পোস্টস

নন ফিকশন

শাফিন আহমেদ : এক আজন্ম রকস্টারের বিদায়

২৭ আগস্ট ২০২৪

জয় শাহরিয়ার

শাফিন ভাইয়ের সাথে এনটিভির একটি রেকর্ডিং-এ।

গত কদিনে কারফিউ চলাকালীন সময়ে ফিরে গিয়েছিলাম নব্বই দশকে। যে সময়ে আমার বেড়ে ওঠা এই ইট কাঠের শহরে। বাইরে যাওয়া বন্ধ, ঘরেও নেই ইন্টারনেট। এ যেন নিজের সাথে নিজে সময় কাটানোর বিরল উপলক্ষ্য। ওয়াকম্যানে গান শুনলাম বহুদিন পর। আর শুরু করলাম না পড়া অনেক বই থেকে বেছে প্রিয় বই পড়া। কোন বইটা বেছে নিলাম? "পথিকার"! শাফিন আহমেদের বায়োগ্রাফি, যেটা লিখেছেন প্রিয় সুহৃদ সাজ্জাদ হুসাইন। এটা কী কাকতাল? ছোটোবেলা থেকে যাদের গান শুনে বড়ো হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি, রক মিউজিকের প্রেমে পড়েছি; শাফিন ভাই তাদের মাঝে অন্যতম। তাঁর জীবনের অলিগলি ঘুরছিলাম তাঁর নিজের বয়ানে প্রকাশিত জীবনীগ্রন্থে। বইটি শেষ করার আগেই শাফিন ভাইয়ের জীবনের গান শেষ হয়ে গেল। ভাবা যায়? কত অনিশ্চিত আর কত ক্ষুদ্র আমাদের জীবন?


 

শাফিন আহমেদের জন্ম ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১। মৃত্যু ২৪ জুলাই ২০২৪। ক্ষণজন্মা এই বাংলাদেশি রকস্টার ছিলেন বাংলা গানের কিংবদন্তি সুরকার, সংগীত পরিচালক কমল দাশগুপ্ত ও প্রবাদপ্রতীম নজরুল সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগমের কনিষ্ঠ সন্তান। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো শাফিন আহমেদের জন্ম ভারতের কোলকাতায়, ছোটোবেলা ঢাকায় কাটিয়ে পডাশোনা করছেন যুক্তরাজ্যে। তারপর দেশে ফিরে যোগ দেন ব্যান্ড মাইলসে। তারপরের গল্পটা ইতিহাস। আমাদের বাংলা রক মিউজিকে এক কিংবদন্তির গড়ে ওঠার গল্প সেটা।


 

শাফিন ভাইয়ের সাথে প্রথম পরিচয় বছর বিশেক আগে। আমার ব্যান্ড নির্ঝরের বেড়ে ওঠার সময় সরাসরি সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা আর গাইডেন্স পেয়েছিলাম দুজনের কাছে। একজন বাপ্পা ভাই আর অপরজন শাফিন ভাই। অনেকে শুনে একটু অবাক হবেন হয়তো। কারণ আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে শাফিন ভাই একটু ধরা ছোঁয়ার বাইরে বলেই সবাই জানেন। কিন্তু আমরা ব্যান্ড হিসেবে ভাগ্যবান ছিলাম। শাফিন ভাইয়ের সাথে আমার যোগাযোগের শুরু সেসময় আমার ব্যান্ডমেট সাবাব ভাইয়ের মাধ্যমে। সাবাব ভাই বেইস বাজাতেন, শাফিন ভাই ছিলেন তার মেন্টর। আমার মনে আছে, আমরা গান রেকর্ড করে শাফিন ভাইকে শোনাতাম, তিনি তাঁর ভাবনা আমাদের জানাতেন। আমরা টিভি শো রেকর্ড করে সিডিতে নিয়ে ওনাকে দেখাতাম, উনি সেগুলো দেখেও কমেন্ট করতেন, শুধু গান গাওয়া বা বাজানো নয়, আমাদের অ্যাপিয়ারেন্স নিয়েও পরামর্শ দিতেন। স্টেইজে সেট লিস্ট সবার পায়ের নিচে রাখা, শোয়ের ঠিক আগে বেশি প্র‍্যাকটিস করে প্রেশার না নেওয়া সহ পারফরম্যান্স কেন্দ্রিক নানা কিছু ওনার কাছ থেকেই শেখা৷ আমরা নিয়মিত প্র‍্যাকটিস করার উৎসাহ পেতাম মাইলসের কাছে, কারণ সেসময়ে ওনারা সপ্তাহে তিন দিন পুরো ব্যান্ড প্র‍্যাকটিস করতেন। সেটা জেনে আমরা ভাবতাম, ওনারা যদি এত বড়ো হবার পরেও এত অনুশীলন করেন তাহলে আমাদের তো কোনো বিকল্পই নেই।


 

শাফিন ভাইয়ের সাথে আমার একটা দারুণ স্মৃতি আছে। সারাজীবন মনে থাকবে। সময়টা ২০০৫ বা ২০০৬। শাফিন ভাই নিজ উদ্যোগে আমাদের একটা শো দিয়েছিলেন। গুলশানে তখন ইয়ামাহা মিউজিকের শো রুম ছিল বিশাল। সেখানে একটা আনপ্লাগড শোয়ের আয়োজন করে আমাদের সুযোগ দিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে অপর শিল্পী ছিলেন মেহরীন আপা। আমরা তখন নতুন ব্যান্ড। সাউন্ড সেভাবে বুঝি না। তার ওপর আনপ্লাগড শো। সেই শোতে আমাদের সাউন্ড কে করেছিলেন প্যানেলে দাঁড়িয়ে জানেন? শাফিন আহমেদ। কোনো দরকার ছিল না। আমাদের শো দিয়েছেন সেটাই তো অনেক। কিন্তু শো-টা যাতে ভালো হয় সেই খেয়ালও তিনি ঠিকই রেখেছিলেন। শো শেষের স্মৃতিটাও আমার মনে থাকবে। আমাদের পুরো ব্যান্ডকে নিয়ে আলাদা রুমে বসলেন। দরজা বন্ধ করে দিয়ে সবাইকে আলাদা আলাদা করে বললেন কার কী ঠিক আছে, কী ঠিক নেই। কী করা উচিত, উন্নতির জায়গা কোথায়। আমাকে কিছু বললেন না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভাইয়া আমাকে কিছু বললেন না? শাফিন ভাই বললেন, ইউ ওয়্যার সুপার্ব জয়! আমার যে কী আনন্দ হয়েছিল, আমি বোঝাতে পারবো না। দেশের অন্যতম পারফেকশনিস্ট আর্টিস্টের সেই প্রশংসা আর আশীর্বাদ আমার সারাজীবনের আত্মবিশ্বাস। ওই শোয়ের পর আমাদের ব্যান্ড নির্ঝরের অ্যালবামও উনি রিলিজ করবেন বলেছিলেন। একটা রেকর্ড লেবেল করবেন সেসময় ভেবেছিলেন। সেই লেবেলের প্রথম অ্যালবাম হবার কথা আমাদেরটা। পরে সেই লেবেল করার প্রকল্প বাতিল হয়ে গেলে আমাদের অ্যালবাম অন্য লেবেল থেকে প্রকাশ পায়।


 

মিউজিশিয়ান শাফিন আহমেদকে নিয়ে বলার যোগ্যতা আমার নেই। ওনার কিছু দিক নিয়ে বলার চেষ্টা করি। শাফিন ভাই গায়ক হিসেবে অসাধারণ। বিশ্বমানের। উনি ওনার জীবনে এটা সবসময় মানতেন৷ বিশ্বমান ছিল তার কাছে তুল্য, অন্য কিছু নয়। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত দারুণ গান করে গেছেন, বয়সের কোনো ছাপ তার গানের গলায় ছিল না। একইরকম সুরে আর এনার্জি নিয়ে তিনি তার জীবনের শেষ শো করেছেন। এটা দারুণ শিক্ষণীয় আমাদের সবার জন্য। গায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তার কারণে উনি বেইসিস্ট হিসেবে কতটা অসাধারণ সেটা অনেক সময় আলোচনায় আসে না। বাংলাদেশের ইতিহাসে উনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ বেইস গিটারিস্ট। আর গায়ক ও বেসিস্ট ধরলে অবশ্যই শ্রেষ্ঠতম। শাফিন ভাইয়ের বাজানো অসংখ্য কালজয়ী বেইস লাইন আছে যা বছরের পর বছর ধরে নতুন বেইসিস্টরা বাজাবে আর শিখবে। শাফিন ভা সুর করতেন। লিখতেন। তাঁর নিজের ও মাইলসের অনেক গান আছে তিনি লিখেছেন, সুর করেছেন। সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন একজন কম্পলিট মিউজিশিয়ান।


 

শাফিন ভাই ছিলেন দেশের অন্যতম স্টাইল আইকন। এত স্টাইলিশ আর্টিস্ট বাংলাদেশ খুব কম দেখেছে। অনেক এক্সপেরিমেন্টাল কাপড় পরেছেন। আমাদের দেশে ফেড আর ছেঁড়া জিন্সের প্রচলন তো ওনার মাধ্যমেই। যখন যা পরেছেন, ক্যাজুয়াল থেকে ফরমাল, সবসময় দারুণভাবে ক্যারি করেছেন। এজন্যেও তাঁকে মনে থাকবে সবার।


 

আমার মনে আছে শাফিন ভাইয়ের গান শুনতে একবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। মুক্তমঞ্চে একটা র‍্যাগ ডে ছিল। মাইলস প্রায় ৩০টা গান করেছিল। অসম্ভব আর অসাধারণ পারফরম্যান্স ছিল। দুই দশক পরেও আমার চোখে আর কানে সেটা লেগে আছে এখনো।


 

শাফিন ভাইয়ের উপস্থাপনায় একাধিকবার অনুষ্ঠান করেছি একাধিক চ্যানেলে। এখানেও তিনি ছিলেন দারুণ পেশাদার। এত বড়ো স্টার, অথচ হোমওয়ার্ক করে নিতেন অনুষ্ঠানের আগে। অতিথি যেই হোক, তার তথ্য নিতেন, খবর জেনে তারপর উপস্থাপনা করতেন। এটাও শেখার মতো। এখন যেখানে নতুন উপস্থাপকদেরকেও পড়াশোনা করতে দেখা যায় না, সেখানে তিনি পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতেন।


 

শাফিন ভাইয়ের সাথে সর্বশেষ কথা হয় গত ফেব্রুয়ারি মাসে। যখন ওনার বায়োগ্রাফিটা প্রকাশ পায়। বই প্রকাশনা নিয়ে অনেক কথা হয় সেদিন। প্রকাশনা উৎসবে আমাকে যেতে বলেছিলেন। যাওয়া হয়নি মেলা চলার কারণে। আমি বিশ্বদার বায়োগ্রাফি লেখার পর খুব প্রশংসা করেছিলেন। মিউজিক কম্পোজার্স সোসাইটি অফ বাংলাদেশের এক অনুষ্ঠানে আমাকে আলাদা ডেকে খুব উৎসাহ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন খুব ভালো কাজ করেছিস, এগুলো হওয়া দরকার। কাজ চালিয়ে যা। শেষ যখন কথা হয়, শাফিন ভাইকে বলেছিলাম যে ওনার গান করতে চাই, বললেন গান বানিয়ে চলে আয় স্টুডিয়ো। সেই গান নিয়ে আর বসা হলো না শাফিন ভাইয়ের সাথে। শাফিন ভাইয়ের একটা গান করা হলো এই জীবনে আমার। এই আক্ষেপ সারাজীবন থেকে যাবে।


 

শাফিন ভাই ছিলেন একজন আপাদমস্তক রকস্টার। তাঁর বিদায়ে আমাদের গানের যে ক্ষতি হলো তা পূরণ হবার নয়। আমাদের প্রজন্ম একের পর এক হারাচ্ছি আমাদের সব হিরোদের। সব কেমন যেন শূন্য হয়ে যাচ্ছে। শাফিন ভাই, আমার সুরেলা কৈশোর আপনার কাছে আজন্ম ঋণী। বাংলা গান যতদিন থাকবে, একজন শাফিন আহমেদ তাঁর গানে আর সুরে ততদিন বেঁচে থাকবেন। শাফিন আহমেদের এই অকাল প্রয়াণ বাংলা গানের এক আজন্ম রকস্টারের বিদায়...

 

২৫ জুলাই ২০২৪