পশ্চিমা মিডিয়া ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল ইস্যুতে সবসময় একটি একপাক্ষিক অবস্থান নেয়। এছাড়া বিশ্বের বড় বড় মিডিয়াগুলো মধ্যপ্রাচ্যের যে কোন সংঘাতে ইসরায়েলের পক্ষে তাদের অবস্থান প্রকাশ করে। ফিলিস্তিনের মানুষের প্রায় ৮০ বছরের মুক্তির সংগ্রামকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে জায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্র এবং তার এজেন্টরাও মন দখলের গভীর তৎপরতা চালায়। ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করেই ইহুদিরা থেমে থাকেনি; তারা গণমাধ্যম, শিক্ষাসমাজ, রাজনীতি, চলচ্চিত্র, সামাজিকমাধ্যম, কূটনীতি, আইন-বিধি ও তদবিরের মাধ্যমে মানুষের মনের দখল নিতেও গভীর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে।
সারা বিশ্বে মানবাধিকারের বিষয়ে শক্ত অবস্থান দেখালেও ফিলিস্তিনে সংঘটিত মানবাধিকার ইস্যুগুলো সজ্ঞানে এড়িয়ে যায় বিশ্ব সংবাদমাধ্যমগুলো। এ দ্বিমুখী আচরণ বুঝতে গেলে আমাদের তাকাতে হবে এ সকল মিডিয়ার সাথে ইসরায়েলের সম্পর্কের দিকে।
আমেরিকার এক ওয়েবসাইটের তথ্যমতেই প্রো ইসরায়েলি লবি হিলারি ক্লিনটনের পিছে ২০১৬ সালের নির্বাচনের ক্যাম্পেইনে প্রায় ২.৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিলো। ২০২০ সালে জো বাইডেনের নির্বাচনের ক্যাম্পেইনের জন্য ৩.৭ মিলিয়ন ডলারের যোগান দিয়েছিলো যা হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার বেশি। ২০১৮ সালের আমেরিকার যে ইলেকশন সে সময়ে ইসরায়েলি লবিং প্রায় মোট ২২ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিলো।
আমেরিকার মিডিয়াগুলোর সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে ইসরায়েল প্রচুর অর্থকড়ি খরচ করে। এক্ষেত্রে প্রথমে যেকোন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে তৈরি করা সম্পর্ককে কাজে লাগায়।
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে কাজ করে কিছু ইসরায়েলি লবি প্রতিষ্ঠান। এ লবি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সাথে সম্পর্ক করে এবং তাদের নির্বাচনের প্রচারণার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন পড়ে লবিগুলো সে অর্থের যোগান দেয়।
এখানে দেখা যায় ইসরায়েল যাকে নির্বাচনের সময় টাকা দিয়েছিলো নির্বাচনে জিতার পর তার ইসরায়েলী স্বার্থ রক্ষা করা একপ্রকার দ্বায়িত্বের মধ্যে পড়ে যায়। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির ভেতরে ইসরায়েল লবি একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে।
আমেরিকায় ইসরায়েলের একটি ইনস্টিটিউট রয়েছে যার নাম ‘আমেরিকান ইসরায়েলি পবিলিক এফেয়ার্স কমিটি(এইপ্যাক)। আমেরিকায় এই ইনস্টিটিউটটি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সেক্টরে প্রভাব বিস্তার করে। আমেরিকার অস্ত্র, জ্বালানি থেকে শুরু করে সকল বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিতে এদের প্রভাব রয়েছে।
ব্রিটেনের দিকে তাকালেও এই প্রো ইসরায়েলি লবিগুলোর প্রভাব লক্ষ করা যায়। ২০২০ সালে যুক্তরাজ্যে চলমান ব্লাক লাইভস ম্যাটার একসময় প্রো প্যালেস্টাইন মুভমেন্টকেও সাপোর্ট করছিলো। মুভমেন্টের ম্যান্ডেটে ফিলিস্তিনের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টি উঠে আসে। তখন ব্রিটেনের মিডিয়াগুলা এই মুভমেন্টের উপর থেকে তাদের সাপোর্ট সরিয়ে নেয়।
এদের মধ্যে বিবিসি ও স্কাই স্পোর্টস এর মতো মিডিয়া রয়েছে যারা তাদের সাপোর্ট সরিয়ে নেয়। কারণ ফিলিস্তিনের পক্ষে তাদের অবস্থান নেওয়াটা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন করবে। তাদের এ অবস্থানের কারণে যে কোন সময় তাদের আর্থিক অনুদান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর এসব কারণে তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কথা বলতে বা অবস্থান নিতে ভয় পায়। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য উভয় মিডিয়ার ক্ষেত্রে সত্য।
এডওয়ার্ড স্যামুয়েল হারম্যান আর নোয়াম চমস্কি ১৯৮৮ সালে গণমানস নিয়ন্ত্রণ তথা মন দখলের উদ্দেশ্যে অপপ্রচার কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে একটি কিতাব রচনা করেছেন। এ কিতাবের নাম ‘Manufacturing Consent: The Political Economy of Mass Media’. এ বইয়ে লেখকদ্বয় তাদের বহুল আলোচিত ‘Propaganda Model’-এর প্রস্তাব করেন। এই মডেলকে হাতিয়ার করে সংবাদমাধ্যমে পাঠক ও দর্শকদের মগজধোলাই করতে ব্যবহার হচ্ছে। ফিলিস্তিনের ওপর অবৈধ ইসরাইলের গণহত্যাকে ঢেকে রাখতে পশ্চিমা গণমাধ্যম তাদের বার্তা নীতিতে এ কাঠামোই ব্যবহার করছে। কী সেই কাঠামো?
এডওয়ার্ড ও চমস্কি এ কিতাবের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের গৃহীত বা অঘোষিত নীতি বা স্বার্থের অনুকূলে কোনো ঘটনাসংশ্লিষ্টরা ‘ভিকটিম’ হিসাবে গণমাধ্যমে পরিষেবা (News Treatment) পায় অথবা পায় না। এ বিষয়টিকে লেখকদ্বয় বলছেন, সংবাদমাধ্যমে আসার ‘যোগ্য আক্রান্ত’ (Worthy Victims) এবং ‘অযোগ্য আক্রান্ত’ (Unworthy Victims)। আমি আরও সহজ করে বলতে চাই এভাবে- ক. ‘সহায়তা ও সমবেদনা পাওয়ার যোগ্য ভিক্টিম’ এবং খ.‘সহযোগিতা ও সমবেদনা পাওয়ার অযোগ্য ভিক্টিম’।
অর্থাৎ যদি কোনো স্থানের নিপীড়িত জনগোষ্ঠী বা জাতি মার্কিন স্বার্থের (প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইহুদিবাদী স্বার্থ) অনুকূলে থাকে, তাহলে সেই নিপীড়িত-অত্যাচারিত মজলুম যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে সমবেদনা পাওয়ার যোগ্য হিসাবে ইতিবাচক প্রচারণা বা কাভারেজ পায়।
সংবাদমাধ্যম এ বিষয়ে এজেন্ডা সেট করে পাঠক-দর্শকদের মনে সেই ভিকটিম বা আক্রান্তকে জায়গা দেয়। অডিয়েন্সের মন দখল করে তাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে সেই বিশেষ শ্রেণির ‘বাছাইকৃত ভিকটিমের’ জন্য দরদ উৎপাদন করে। এ উৎপাদন সামাজিকমাধ্যমে বারবার পুনরুৎপাদিত হয়। এরপর অডিয়েন্সের ট্যাক্সের টাকা বা তার অর্থে কেনা অস্ত্র ও প্রযুক্তি সেই বিশেষ শ্রেণির মজলুমকে উদ্ধারের জন্য ব্যবহারের নৈতিক সমর্থন অর্জন করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। এভাবে ভীতিও উৎপাদন করা হয়।
সাদ্দামকে ভয় পাইয়ে দিয়ে ইরাকে আগ্রাসন এর নজির। এখন ইরানে আক্রমণ করতেও একই পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে।
রাশিয়ার আগ্রাসনের পর ইউক্রেনের রুশবিরোধী সবাই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপীয়দের দয়া-দাক্ষিণ্য ও সামরিক-আর্থিক সমর্থন পেয়েছে, পাচ্ছে। কিন্তু ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র সৌদি আরব আর আরব আমিরাত হামলা চালালেও তারা মার্কিন বা পশ্চিমা গণমাধ্যমে অনুকম্পা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেনা। কারণ, ইয়েমেনের ভিকটিমরা সৌদি আরবের কথামতো চলেনি। তারা ‘আল মওতু ইসরাইল’ বলে স্লোগান দেয় এবং তাদের প্রতি ইরানের সরকার সহানুভূতিশীল।
এ উদাহরণকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে আনা গেলে দেখা যাবে, অবৈধ ইসরাইল পশ্চিমাদের গণমাধ্যমে ‘সাহায্য পাওয়ার যোগ্য ভিকটিম’ হিসাবে প্রচারিত হয়, ফিলিস্তিনিরা হয়ে যায় ‘সন্ত্রাসী’ বা ‘উসকানিদাতা’। গণমাধ্যম থেকে এ বয়ান যায় একাডেমিয়ায়, সেখান থেকে সমাজের আরও গভীরে, এমনকি ‘খ্রিষ্টান জায়নবাদী’ নামের ইভ্যানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরা ধর্মের বিরুদ্ধে গিয়ে ‘অ্যান্টিক্রাইস্টের’ সহযোগী এ ইহুদিবাদীদেরই সমর্থন করছে।
এ গোলকধাঁধা থেকে বোঝা যায়, জায়নবাদীরা পশ্চিমের জনমন দখল করে নিজেদের পক্ষের বয়ান উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে চলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন কংগ্রেস, সিনেট ও হোয়াইট হাউজে ইসরাইল এখনো সেই ‘হিটলারের গ্যাস চেম্বারে মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকা আক্রান্ত ইহুদি’! অথচ সময়ের প্রেক্ষাপটে ইসরাইল নিজেই হিটলারের ভূমিকা পালন করছে এবং ফিলিস্তিনের মুসলমানরা ইহুদিদের হাতে গণহত্যা বা হলোকস্টের শিকার হচ্ছে।
এককালের মজলুম যে আজকে ভয়াবহ জাতি নিধনকারী, গণহত্যাকারী, দখলদার জালিমের ভূমিকা পালন করছে, এ সত্য পশ্চিমা মিডিয়া তার অডিয়েন্সের মন থেকে গুম করে রেখেছে।
এ উদাহরণটি কেবল সাম্প্রতিক সময়কে কেন্দ্র করে নয়, ১৯৪৮ সালে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল গঠনের পর থেকে প্রতিটি সময়েই ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে সংঘাত-উত্তেজনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ১৯৪৭ সালে সমগ্র ফিলিস্তিন প্রায় ২৭,০০০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলে ‘ইসরাইল’ বলে কিছু ছিল না। আজ ২০২৩-এ কীভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসা ইসরাইল ২২,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের হয়ে যায়? অন্যদিকে যার জমি সেই ভূমিপুত্র ফিলিস্তিনিরা; পশ্চিমতীর, রামাল্লাহ, নাবলুস, হেবরন, নাজারাথ, আল কুদস বা গাজাবাসী কেন মাত্র ৪,০০০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ধুঁকে মরছে?
এ প্রশ্নই পশ্চিমে কেউ তুলতে পারবে না। কারণ, ইহুদি লেখক নরম্যান ফিংকেস্টে বলেছেন, ১৯৬৭ সালে বিশাল ফিলিস্তিনি ও সিরিয়ান ভূখণ্ড দখল করার পর ইসরাইলের পরামর্শকরা বর্ণবাদী ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের বিরোধিতাকে ইহুদি ধর্মবিরোধিতা বা অ্যান্টি-সেমেটিজিম বলে ব্যাপক প্রচার করে এবং এ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি-নির্যাতনকে পুঁজি হিসাবে ব্যবহার শুরু হয়।
ইসরাইলের মনমতো আমেরিকার চলাকে উন্মোচন করে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নন্দিত অধ্যাপক জন মিয়ার্শিমার ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক স্টিফেন ওয়াল্ট ‘The Israel Lobby & US Policy’ শীর্ষক একটি কিতাব রচনা করেছেন। এ কিতাবে দেখিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একেবারে বিনাস্বার্থে কম করে হলেও ৩.৮ বিলিয়ন ডলার ইসরাইলকে দেয় ইহুদি-লবির প্ররোচনায়, ইসরাইল আক্রান্ত-অসহায় এ বয়ানের ভিত্তিতে। লেখকদ্বয় বলেছেন, ইসরাইল সাহায্য পেতে পেতে ফুলেফেঁপে উঠেছে এবং এতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আর্থিক বা নিরাপত্তাজনিত লাভ হচ্ছে না।
২০০৬ সালে প্রকাশিত ‘The Ethnic Cleansing of Palestine’ শীর্ষক কিতাবে ইসরাইলের ইহুদি অধ্যাপক ইলান পাপ্পে ইহুদিবাদীদের মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ইসরাইল রাষ্ট্রের ‘বিসমিল্লায় গলদ’কে চিহ্নিত করেছেন। পাপ্পে বলেছেন, ১৯৪৮ সালে নীলনকশার মাধ্যমে ৭-৮ লাখ ফিলিস্তিনি আদিবাসীকে (যাদের অধিকাংশ মুসলমান এবং কিছু ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টানও আছে, যেমন এডওয়ার্ড সাঈদের মতো পরিবার) মেরে তাড়িয়ে দেয় ইউরোপ থেকে বিতাড়িত ইহুদিরা। এ সময় ৫ শতাধিক ফিলিস্তিনি গ্রামে জাতিনির্মূলের উদ্দেশ্যে গণহত্যা চালায় ‘হলোকস্ট ব্যবসায়ী’ ইহুদিরা।
মানে বুঝেছেন? তারা অতীতে হলোকস্টের শিকার হয়ে ইউরোপ-আমেরিকার সহায়তা নিয়ে নিজেরাই আরও বড় ও ধারাবাহিক হলোকস্ট ঘটাচ্ছে! আর তা নিয়ে পশ্চিমের মিডিয়ায় প্রশ্নই নেই!
ইসরাইল মূলত একটি উপনিবেশবাদী অবৈধ রাষ্ট্র, যা ভূমিপুত্রদের জীবন ও সম্পদ লুটে গড়ে উঠেছে। সাঈদের ‘ফিলিস্তিন প্রশ্ন’ তো পশ্চিমা শিক্ষাসমাজে আজও পাঠ্য হয়ে ইসরাইলের দখলদারত্বের পরিচায়ক হয়ে উঠেছে। নেলসন ম্যান্ডেলা ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রামকে কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তির লড়াই হিসাবেই দেখেছেন। এত সব বলার কারণ-পৃথিবীর প্রতিটি বয়ান ও আলোচনায় ফিলিস্তিনিরা মজলুম। তাদের স্বাধীনতা হরণ করছে পশ্চিমাদের সহায়তায় শ্বেতাঙ্গ ইহুদিরা। সেই মজলুমকে কেন পশ্চিমা স্বাধীনতা ব্যবসায়ীরা ভুলে গেল? ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জালিমের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাদের সমর্থনে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ হলো এবং সহস্রাধিক ফিলিস্তিনির জীবন গেল? জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদই অনিরাপত্তার ধ্বজাধারী হয়ে উঠল!
এ মজলুম বা নিপীড়িত ফিলিস্তিনিরা পশ্চিমা মিডিয়ায় কখনোই ভূমিপুত্র বা আদিবাসীরূপে আসে না। এ আধুনিক যুগেও প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে মজলুম শরণার্থীদের খাদ্য-পানি না দিয়ে, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে, স্থল, নৌ ও আকাশপথ অবরুদ্ধ করে নিরস্ত্র শিশু, বয়োবৃদ্ধ, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে গণহত্যা চালাচ্ছে একটি কথিত ‘রাইট টু ডিফেন্ড ব্যবসায়ী আক্রান্ত রাষ্ট্র’। এ কারণে ফিলিস্তিনের পক্ষে গণবয়ান নির্মাণের কোনো এজেন্ডা পশ্চিমা মিডিয়া নেয় না। তাদের নেওয়ার সক্ষমতায় লাগাম টেনে দেয় প্রভাবশালী ইহুদি বলয়। গাজা, পশ্চিমতীর, পূর্ব জেরুসালেম, রামাল্লা, নাবলুসে প্রতিদিন ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে অবৈধ ইসরাইল। ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি-জমি-ফসল দখল ও লুট করছে; কিন্তু পশ্চিমা গণমাধ্যমে এ সংবাদকে ফ্রেমিং করে, প্রাইমিং করে সামনে এনে ইসরাইলের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার কোনো চেষ্টা দেখা যায় না।
গাজায় অমানবিক অত্যাচারের শিকার ফিলিস্তিনিরা যখন গৃহে নির্মিত অস্ত্র দিয়ে পালটা জবাব দিল; ফ্রানৎস ফানোঁর মতে, দুনিয়ার নিকৃষ্ট ঔপনিবেশিক শোষকদের বিরুদ্ধে বিপ্লব করল; তখন দখলদার ইহুদিরা সংবাদমাধ্যমের ‘যোগ্য আক্রান্ত’ হয়ে উঠল। কিন্তু ফিলিস্তিনি মজলুমের প্রতিরোধ লড়াইটি ইতিবাচকভাবে চিত্রিত হলো না। এটিই মজলুমকে খলনায়ক বানানোর তাত্ত্বিক কাঠামো, যা ইহুদিবাদী গণমাধ্যম অনুসরণ করে যাচ্ছে।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে হামাস বা ফিলিস্তিনিদের ব্যাপকভাবে দানবায়ন (Dehumanize) করা হলো, বা এখনো হচ্ছে। যে শব্দগুলো হিটলার ইহুদি নিধনের আগে ব্যবহার করেছিল বা রুয়ান্ডার গণহত্যায় ব্যবহৃত হয়েছিল, সেগুলো দখলদাররা ব্যবহার করছিল ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে। যেমন, ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ফিলিস্তিনিদের Human animals বলে মানুষ থেকে খারিজ করে তাদের হত্যা করাকে জায়েজ করে তোলে। অ্যান্টি-সেমিটিজম সংবেদনশীল পশ্চিমা মিডিয়া এ জাতি নিধনকারী শব্দের ব্যাপারে একবারও আপত্তি জানায়নি।
অর্থাৎ তাদের এজেন্ডায় ফিলিস্তিনিরা মোটেই আলোচনা, প্রচারণা বা বয়ানের ‘যোগ্য মজলুম’ নয় এবং ‘যোগ্য মজলুম’ হিসাবে তালিকাবদ্ধ ইসরাইলিদের কোনোভাবেই তারা জালিম হিসাবে তুলে ধরে গণমানসে ইসরাইলবিরোধী মানসিকতার জন্ম দেবে না।
ইহুদি অধ্যাপক নরম্যান ফিংকেলস্টেইনের মতে, ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলিদের আগ্রাসনের বলি হয়ে দাস-দাসী হয়ে গেছে এবং জালেমদের বিরুদ্ধে মজলুম দাসের বিদ্রোহ করার কেবল নৈতিক অধিকার রয়েছে তা নয়, বরং আন্তর্জাতিক সব আইন দ্বারা স্বীকৃত দাসবিপ্লব। তারপরও ১৯১৭ সালের অমানবিক বেলফোর ঘোষণার ফলে ১৯৪৮ সালে গণহত্যার মাধ্যমে অবৈধভাবে গঠিত জালেম রাষ্ট্রকাঠামোর চলমান নিপীড়ন ও মানবতাবিরোধী অপরাধকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে, যুদ্ধ থামাতে না বলে ‘Do you condemn Hamas?’ দিয়ে শুরু করা পশ্চিমা মিডিয়ার উদ্দেশ্য অডিয়েন্সের মন দখল করা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায় রাখতে পারবা না।’ বাঙালিরা মরতে শিখে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। ফিলিস্তিনিরাও নিশ্চয়ই জালিম ইসরাইলের অবরুদ্ধ কারাগার থেকে একদিন মুক্ত হয়ে পশ্চিমতীর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত মুক্ত পাখির মতো উড়বে। মরতে শেখা জাতির মুক্তিযুদ্ধ পুরো বিশ্বের জন্য প্রায়োগিক শিক্ষা, প্রজ্ঞাপূর্ণ দীক্ষা ও জীবন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়।
বি.দ্র. এটি কোনো মৌলিক লেখা নয়। এই লেখার তথ্যগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। সমস্ত সোর্স উল্লেখ করা সম্ভব নয়। এই লেখার আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো আমার কর্মস্থল ও আমাদের আড্ডা। আমি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের ইন্টারন্যাশনাল বিটে কাজ করি। প্রতিদিনই আমাকে এ সংক্রান্ত সংবাদগুলো বিভিন্ন মিডিয়া থেকে সংগ্রহ ও সম্প্রচার করতে হয়। এছাড়াও বন্ধু মোজাক্কির রিফাত, আদনান তুর্য, আমির মাহি বা ওস্তাদ নাজিব হায়দার ভাই ও সহকর্মী বড়ভাই ফারুক ভাইয়ের সাথে বিচিত্র আড্ডায় আমার যা শিক্ষা তা পুঁজি করেই এই লেখাটি লিখেছি। ভুলত্রুটি মার্জনীয়৷
সারা বিশ্বে মানবাধিকারের বিষয়ে শক্ত অবস্থান দেখালেও ফিলিস্তিনে সংঘটিত মানবাধিকার ইস্যুগুলো সজ্ঞানে এড়িয়ে যায় বিশ্ব সংবাদমাধ্যমগুলো। এ দ্বিমুখী আচরণ বুঝতে গেলে আমাদের তাকাতে হবে এ সকল মিডিয়ার সাথে ইসরায়েলের সম্পর্কের দিকে।
আমেরিকার এক ওয়েবসাইটের তথ্যমতেই প্রো ইসরায়েলি লবি হিলারি ক্লিনটনের পিছে ২০১৬ সালের নির্বাচনের ক্যাম্পেইনে প্রায় ২.৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিলো। ২০২০ সালে জো বাইডেনের নির্বাচনের ক্যাম্পেইনের জন্য ৩.৭ মিলিয়ন ডলারের যোগান দিয়েছিলো যা হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার বেশি। ২০১৮ সালের আমেরিকার যে ইলেকশন সে সময়ে ইসরায়েলি লবিং প্রায় মোট ২২ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিলো।
আমেরিকার মিডিয়াগুলোর সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে ইসরায়েল প্রচুর অর্থকড়ি খরচ করে। এক্ষেত্রে প্রথমে যেকোন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে তৈরি করা সম্পর্ককে কাজে লাগায়।
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে কাজ করে কিছু ইসরায়েলি লবি প্রতিষ্ঠান। এ লবি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সাথে সম্পর্ক করে এবং তাদের নির্বাচনের প্রচারণার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন পড়ে লবিগুলো সে অর্থের যোগান দেয়।
এখানে দেখা যায় ইসরায়েল যাকে নির্বাচনের সময় টাকা দিয়েছিলো নির্বাচনে জিতার পর তার ইসরায়েলী স্বার্থ রক্ষা করা একপ্রকার দ্বায়িত্বের মধ্যে পড়ে যায়। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির ভেতরে ইসরায়েল লবি একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে।
আমেরিকায় ইসরায়েলের একটি ইনস্টিটিউট রয়েছে যার নাম ‘আমেরিকান ইসরায়েলি পবিলিক এফেয়ার্স কমিটি(এইপ্যাক)। আমেরিকায় এই ইনস্টিটিউটটি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সেক্টরে প্রভাব বিস্তার করে। আমেরিকার অস্ত্র, জ্বালানি থেকে শুরু করে সকল বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিতে এদের প্রভাব রয়েছে।
ব্রিটেনের দিকে তাকালেও এই প্রো ইসরায়েলি লবিগুলোর প্রভাব লক্ষ করা যায়। ২০২০ সালে যুক্তরাজ্যে চলমান ব্লাক লাইভস ম্যাটার একসময় প্রো প্যালেস্টাইন মুভমেন্টকেও সাপোর্ট করছিলো। মুভমেন্টের ম্যান্ডেটে ফিলিস্তিনের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টি উঠে আসে। তখন ব্রিটেনের মিডিয়াগুলা এই মুভমেন্টের উপর থেকে তাদের সাপোর্ট সরিয়ে নেয়।
এদের মধ্যে বিবিসি ও স্কাই স্পোর্টস এর মতো মিডিয়া রয়েছে যারা তাদের সাপোর্ট সরিয়ে নেয়। কারণ ফিলিস্তিনের পক্ষে তাদের অবস্থান নেওয়াটা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন করবে। তাদের এ অবস্থানের কারণে যে কোন সময় তাদের আর্থিক অনুদান বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর এসব কারণে তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কথা বলতে বা অবস্থান নিতে ভয় পায়। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য উভয় মিডিয়ার ক্ষেত্রে সত্য।
এডওয়ার্ড স্যামুয়েল হারম্যান আর নোয়াম চমস্কি ১৯৮৮ সালে গণমানস নিয়ন্ত্রণ তথা মন দখলের উদ্দেশ্যে অপপ্রচার কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে একটি কিতাব রচনা করেছেন। এ কিতাবের নাম ‘Manufacturing Consent: The Political Economy of Mass Media’. এ বইয়ে লেখকদ্বয় তাদের বহুল আলোচিত ‘Propaganda Model’-এর প্রস্তাব করেন। এই মডেলকে হাতিয়ার করে সংবাদমাধ্যমে পাঠক ও দর্শকদের মগজধোলাই করতে ব্যবহার হচ্ছে। ফিলিস্তিনের ওপর অবৈধ ইসরাইলের গণহত্যাকে ঢেকে রাখতে পশ্চিমা গণমাধ্যম তাদের বার্তা নীতিতে এ কাঠামোই ব্যবহার করছে। কী সেই কাঠামো?
এডওয়ার্ড ও চমস্কি এ কিতাবের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের গৃহীত বা অঘোষিত নীতি বা স্বার্থের অনুকূলে কোনো ঘটনাসংশ্লিষ্টরা ‘ভিকটিম’ হিসাবে গণমাধ্যমে পরিষেবা (News Treatment) পায় অথবা পায় না। এ বিষয়টিকে লেখকদ্বয় বলছেন, সংবাদমাধ্যমে আসার ‘যোগ্য আক্রান্ত’ (Worthy Victims) এবং ‘অযোগ্য আক্রান্ত’ (Unworthy Victims)। আমি আরও সহজ করে বলতে চাই এভাবে- ক. ‘সহায়তা ও সমবেদনা পাওয়ার যোগ্য ভিক্টিম’ এবং খ.‘সহযোগিতা ও সমবেদনা পাওয়ার অযোগ্য ভিক্টিম’।
অর্থাৎ যদি কোনো স্থানের নিপীড়িত জনগোষ্ঠী বা জাতি মার্কিন স্বার্থের (প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইহুদিবাদী স্বার্থ) অনুকূলে থাকে, তাহলে সেই নিপীড়িত-অত্যাচারিত মজলুম যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে সমবেদনা পাওয়ার যোগ্য হিসাবে ইতিবাচক প্রচারণা বা কাভারেজ পায়।
সংবাদমাধ্যম এ বিষয়ে এজেন্ডা সেট করে পাঠক-দর্শকদের মনে সেই ভিকটিম বা আক্রান্তকে জায়গা দেয়। অডিয়েন্সের মন দখল করে তাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে সেই বিশেষ শ্রেণির ‘বাছাইকৃত ভিকটিমের’ জন্য দরদ উৎপাদন করে। এ উৎপাদন সামাজিকমাধ্যমে বারবার পুনরুৎপাদিত হয়। এরপর অডিয়েন্সের ট্যাক্সের টাকা বা তার অর্থে কেনা অস্ত্র ও প্রযুক্তি সেই বিশেষ শ্রেণির মজলুমকে উদ্ধারের জন্য ব্যবহারের নৈতিক সমর্থন অর্জন করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। এভাবে ভীতিও উৎপাদন করা হয়।
সাদ্দামকে ভয় পাইয়ে দিয়ে ইরাকে আগ্রাসন এর নজির। এখন ইরানে আক্রমণ করতেও একই পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে।
রাশিয়ার আগ্রাসনের পর ইউক্রেনের রুশবিরোধী সবাই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপীয়দের দয়া-দাক্ষিণ্য ও সামরিক-আর্থিক সমর্থন পেয়েছে, পাচ্ছে। কিন্তু ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র সৌদি আরব আর আরব আমিরাত হামলা চালালেও তারা মার্কিন বা পশ্চিমা গণমাধ্যমে অনুকম্পা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেনা। কারণ, ইয়েমেনের ভিকটিমরা সৌদি আরবের কথামতো চলেনি। তারা ‘আল মওতু ইসরাইল’ বলে স্লোগান দেয় এবং তাদের প্রতি ইরানের সরকার সহানুভূতিশীল।
এ উদাহরণকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে আনা গেলে দেখা যাবে, অবৈধ ইসরাইল পশ্চিমাদের গণমাধ্যমে ‘সাহায্য পাওয়ার যোগ্য ভিকটিম’ হিসাবে প্রচারিত হয়, ফিলিস্তিনিরা হয়ে যায় ‘সন্ত্রাসী’ বা ‘উসকানিদাতা’। গণমাধ্যম থেকে এ বয়ান যায় একাডেমিয়ায়, সেখান থেকে সমাজের আরও গভীরে, এমনকি ‘খ্রিষ্টান জায়নবাদী’ নামের ইভ্যানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরা ধর্মের বিরুদ্ধে গিয়ে ‘অ্যান্টিক্রাইস্টের’ সহযোগী এ ইহুদিবাদীদেরই সমর্থন করছে।
এ গোলকধাঁধা থেকে বোঝা যায়, জায়নবাদীরা পশ্চিমের জনমন দখল করে নিজেদের পক্ষের বয়ান উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে চলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন কংগ্রেস, সিনেট ও হোয়াইট হাউজে ইসরাইল এখনো সেই ‘হিটলারের গ্যাস চেম্বারে মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকা আক্রান্ত ইহুদি’! অথচ সময়ের প্রেক্ষাপটে ইসরাইল নিজেই হিটলারের ভূমিকা পালন করছে এবং ফিলিস্তিনের মুসলমানরা ইহুদিদের হাতে গণহত্যা বা হলোকস্টের শিকার হচ্ছে।
এককালের মজলুম যে আজকে ভয়াবহ জাতি নিধনকারী, গণহত্যাকারী, দখলদার জালিমের ভূমিকা পালন করছে, এ সত্য পশ্চিমা মিডিয়া তার অডিয়েন্সের মন থেকে গুম করে রেখেছে।
এ উদাহরণটি কেবল সাম্প্রতিক সময়কে কেন্দ্র করে নয়, ১৯৪৮ সালে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল গঠনের পর থেকে প্রতিটি সময়েই ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে সংঘাত-উত্তেজনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ১৯৪৭ সালে সমগ্র ফিলিস্তিন প্রায় ২৭,০০০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলে ‘ইসরাইল’ বলে কিছু ছিল না। আজ ২০২৩-এ কীভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসা ইসরাইল ২২,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের হয়ে যায়? অন্যদিকে যার জমি সেই ভূমিপুত্র ফিলিস্তিনিরা; পশ্চিমতীর, রামাল্লাহ, নাবলুস, হেবরন, নাজারাথ, আল কুদস বা গাজাবাসী কেন মাত্র ৪,০০০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ধুঁকে মরছে?
এ প্রশ্নই পশ্চিমে কেউ তুলতে পারবে না। কারণ, ইহুদি লেখক নরম্যান ফিংকেস্টে বলেছেন, ১৯৬৭ সালে বিশাল ফিলিস্তিনি ও সিরিয়ান ভূখণ্ড দখল করার পর ইসরাইলের পরামর্শকরা বর্ণবাদী ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের বিরোধিতাকে ইহুদি ধর্মবিরোধিতা বা অ্যান্টি-সেমেটিজিম বলে ব্যাপক প্রচার করে এবং এ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি-নির্যাতনকে পুঁজি হিসাবে ব্যবহার শুরু হয়।
ইসরাইলের মনমতো আমেরিকার চলাকে উন্মোচন করে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নন্দিত অধ্যাপক জন মিয়ার্শিমার ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক স্টিফেন ওয়াল্ট ‘The Israel Lobby & US Policy’ শীর্ষক একটি কিতাব রচনা করেছেন। এ কিতাবে দেখিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একেবারে বিনাস্বার্থে কম করে হলেও ৩.৮ বিলিয়ন ডলার ইসরাইলকে দেয় ইহুদি-লবির প্ররোচনায়, ইসরাইল আক্রান্ত-অসহায় এ বয়ানের ভিত্তিতে। লেখকদ্বয় বলেছেন, ইসরাইল সাহায্য পেতে পেতে ফুলেফেঁপে উঠেছে এবং এতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আর্থিক বা নিরাপত্তাজনিত লাভ হচ্ছে না।
২০০৬ সালে প্রকাশিত ‘The Ethnic Cleansing of Palestine’ শীর্ষক কিতাবে ইসরাইলের ইহুদি অধ্যাপক ইলান পাপ্পে ইহুদিবাদীদের মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ইসরাইল রাষ্ট্রের ‘বিসমিল্লায় গলদ’কে চিহ্নিত করেছেন। পাপ্পে বলেছেন, ১৯৪৮ সালে নীলনকশার মাধ্যমে ৭-৮ লাখ ফিলিস্তিনি আদিবাসীকে (যাদের অধিকাংশ মুসলমান এবং কিছু ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টানও আছে, যেমন এডওয়ার্ড সাঈদের মতো পরিবার) মেরে তাড়িয়ে দেয় ইউরোপ থেকে বিতাড়িত ইহুদিরা। এ সময় ৫ শতাধিক ফিলিস্তিনি গ্রামে জাতিনির্মূলের উদ্দেশ্যে গণহত্যা চালায় ‘হলোকস্ট ব্যবসায়ী’ ইহুদিরা।
মানে বুঝেছেন? তারা অতীতে হলোকস্টের শিকার হয়ে ইউরোপ-আমেরিকার সহায়তা নিয়ে নিজেরাই আরও বড় ও ধারাবাহিক হলোকস্ট ঘটাচ্ছে! আর তা নিয়ে পশ্চিমের মিডিয়ায় প্রশ্নই নেই!
ইসরাইল মূলত একটি উপনিবেশবাদী অবৈধ রাষ্ট্র, যা ভূমিপুত্রদের জীবন ও সম্পদ লুটে গড়ে উঠেছে। সাঈদের ‘ফিলিস্তিন প্রশ্ন’ তো পশ্চিমা শিক্ষাসমাজে আজও পাঠ্য হয়ে ইসরাইলের দখলদারত্বের পরিচায়ক হয়ে উঠেছে। নেলসন ম্যান্ডেলা ফিলিস্তিনিদের মুক্তিসংগ্রামকে কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তির লড়াই হিসাবেই দেখেছেন। এত সব বলার কারণ-পৃথিবীর প্রতিটি বয়ান ও আলোচনায় ফিলিস্তিনিরা মজলুম। তাদের স্বাধীনতা হরণ করছে পশ্চিমাদের সহায়তায় শ্বেতাঙ্গ ইহুদিরা। সেই মজলুমকে কেন পশ্চিমা স্বাধীনতা ব্যবসায়ীরা ভুলে গেল? ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জালিমের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাদের সমর্থনে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ হলো এবং সহস্রাধিক ফিলিস্তিনির জীবন গেল? জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদই অনিরাপত্তার ধ্বজাধারী হয়ে উঠল!
এ মজলুম বা নিপীড়িত ফিলিস্তিনিরা পশ্চিমা মিডিয়ায় কখনোই ভূমিপুত্র বা আদিবাসীরূপে আসে না। এ আধুনিক যুগেও প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে মজলুম শরণার্থীদের খাদ্য-পানি না দিয়ে, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে, স্থল, নৌ ও আকাশপথ অবরুদ্ধ করে নিরস্ত্র শিশু, বয়োবৃদ্ধ, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে গণহত্যা চালাচ্ছে একটি কথিত ‘রাইট টু ডিফেন্ড ব্যবসায়ী আক্রান্ত রাষ্ট্র’। এ কারণে ফিলিস্তিনের পক্ষে গণবয়ান নির্মাণের কোনো এজেন্ডা পশ্চিমা মিডিয়া নেয় না। তাদের নেওয়ার সক্ষমতায় লাগাম টেনে দেয় প্রভাবশালী ইহুদি বলয়। গাজা, পশ্চিমতীর, পূর্ব জেরুসালেম, রামাল্লা, নাবলুসে প্রতিদিন ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে অবৈধ ইসরাইল। ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি-জমি-ফসল দখল ও লুট করছে; কিন্তু পশ্চিমা গণমাধ্যমে এ সংবাদকে ফ্রেমিং করে, প্রাইমিং করে সামনে এনে ইসরাইলের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার কোনো চেষ্টা দেখা যায় না।
গাজায় অমানবিক অত্যাচারের শিকার ফিলিস্তিনিরা যখন গৃহে নির্মিত অস্ত্র দিয়ে পালটা জবাব দিল; ফ্রানৎস ফানোঁর মতে, দুনিয়ার নিকৃষ্ট ঔপনিবেশিক শোষকদের বিরুদ্ধে বিপ্লব করল; তখন দখলদার ইহুদিরা সংবাদমাধ্যমের ‘যোগ্য আক্রান্ত’ হয়ে উঠল। কিন্তু ফিলিস্তিনি মজলুমের প্রতিরোধ লড়াইটি ইতিবাচকভাবে চিত্রিত হলো না। এটিই মজলুমকে খলনায়ক বানানোর তাত্ত্বিক কাঠামো, যা ইহুদিবাদী গণমাধ্যম অনুসরণ করে যাচ্ছে।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে হামাস বা ফিলিস্তিনিদের ব্যাপকভাবে দানবায়ন (Dehumanize) করা হলো, বা এখনো হচ্ছে। যে শব্দগুলো হিটলার ইহুদি নিধনের আগে ব্যবহার করেছিল বা রুয়ান্ডার গণহত্যায় ব্যবহৃত হয়েছিল, সেগুলো দখলদাররা ব্যবহার করছিল ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে। যেমন, ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ফিলিস্তিনিদের Human animals বলে মানুষ থেকে খারিজ করে তাদের হত্যা করাকে জায়েজ করে তোলে। অ্যান্টি-সেমিটিজম সংবেদনশীল পশ্চিমা মিডিয়া এ জাতি নিধনকারী শব্দের ব্যাপারে একবারও আপত্তি জানায়নি।
অর্থাৎ তাদের এজেন্ডায় ফিলিস্তিনিরা মোটেই আলোচনা, প্রচারণা বা বয়ানের ‘যোগ্য মজলুম’ নয় এবং ‘যোগ্য মজলুম’ হিসাবে তালিকাবদ্ধ ইসরাইলিদের কোনোভাবেই তারা জালিম হিসাবে তুলে ধরে গণমানসে ইসরাইলবিরোধী মানসিকতার জন্ম দেবে না।
ইহুদি অধ্যাপক নরম্যান ফিংকেলস্টেইনের মতে, ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলিদের আগ্রাসনের বলি হয়ে দাস-দাসী হয়ে গেছে এবং জালেমদের বিরুদ্ধে মজলুম দাসের বিদ্রোহ করার কেবল নৈতিক অধিকার রয়েছে তা নয়, বরং আন্তর্জাতিক সব আইন দ্বারা স্বীকৃত দাসবিপ্লব। তারপরও ১৯১৭ সালের অমানবিক বেলফোর ঘোষণার ফলে ১৯৪৮ সালে গণহত্যার মাধ্যমে অবৈধভাবে গঠিত জালেম রাষ্ট্রকাঠামোর চলমান নিপীড়ন ও মানবতাবিরোধী অপরাধকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে, যুদ্ধ থামাতে না বলে ‘Do you condemn Hamas?’ দিয়ে শুরু করা পশ্চিমা মিডিয়ার উদ্দেশ্য অডিয়েন্সের মন দখল করা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায় রাখতে পারবা না।’ বাঙালিরা মরতে শিখে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। ফিলিস্তিনিরাও নিশ্চয়ই জালিম ইসরাইলের অবরুদ্ধ কারাগার থেকে একদিন মুক্ত হয়ে পশ্চিমতীর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত মুক্ত পাখির মতো উড়বে। মরতে শেখা জাতির মুক্তিযুদ্ধ পুরো বিশ্বের জন্য প্রায়োগিক শিক্ষা, প্রজ্ঞাপূর্ণ দীক্ষা ও জীবন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়।
বি.দ্র. এটি কোনো মৌলিক লেখা নয়। এই লেখার তথ্যগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। সমস্ত সোর্স উল্লেখ করা সম্ভব নয়। এই লেখার আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো আমার কর্মস্থল ও আমাদের আড্ডা। আমি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের ইন্টারন্যাশনাল বিটে কাজ করি। প্রতিদিনই আমাকে এ সংক্রান্ত সংবাদগুলো বিভিন্ন মিডিয়া থেকে সংগ্রহ ও সম্প্রচার করতে হয়। এছাড়াও বন্ধু মোজাক্কির রিফাত, আদনান তুর্য, আমির মাহি বা ওস্তাদ নাজিব হায়দার ভাই ও সহকর্মী বড়ভাই ফারুক ভাইয়ের সাথে বিচিত্র আড্ডায় আমার যা শিক্ষা তা পুঁজি করেই এই লেখাটি লিখেছি। ভুলত্রুটি মার্জনীয়৷