দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম এতদাঞ্চলে মানবীয় সাম্যবাদের প্রধান প্রতিভূ। ধর্মীয় গোঁড়ামি, কূপমন্ডুকতা ও ভণ্ডামির প্রতিবাদ তাঁর লেখনীর অন্যতম দিক। আজন্ম স্বাধীনচেতা নজরুলই ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করেন। স্বাধীনতাহীনতায় যে মানবতা বিলীন হয়ে যায় -এটা কবি নজরুলের চেয়ে আর কে ভালো জানতেন?
কবিতা রচনার মাধ্যমে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত নজরুল ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। জেলখানার ভেতর অকথ্য নির্যাতন আর বৈষম্যের শিকার হয়ে কবি এখানেও বিদ্রোহী হয়ে ওঠলেন। শুরু করলেন আন্দোলন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর যুবা বয়সেই ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল হুগলী জেলে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নজরুল একটানা অনশন করে যান ৩৯ দিন। সেই সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং নজরুলকে চিঠি লিখে অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ জানান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলং থেকে এ বিষয়ে তাকে টেলিগ্রাম পাঠান। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- ‘Live up hunger strike. Our Literature claims you’ কিন্তু টেলিগ্রামটি নজরুলের হাতে পৌঁছায়নি। জেল কর্তৃপক্ষ ‘Address is not found’ লিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে টেলিগ্রামটি ফেরত পাঠান। জেল কর্তৃপক্ষ প্রকৃত ঠিকানা জানলেও ইচ্ছে করেই টেলিগ্রামটি নজরুলের কাছে না পাঠিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ফেরত পাঠান। রবীন্দ্রনাথ এ ঘটনায় দারুণ মর্মাহত হন।
যেই রবীন্দ্রনাথ বিদ্রোহী নজরুলকে প্রায়ই বলতেন,‘দ্যাখ উন্মাদ। তোর জীবনে শেলীর মতো, কীটসের মতো খুব বড় একটা ট্রাজেডি আছে, তুই প্রস্তুত হ’।
পরবর্তীকালে ১৯৪২ সালেই জীবনের সাথে অবিরল যুদ্ধ করতে করতে কী এক অজানা অভিমানে মধ্যবয়সী কবি চিরকালের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। আমরা বঞ্চিত হই তাঁর আরও অত্যুঙ্গ অনল সাহিত্য সুধা থেকে।
অজ্ঞাত রোগে বাকরুদ্ধ ও লেখনি শক্তি হারিয়ে অকালে সাহিত্যাকাশ থেকে ঝরে পড়ার আগে কবি এভাবেই তাঁর শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করেছিলেন কাব্যলক্ষ্মীকে:
অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে
প্রদীপ শিখা সম,
কাঁপিছে প্রাণ মম
তোমার সুন্দর ভঙ্গিতে।
মানুষের জয়গান গাওয়া আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনদর্শন আর পাঁচটা মানুষের চেয়ে আলাদা হবে -এটাই যেন জীবনদেবতার লিখন।
এতদাঞ্চলের ধর্মীয় অযাচার ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতা নজরুলকে সবচেয়ে বেশি ভাবিয়েছে এবং পুড়িয়েছে। ধর্ম সওদাগরদের বিরুদ্ধে তিনিও তাঁর দ্রোহ ও প্রতিবাদ জারি রেখেছিলেন সপ্রাণ সজোরে।
কবি নজরুল লিখেছেন...
¶ হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব, দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়ত পণ্ডিত্ব, তেমনি দাড়িত্ব ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব! এই দুই ‘ত্ব’ মার্কা চুলের গোছা নিয়েই আজ এত চুলোচুলি! আজ যে মারামারিটা বেঁধেছে সেটাও ভাই পণ্ডিত মোল্লায় মারামারি, হিন্দু-মুসলমানের মারামারি নয়।”
¶ কেউ বলেন আমার বাণী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু-মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।
¶ কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা
ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা
ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ
ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,
এক মানবের একই রক্ত মেশা
কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।
¶ হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!
¶ তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!’
মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;-গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।
অতঃপর নজরুল কহেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম মোক্ষম কথা...
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
আমাদের জ্ঞাতি প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় কবিকে স্মরণ করি।
......................
লেখক: সাংবাদিক
১২ ভাদ্র ১৪৩১ | ২৭ আগস্ট ২০২৪