১৫ জুলাই ২০২৪
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তাল। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রেশ ছড়িয়ে গেছে সাধারণ জনগণ পর্যন্ত। একটা স্লোগান নিয়ে শোরগোল পড়ে গেছে। 'তুমি কে, আমি কে? রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার'।
সাধারণ ছাত্রদের দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আর সরকারি চাকরিতে যে বিশাল পারসেন্টিজে কোটার ব্যবহার সেটা সংস্কার করতে হবে। এ নিয়ে কর্তা ব্যক্তিদের হাসি-তামাশা ও ব্যাঙাত্মক মন্তব্যে ফুসে উঠেছে ছাত্র সমাজ। ৩০ পারসেন্ট মুক্তিযোদ্ধা কোটা, এবং এ সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে কথার পর কথা চলছে চারপাশে। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ঘোষণা দিয়েছে, এই আন্দোলন তারা 'রাজনৈতিকভাবে' মোকাবেলা করবে। ক্যাম্পাস হয়ে গেছে শুকনো বারুদ। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় আগুন ধরে যাবে।
অফিস শেষে বাসায় ফিরছিলাম সময় দেখলাম, অদ্ভুত বেগুনি রঙের খেলা আকাশে। আমি রিকশা থেকে নেমে দ্রুত পা চালালাম যেন খোলা স্থানে যেতে পারি। আর একদিন পরই আশুরা। সন্ধ্যার আকাশ লাল হলে আম্মা বলতো, এটা কারবালার শহীদদের রক্তের লাল। কারবালা কী জানতাম না, তবে এটা বুঝতাম যে পবিত্র কিছু, মহৎ কিছু। কিন্তু আজ আকাশ বেগুনি কেন? এর কী অর্থ? আম্মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। অনেক জোরে পা চালিয়েও লাভ হলো না, আমি খোলা আকাশের নিচে যেতে যেতে আকাশ নীলচে কালো রঙ ধারণ করলো।
রাতে খবর পাচ্ছিলাম, ক্যাম্পাসে প্রচুর মারধোর চলছে। হেলমেট বাহিনি একটিভ হয়ে গেছে। ছাত্রলীগ সাধারণ ছাত্রদেরকে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। যেকোনো মুহূর্তে কিছু একটা হয়ে যাবে।
১৬ জুলাই ২০২৪
যথারীতি অফিস যাবো বলে সকাল সকাল উঠে গেলাম ঘুম থেকে। আমার ২ বছরের শিশু উঠেই নাচানাচি শুরু করলো। আমি স্বাভাবিক দিনের মতোই লাঞ্চবক্স রেডি করলাম আমাদের দু'জনের। আর বাবুর খাবার রান্না করলাম, ওকে খাইয়ে বের হবো। কিচেন থেকে ঘরে এসে দেখি এই আধা ঘণ্টায় বাবুর জ্বর এসেছে, আর জ্বরটা তীব্র। অফিসে যেতে পারলাম না। আমার হাজবেন্ডের অফিস না গেলেই না, সে বের হলো। এরপরই আসতে লাগলো নানান খবর।
বিভিন্ন রাজপথ সাধারণ ছাত্রদের দখলে। রাস্তা আটকে আন্দোলন করছে তারা। দাবি একটাই কোটা সংস্কার করতে হবে। অবস্থা কোনদিকে যায় বলা যায় না। ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগ সাধারণ ছাত্রদের মারধোর শুরু করেছে। এখন স্কুল কলেজের ছাত্ররাও রাস্তায় নেমে গেছে। আমার হাজবেন্ড অফিস থেকে বাসায় আসতে তিন ঘণ্টা সময় লাগলো। রাস্তা ব্লকড ছিল। টেনশন হচ্ছিলো, কখন কী হয়। কিন্তু বাবুকেও ডাক্তার দেখানো দরকার। বাসার গ্যাসের চুলায় কিছু একটা যান্ত্রিক গোলযোগ হচ্ছিলো, চুলাও কিনতে হবে। বাবুকে ডাক্তার দেখিয়ে চুলা কিনে বাসায় ফিরলাম।
নানারকম উত্তেজনার খবর আসছিলো সারাদিন ধরেই। কিন্তু বিকাল থেকে আসা শুরু হলো মর্মান্তিক খবরগুলো।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্র ও ছাত্রলীগ মারামারি হয়েছে। এর সাথে যোগ দিয়েছে পুলিশ। পুলিশের সামনে দু'হাত মেলে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল রংপুরের এক ছাত্র সাঈদ। পুলিশ তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে মেরে ফেললো। আরো নানা জায়গায় পুলিশের গুলিতে মোট ৬ জন মারা গেছে এমন খবর পাওয়া গেল। যার মধ্যে একজন পথচারীও আছে। ঢাকা কলেজের সামনে ব্যাপক সংঘাত হলো। সারাদেশে চলেছে এই সংঘাত। এক জায়গায় সাধারণ ছাত্রদের কাছে পিটুনি খেয়ে ছাদে উঠেছিল কিছু ছাত্রলীগের ছেলে। অনেকে প্রাণ বাচাতে ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামতে গিয়ে পড়ে হাত পা ভাঙলো।
আমি ভাবছিলাম, ছাত্রলীগও ছাত্র, সাধারণ ছাত্রও ছাত্র। এদের মারামারিতে কেউ কীভাবে তার শত্রুকে চিনে নেয়? সবাই তো দেখতে এক রকম। তাহলে কে কাকে মারছে কে কাকে ধাওয়া দিচ্ছে কীভাবে বোঝা যায় তা? চোখে ভাসছিলো সাঈদের বুক চিতিয়ে রাইফেলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়াটা। এত সাহস তো তারুণ্যেরই তাই না? আর তার ভিতরে লালন করা প্রতিবাদী বিশ্বাস থেকেই উৎসারিত এ সাহস। কারবালার হোসেন আজ নেমে এসেছিল সাঈদের বুকে, আর পুলিশ গুলি করে নতুন করে মারলো যেন হোসেনকেই।
ছাত্রলীগ এতটাই তান্ডব চালিয়েছে যে সাধারণ ছাত্ররা ফাইট ব্যাক করলো। প্রতিটা হল থেকে ছাত্রলীগের সভাপতিদের টেনে হিচড়ে বের করা হলো। ফেসবুকে ভাইরাল হলো সেই ভিডিওগুলো। বিশেষ করে মেয়েদের হলগুলো থেকে ছাত্রলীগ নেত্রীদের চুল টেনে বিতাড়িত করা হলো। কানে ধরে উঠবস করানো হলো ইডেন কলেজের এক নেত্রীকে। ওদের ল্যাভিশ হল রুমগুলো থেকে সব জিনিসপত্র ফেলে দেয়া হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল ছাত্রলীগ মুক্ত হয়ে গেছে এমন কিছু স্ট্যাটাস দেখলাম। একরকম বিজয় হলো সাধারণ ছাত্রদের।
১৭ জুলাই ২০২৪
আজ মহররম। আশুরার ১০ তারিখ। সারারাত বাচ্চাকে নিয়ে এক রকম জেগে কেটেছে আমাদের। বেশ দেরি করে ঘুম ভাঙলো। আবার বাচ্চাকে ওষুধ খাওয়ানো, গোসল করানো এসবে বেলা চলে গেল। আমার ননাশ এলো খিচুরি নিয়ে, মহরমের সংস্কৃতি। যদিও এমনকি আমার বাবার বাসায়ও এখন সৌদি অনুকরণ চলে, মহররমে খিচুরি, শবে বরাতে রুটি এসবকে বিদাত বলে আর পালন করা হয় না। এ পরিবর্তন ঘটেছে গত ১০ বছরে। ননাশের দেয়া খিচুরি খেলাম, একটু ঘুমালামও।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় জাতির উদ্দেশ্য ভাষণ দিবেন প্রধানমন্ত্রী। সারাদেশ এই ভাষণের অপেক্ষায়। ৬ জনের জীবনের বিনিময়ে যদি কোনো আশার কথা শোনা যায়, সেটাই শুনতে চায় সাধারণ মানুষ। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে হাইকোর্ট দেখিয়ে দিলেন। বিচারিক ব্যাপার, সময় লাগবে, সন্ত্রাসীরা ছাত্রদের সাথে মিশে গেছে, বিশেষ মহল ষড়যন্ত্র করছে এমন সব কথা বললেন। বললেন ছাত্রদের ছাদ থেকে ফেলে মারা হচ্ছে, আর রগ কেটে দেয়া হচ্ছে। তিনি উল্লেখ না করেও ছাত্রলীগের পক্ষ নিয়ে নিলেন, পক্ষপাতদুষ্ট কথা বললেন, আর মিথ্যাও কি বললেন না? রগ কেটে দেয়াটা শিবিরের, অতীতে শিবির বহু মানুষের রগ কেটেছে। কিন্তু গতকাল বা আজ কোনো রগ কাটার ঘটনা খবরে আসেনি। প্রধানমন্ত্রী এটা কোথায় জেনেছেন কে জানে!
ভাষণ শুনে কেউ সন্তুষ্ট হতে পারলো না। তিনি বলতে পারতেন, আমি সাধারণ ছাত্রদের পক্ষে, ছাত্রদের আগামীকালকের শাট ডাউনকে সম্মান করি। যে ছাত্রদের জীবন গেছে তাদের সম্মানার্থে আগামীকাল জাতীয় শোক পালন করা হবে। আসুন এ সংঘাত বন্ধ করি, আগামী রবিবার ছাত্রদের উপস্থিতিতে কোর্টে কোটা সংস্কারের শুনানির ব্যবস্থা করছি। না, তিনি এসব বললেন না। তিনি উস্কানিমূলক কথাই বললেন আট মিনিট ধরে। এমন মহরমের সন্ধ্যা বাংলাদেশে আর না আসুক।
১৮ জুলাই ২০২৪
সকাল ছয়টায় দেখি অদ্ভুত একটা আলো চারপাশে। মনে হচ্ছিলো চারপাশে সোনারঙা আগুন জ্বলছে। চকচকে এই সকালে আমার মনে পড়লো, আজ কমপ্লিট শাটডাউন, আজ ছাত্রদের দেশ স্বাধীন করার দিন। আর স্বাধীনতার আলো বলতে আমরা যা বুঝি তা আসলে এই আলোটাই। সবাই এখন ছাত্র হত্যার বিচার চায়। এই ছাত্ররা তো আর এমনি এমনি জান দিয়ে দেয়নি। ওদের হত্যা করার বিচার এই বাংলার মাটিতে হতেই হবে। সব ছাত্র আজ রাস্তায় নামবে। দেখিয়ে দিবে ছাত্রদের ঐক্য কাকে বলে। ছাত্র জাগলে সব চেঞ্জ হয়ে যেতে পারে আজ এটাই প্রমাণ করার দিন। আজ স্বাধীনতার দিন।
গতরাত একটা কালরাত গিয়েছে ঢাবি জাবিসহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। পুলিশ কন্ট্রোলে নিয়ে নিয়েছে সব। ছাত্ররা কই? সকালেই খবর পেয়ে গেলাম, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিটা হল থেকে সাধারণ ছাত্রদের বের করে দেয়া হয়েছে। মধ্যরাতে বিদ্যুৎ বন্ধ করে ইন্টারনেট বন্ধ করে পিটিয়ে ওদের বের করে দিয়েছে পুলিশ আর ছাত্রলীগ। আগের রাতের প্রতিশোধ। ঢাবি, জাবিতে নিস্তব্ধতা।
আমার হোম অফিস ছিল, অফিসে মিটিং করছিলাম অনলাইনে, শুরু হলো নরকযজ্ঞ। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন রাস্তায় নেমেছে। পুলিশের সাথে ধাওয়া পালটা ধাওয়া, গোলাগুলি, টিয়ারশেল নিক্ষেপ চলছে। দুপুরের মধ্যে জানা গেল, অনেক ছাত্র মারা পড়েছে। এক একটা ছেলে, আহা আমার দেশের সোনার টুকরা ছেলে, মায়ের চোখের মনি, বাবার স্নেহের ছেলেরা পুলিশের গুলি খেয়ে জায়গায় জায়গায় মরে পড়ে আছে। ছাত্রের আইডি কার্ড, কলেজড্রেস ভরে আছে তাজা রক্তে। প্রতিটা এলাকায়, ব্র্যাক, নর্দান, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি সব জায়গায় বাচ্চাদের লাশ পড়ে আছে। একটা ছেলের এখনও আঠারো হয়নি। ওর মা ফেসবুকে ছেলের ছবি দিয়ে বলেছে আই ওয়ান্ট জাস্টিস। শুরু হলো জ্বালাও পোড়াও, বিভিন্ন এলাকায়, মিরপুর মেট্রো স্টেশনে, ওভারব্রিজে সবখানে আগুন জ্বলে উঠলো, আরো গুলি চললো। দেশের স্বর্ণের টুকরো ছেলেরা মরলো অকাতরে। আইনমন্ত্রী বললো, চাইলে এখনই বসবে আলোচনায়, আন্দোলনের সমন্বয়করা সময় চাইল সিদ্ধান্ত নিতে। কিছুক্ষণ পর সমন্বয়করা জানিয়ে দিলো, রক্তের ওপর কোনো আলোচনা নয়। আমারো একই কথা, আমার সন্তানের খুনীর সাথের কীসের আলোচনা? লাশগুলো দাফনও হয়নি এখনও, তাজা প্রাণের তাজা লাশের ওপর কীসের বসাবসি? আর এখন কেন? এই বসাটা তো আগেও বসা যেত। কেন এতগুলো জান নিতে হলো তোদের?
ফেসবুকে আসা নিউজগুলো সহ্য হচ্ছিলো না। মায়ের বুক ফাটা আর্তনাদ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। মেয়ের রুমে গিয়ে আহাজারি করলাম। এর মাঝেই আমার ভাইয়ের কাছে খবর পেলাম আমার বোনের কলেজ পড়ুয়া ছেলে আন্দোলনে আছে। আর বিকালে তাকে ফোনেও রিচ করা যাচ্ছে না। আমিও ট্রাই করলাম অনেকবার। ঘণ্টাখানেক পর সে কল দিয়ে জানালো বাসায় ফিরেছে। ওর এলাকায় গোলাগুলি হয়নি, সে সুস্থ আছে। আমার দুলাভাইয়ের সাথে কথা হলো। বললো, ছেলেকে বের হতে নিষেধ করেছিল ছেলে বলেছে, 'আব্বু আমি এখন তোমাদের কথা রাখার মতো অবস্থায় নাই'। এটা শুনে আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। কী সাংঘাতিক কথা। এ বয়সী প্রতিটা ছেলেই এমন করেই ভাবছে। আর এভাবেই আজ এতগুলো প্রাণ গেল। নিহতের সঠিক সংখ্যা আসছে না কোথাও। কী হবে তাহলে এখন? এটা তো আর কোটা সংস্কার আন্দোলনে সীমাবদ্ধ নেই। কেন পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়া হল? কে দিলো এই নির্দেশ? তার বিচার কি হবে না? আল্লাহ তো এর বিচার করবেই। আমার কলিজার একটা অংশ কেটে ফেলা হয়েছে যেন, এই অনুভূতির মধ্য দিয়েই রাত হয়ে গেল। আরেকটা কালো রাত। ইন্টারনেট অফ হয়ে গেল রাত ৯টায়। আমার বাসায় টিভিতে ক্যাবল কানেকশন নেই। খবর পাচ্ছি না কোনো। বারবার বোনের সাথে কথা বলছিলাম। ওরা টিভির সামনে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। ওদের ছেলে ঢাকায় ছাত্রাবাসে। ছেলের টেনশনে ঘুম কি আর আসে! একটা অভিশপ্ত দিন গেল।
১৯ জুলাই ২০২৪
প্রচন্ড রোদ আজ বাইরে, আর তেমনই গরম। ভয়াবহ দিন শুরু হয়েছে আজ বাংলাদেশে। শুক্রবার, সবাই জল্পনা কল্পনা করছে কিছু একটা হয়ে যাবে। ইন্টারনেট অফ, নিউজের জন্য আমার বোনকে কল করি একটু পরপর। সারাদিন তেমন কোনো খবর এলো না। ইন্টারনেট ঠিক করার ট্রাই চলছে।
সন্ধায় নানা জায়গায় জ্বালাও পোড়াও-এর খবর এলো, প্রচুর ভবনে, গাড়িতে আগুন দেয়া হলো। এগুলো বিএনপি জামাত শিবিরের কাজ বা সন্ত্রাসীদের কাজ এমনই বললো সরকারের লোকজন। প্রধানমন্ত্রী ১৪ দলের সাথে মিটিং করলো সন্ধ্যারাতে। সিদ্ধান্ত এলো, রাত বারোটা থেকে কারফিউ হবে, আর্মি নামবে মাঠে। রাত ১২টা থেকে দুপুর ১২টা। এরপর আবার দুপুর ২টা থেকে পরদিন অর্থাৎ রবিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত চলবে কারফিউ। আর আদালত বসবে সকাল ১০টাতেই। কোটা সংক্রান্ত শুনানি ও রায় দিবেন বিচারক।
রাত কাটছে গভীর উৎকণ্ঠায়। আর্মি নামবে, তাহলে কি এখন ছাত্র-আর্মি মুখোমুখি হয়ে যাবে? আর্মি যদি আর না ফেরে? আরো রক্ত ঝরবে কাল? সকাল হলেই শনিবার। আমার বাচ্চার জ্বর ভালো হচ্ছে না, আরো খারাপ অসুখ হলে এই কারফিউয়ের মধ্যে উপায় কী? কী হবে আগামীকাল? ইন্টারনেট এখনো বন্ধ। আমার দমবন্ধ লাগছে।
২০ জুলাই ২০২৪
অফিস থেকে জানালো ইন্টারনেট চালু হলে আগামীকাল হোম অফিস করতে হবে আর নাহয় অফিস ক্লোজড থাকবে। কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। সকালে বোন বললো গাজীপুরে তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার ছাত্ররা রাস্তায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করেছে। আমার গ্রামের বাড়ি থেকে জানলাম সেখানেও পুলিশের গুলিতে কয়েকজন নিহত। আমার গ্রাম এলাকার খবরের তিনটা ভার্শন শুনলাম। প্রতক্ষ্যদর্শির বরাতে একজন বললো, ছাত্ররা রাস্তায় জড়ো হয় তারপর সেখানে বিএনপির লোকজনও আসে, আওয়ামী লীগও আসে, সংঘর্ষে পুলিশ গুলি করে, তারাও আহত হয়। ৬ জন মারা গেছে। পুলিশ সূত্রে জানলাম, ঐ এলাকায় দোকানপাট খোলা রাখায় পুলিশ গিয়ে অনুরোধ করে যেন কারফিউয়ের মধ্যে দোকান বন্ধ রাখে। দোকানদাররা ঘাউড়ামি করে আর সাথে যোগ দেয় বিএনপির লোকজন। ওরা পুলিশকে আক্রমণ করে তখন পুলিশ রাবার বুলেট ছোড়ে। তাতেও পিছু না হটলে রাইফেল চালানো হয়, ৩জন মারা যায় বাকিরা হাসপাতালে। এলাকার একজনের সূত্রে জানা যায়, বিএনপির কিছু ছেলে ঐ এলাকার একটা রাইসমিলে আগুন দিতে যায়, আওয়ামীলীগের লোকজন ঠেকাতে আসে, বাধে মারামারি। পুলিশ গুলি করে কিছু বিএনপির লোকজনকে মেরে ফেলে। ঘটনাস্থলে মারা যায় ৩জন, বাকিরা হাসপাতালে নেয়ার পর একে একে মারা যায়। নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭জনে।
একই ঘটনার এই তিন ভার্শন বিশ্লেষণ করে যা বুঝলাম, তিনটা ভার্শনই আসলে সত্য। কুরোসাওয়ার রশোমনের মতো। ওখানে ছাত্ররাও ছিল, দোকানদারও ছিল, আর বিএনপিও ছিল, এরা হলো শত্রু। আর অন্যদিকে ছিল আওয়ামী লীগ ও পুলিশ। একেকজনের কাছে ঘটনার একেক রকম অর্থ দাঁড়িয়েছে এই যা। আসলে কতজন মরেছে সেটা জানার অবশ্য সুযোগ নেই। নেট অফ, সংবাদে ডিটেইলস কিছুই আসছে না। আর জেনেই বা হবে কী। মানুষ বা শত্রু মরবে এটাই তো স্বাভাবিক।
বিকাল দিকে ঘোষণা এলো, আগামী দুইদিন সরকারী ছুটি। ব্যাংক, আদালত সব বন্ধ থাকবে। আমার অফিসও বন্ধ দিয়ে দিলো। নরমালি অফিস বন্ধ থাকলে ভালোই লাগে, এবার ভালো লাগলো না। জালে আটকে পড়া মাছের মতো লাগছিলো। কী ঘোর অন্ধকার সামনে! তবে অনেকের মধ্যেই ছুটি ছুটি একটা ভাইব দেখলাম। ইস্ত্রি করা কাপড় পড়ে, পারফিউম মেখে বাচ্চাসহ বেড়াতে যাচ্ছে বিকেলে, এও নজরে পড়লো। সন্ধ্যা হতেই চারপাশ গমগম করছিলো, অনেক মানুষ তখন রাস্তায়। তখনই টহলে এলো আর্মি। মানুষ দাবড়ানি খেয়ে ঘরে উঠলো।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা ৮দফা দাবিও জানালো আইনমন্ত্রীর কাছে গিয়ে। কারো কারো পদত্যাগের দাবিও আছে তাতে। সবাই বললো এগুলো মেনে নেয়া অসম্ভব নয়। বাহ কী সুন্দর সব!
রাতে যেন দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। যদি আর্মি আসে? আমার বাসায় কেন আর্মি আসবে? হ্যা, আমিও তো অপরাধী, আমিও তো দেশের শত্রু। যেদিন রাজপথে বাচ্চাগুলোকে গুলি করে মারা হলো, আমি ফেসবুকে লিখেছিলাম, সব ধংস হয়ে যাক। এই অপরাধে আর্মি যদি আমাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলে? বেশ ভয় দেখানো যাবে লেখকদের। দেখ, ফেসবুকে লেখার কী পরিণতি! আচ্ছা ইন্টারনেট তো খুলবেই এক দুইদিন পর। তখন আর কিছুই কি লেখার সাহস করবে কেউ? আমার কি আর এক বিন্দুও সাহস থাকবে কিছু লেখার? লিখে কী আসে যায়? কিছু করা দরকার। সংসদ ভবনের সামনে গিয়ে চিৎকার করে বলা দরকার, শিক্ষাঙ্গনে গুলি নিষিদ্ধ চাই। ছাত্রদের গুলি করলে কঠোর শাস্তির বিধান চাই। আসলে এগুলোর কিছুই তো আমি পারব না করতে। ভাববোই শুধু।
২১ জুলাই ২০২৪
আজ কারফিউ ১০টায় ভাঙলো না। বিকাল ৩টায় ভাঙলো, আবার বিকাল ৫টা থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত চলবে। নেট স্টিল অফ। ইচ্ছা করেই বন্ধ রেখেছে সবাই বলাবলি করছে। মোবাইলে রাত ১টা ৪৭ মিনিটে মেসেজ এসেছিলো,
“সন্ত্রাসীদের অগ্নিসংযোগ এর কারণে ডেটা সেন্টার পুড়ে যাওয়া এবং আইএস্পির তার পুড়ে যাওয়ার কারণে সারাদেশে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত, মেরামত করতে সময় লাগবে।
-পলক"
আসলে আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা যাই বলুক, মেরামতের কথা অর হোয়াটেভার, ওদেরকে কেউ বিশ্বাস করে না। সবাই বোঝে ভাওতাবাজিগুলো।
রায় দিলেন আদালত। আমার মোবাইলে সরকারি মেসেজ এলো।
"আপিল বিভাগ কর্তৃক কোটা পুনর্বহালে হাইকোর্টের রায় বাতিল। মেধায় ৯৩%, মুক্তিযোদ্ধা ৫%, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১% এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১% করা হয়েছে।"
মেসেজে যদিও প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ পার্সেন্ট লিখেছে তবে এই ১ পারসেন্টের মধ্যে তৃতীয় লিংগও আছে। বাদ পড়েছে নারী কোটা।
২২ জুলাই ২০২৪
সম্পূর্ণ ভোতা একটা দিন গেলো। কোথায় কী হচ্ছে, সূর্য কোনদিক দিয়ে উঠলো, কখন ডুবলো কিছুই জানি না। যন্ত্রের মতো দৈনিন্দন কাজগুলো করে যাচ্ছি। আর একটার পর একটা সিনেমা দেখেছি। প্রচন্ড অস্থির ভেতরটা। কী হবে, এরপর কী? এমন ভাবনায় ঢুকে যাচ্ছিলাম বারবার।
রায়কে স্বাগত জানিয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়করা। সরকারের মন্ত্রীরা বলা শুরু করেছে জ্বালাও পোড়াও এর রাজনীতি করেছে বিএনপি-জামাত, ওদের শাস্তি হবে ইত্যাদি।
কারফিউ চলছে। বাইরে যাইনি। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে।
২৩ জুলাই ২০২৪
আজ ১টা থেকে ৫টা কারফিউ শিথিল ছিল। রায়ের প্রজ্ঞাপন জারি হলো। মন্ত্রীদের কথা শুনলাম এফএম রেডিওতে। কেন নারী কোটা নেই সেই প্রশ্নের জবাবে আনিসুল বললো, নারীরাই তো আন্দোলনে বলেছে তাদের কোটা দরকার নেই। এ কথা যদি হাইকোর্টের কানে গিয়ে থাকে তাহলে তো আর আমাদের কিছু করার নেই।
বিকালে জানলাম আগামীকাল ১০টা থেকে ৫টা কারফিউ শিথিল, অফিস থেকে জানালো আগামীকাল ১১টা থেকে ৪টা অফিস করতে হবে। রাতে ইন্টারনেট এলো, এসেই আবার চলে গেল।
[দিনলিপি’র এখানেই ইতি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের ৮ দফা আদায় করতে তৎপরতা চালিয়ে যায়। জনতা তাদেরকে সমর্থন জানায়। দমন পীড়নের ভিতরেই ৮ দফা ধীরে ধীরে ১ দফা এক দাবীতে পরিণত হয়। গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের পতন ঘটে। জুলাই ও আগস্ট মাসে সরকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের অস্ত্র ব্যবহারে প্রাণ গেছে বহু সাধারণ মানুষের। এমনকি হেলিকপ্টার থেকেও গুলি করা হয়েছে। পথচারীদের প্রাণ গেছে। একে অনেকেই জুলাই গণহত্যা বলছেন। শহীদের সংখ্যা প্রায় হাজার।]