিনি। আমরা শিল্পকর্ম তো বটেই, শিল্পী, এমনকি আন্দোলন পর্যন্ত বেচাবিক্রি করে থাকি।
কয়েক সপ্তাহ আগে শেষ হয়ে যাওয়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নিয়েও তাই হয়েছে এবং হচ্ছে। মানে কারোর কারোর ব্যবসায় এমন একটা আন্দোলনও প্রোডাক্ট হয়ে উঠতে পারে। কোন আন্দোলন অথবা আন্দোলনের বিভিন্ন ছোট-বড় ঘটনা, মানস পটে জমিয়ে রাখার জন্য সেগুলো নিয়ে কাজ হতে পারে, হয়ত পণ্যও হতে পারে, তবে সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন মোটিভে। ঠিক যেমন করে কার্টুন তৈরি করা হয়। কিন্তু একটা আন্দোলন মানে শত শত মানুষের ত্যাগ, জীবনের দাম, অন্যায়-অনাচার সহ্য করা, এই সমস্ত কিছুর বিনিময়ে কখনও আন্দোলনকারীদের কখনও আন্দোলন নিজে বিক্রয় করার পণ্য হয়ে গেলে সেটা কি ভীষণ ক্রঢ় বিষয় হয়ে যায় না? ধরেন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে স্বাভাবিক ভাবেই রুশদের কাছে হিরো তাদের সেনারা, ইউক্রেনবাসীর কাছে হিরো তাদের সেনারা। এই যুদ্ধের মরাল সমুন্নত রাখতে চেয়ে যে কোন পক্ষ তাদের সেনাদের নিয়ে কোন পণ্য তৈরি করে বেচতে অথবা বিনামূল্যে বিতরণ করতে পারে মরাল বুস্ট করার জন্য। কিন্তু বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা শহীদ হলেন তাদের কারোর কারোর নামে টিশার্ট তৈরি করে বেচা হচ্ছে দেখলাম। হয়ত আরও অন্যান্য প্রোডাক্টও তৈরি হচ্ছে বেচাবিক্রির জন্য, আমার জানার বাইরে। সেটা কোন ফান্ড তৈরি বা আন্দোলন বিষয়ক অন্য কোন কারণে যদি হয়ে থাকে সেটা ভিন্ন আলাপ। কিন্তু একটা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে যদি কেউ বা কারা এরকম পণ্য বানিয়ে ফেলে শুধুমাত্র ব্যবসার উদ্দেশ্যে, সেটা অবশ্যই কাম্য না। আন্দোলন যেহেতু কোন ব্যক্তি বিশেষের নিজস্ব সম্পত্তি না, তাই একটা মহল সেটা নিয়ে ব্যবসা করতে পারে না। আবার দেখলাম কিছু কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের তৈরি টিশার্ট ট্রাফিক সহায়তায় থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে বিতরণ করছেন। যদিও এইক্ষেত্র দৃশ্যত, আন্দোলনের কাছে দেয়া হচ্ছে। তবে এতটুকু বুঝতে খুব বেশি পড়াশোনার দরকার হয় না, যে ঐ সমস্ত প্রতিষ্ঠান প্রকারান্তরে আন্দোলনটাকে পুঁজি করে নিজেদের প্রোডাক্টের প্রচারণা চালাচ্ছেন। সেই একই, বেচাবিক্রির তোড়জোর।
আমাদের মূলত পরবর্তী গঠন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ এবং স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ একরকম বাধ্যতামূলক, যদি আমরা দেশ এবং দশের ব্যাপারে যত্নশীল এবং সংবেদনশীল হয়ে থাকি। আমি প্রাণপণ আশা করছি, স্বপ্ন দেখছি, আমরা আরও বেশি যত্নশীল এবং সংবেদনশীল। আমি প্রাণপণ কামনা করছি, আমাদের সামনের দিনগুলো আমাদের স্বপ্নের মত, আমাদের প্রত্যয়ের মত দৃঢ় আর পোক্ত। একটা নতুন দিনের আশায় আজ চলি।