পোস্টস

সমালোচনা

একটা অঞ্জনগ্রস্ত রাত

৩১ আগস্ট ২০২৪

জয় শাহরিয়ার

অঞ্জন দত্ত। একটা ঘোরের নাম। গত তিন দশকে বাংলা গানের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। অনেকদিন পর ঢাকায় কনসার্ট করলেন এই প্রথিতযশা সিঙ্গার, সংরাইটার। এবছর শুরুর দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন, তবে তা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না। মাঝে এসেছিলেন নিজের বইয়ের প্রকাশনা ও মঞ্চ নাটক নিয়ে। তখন প্রথম অঞ্জনকে মঞ্চে অভিনেতা হিসেবে দেখার সুযোগ হয়েছিল। তবে টিকেট কেটে অঞ্জনের গান শোনার সুযোগ ঢাকার শ্রোতারা পেল প্রায় বছর সাতেক পর। যদি স্মৃতি প্রতারণা না করে তাহলে সর্বশেষ অঞ্জন দত্তের গান সরাসরি শুনেছিলাম ২০১৬ সালে ঢাকার কৃষিবিদ ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে। 


 

আমার স্কুল,কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বুঁদ হয়ে ছিলাম অঞ্জনের গানে। শুধু অঞ্জন বললে ভুল বলা হবে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে সুমন, নচিকেতা আর অঞ্জন ছিলেন আমার আর আমার মতোন অগুনতি বাঙালির প্রাণের শিল্পী। তাদের গানের কথা, সুরে ভেসেছি আমরা আর আমাদের শহর। তাই অনেকদিন পর অঞ্জন দত্তের গান সরাসরি শুনবো সেই ভাবনায় বেশ আচ্ছন্ন ছিলাম কনসার্টের আগে শেষ কটা দিন।


 

গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ঢাকার তেজগাঁওতে আলোকি সেন্টারে অঞ্জনের কনসার্ট আয়োজন করে 'কারখানা' নামের প্রতিষ্ঠান যার শিরোনাম ছিল 'অঞ্জন দত্ত লাইভ ইন মেট্রোপোলিস'। এই আয়োজনে আরও গান করেন এই শহরের তরুণ গানওয়ালা আহমেদ হাসান সানি।


 

বিকেল থেকেই ভিড় জমতে শুরু করে আলোকির সামনে। অনুষ্ঠানস্থলের পরিবেশ ছিল বেশ সুন্দর। বাইরে খোলা জায়গায় আড্ডা আর বিভিন্ন স্টলে খাবার খেয়ে দর্শক-শ্রোতারা সময় কাটিয়েছেন আনন্দে। 


 

অনুষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের আধঘন্টা পরে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় শুরু হয়। স্টেইজে আসেন এসময়ের শ্রোতাপ্রিয় বাংলাদেশি সিঙ্গার সংরাইটার আহমেদ হাসান সানি। তিনি গান শুরু করেন 'সব প্লাস্টিকের পুতুল' দিয়ে। এরপরে তিনি করেন 'গল্প না' গানটি। সানির তৃতীয় পরিবেশনা ছিল স্বপ্নজাল সিনেমায় ব্যবহৃত তার জনপ্রিয় গান 'আমারে উড়াইয়া দিয়ো'। হল ভর্তি শ্রোতারা গলা মেলান শিল্পীর সাথে তাদের প্রিয় গানে। অনুষ্ঠানের ভেন্যুটি আসলে গানের আয়োজনের জন্য আদর্শ নয়। যেটা আমাদের শহরের পুরোনো সমস্যা। এই মিলনায়তনের অ্যাকোস্টিক গানের আয়োজনের জন্য তৈরি নয় বলে সাউন্ড মনের মতো হবার কোনো উপায় নেই। সানি এরপর একে একে গেয়ে শোনান পথের পাথর, চিরকাল নবীন, কোক পেপসি, আনন্দ ভৈরবী, কে আর বাজাতে পারে, একটা পাতা গানগুলো। এর মাঝে চিরকাল নবীন গানটি সানি তৈরি করেছেন বব ডিলানের 'ফরেভার ইয়াং' গানটির ছায়ায়। সম্প্রতি সানি কাজ করছেন তার নতুন অ্যালবাম 'লুটপাট' নিয়ে। সেখান থেকে প্রকাশিত গান 'আমরা হয়তো' গাইবার সময় শ্রোতাদের ভালোবাসা প্রকাশ ছিল দেখার মতো। তারপর সানি একটি নতুন গান শোনান যার নাম 'অঞ্জনের জন্য গান'। এই আয়োজন উপলক্ষ্যে অঞ্জন দত্তকে উৎসর্গ করে গানটি করেন তিনি। সানির পরিবেশনা শেষ হয় তার সাম্প্রতিক জনপ্রিয় গান 'শহরের দুইটা গান' দিয়ে। সব মিলিয়ের সানির পরিবেশনা ছিল বেশ গোছালো এবং সুন্দর। গিটার, বেইস, কী-বোর্ড, ড্রামসের সাথে এস্রাজ, মাউথ অর্গানের সমন্বয় বেশ বৈচিত্র এনেছে গানের সঙ্গীতায়োজনে। সানির গায়কি আর পরিবেশনা ছিল সপ্রতিভ। এই সময়ের একজন বাংলাদেশি গানওয়ালার গানে শ্রোতাদের যে অংশগ্রহণ তা সত্যি আশা জাগানিয়া। আয়োজকদের ধন্যবাদ এমন একটা আয়োজনে অঞ্জন দত্তের মতোন স্বপ্নের শিল্পীর সাথে এক মঞ্চে বাংলাদেশের একজন তরুণ শিল্পীকে স্থান দেবার জন্য। আমাদের গানের জগতে আমরা যারা গান লিখে, সুর করে নিজেরাই গাই তারা বেশ একা। সবার মাঝে থেকেও আমরা একা থাকি। এই সময়ে সেই একা থাকা শিল্পীদের মাঝে যাদের গান আমার খুব পছন্দ সানি তাদের একজন। তাই সানির এই প্রাপ্তি আমার জন্য দারুণ ভালো লাগার। 


 

এবার মূল পর্বের অপেক্ষা। বিশ মিনিটের একটি বিরতি দেয়া হয় সানির গানের পর। এর মাঝে ফুড কোর্ট থেকে পেট পূজো সেরে নেই আমি ও আমার সঙ্গীরা। যেটা আগেই বলেছি, কনসার্টের জন্য সাউন্ড ভালো না হলেও পুরো আয়োজনের পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা ছিল বেশ সুন্দর।


 

'আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়

একটু বর্ষা, একটু গ্রীষ্ম, একটুখানি শীত

সেই একটুখানি চৌকোছবি আঁকড়ে ধরে রাখি

আমার জানলা দিয়ে আমার পৃথিবী।'


 

'পুরোনো গিটার' অ্যালবামের এই গান দিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম অঞ্জনের গানের পৃথিবীতে। শুধু অঞ্জনের কি? এই গানের পৃথিবী তো আসলে আমারও। এরপর অঞ্জন গাইলেন 'হ্যালো বাংলাদেশ' গানটি। এই গান বাংলাদেশ থেকে অঞ্জনের প্রকাশিত প্রথম অ্যালবাম 'হ্যালো বাংলাদেশ'-এর শিরোনাম সংগীত। যখনই গানে হ্যালো বাংলাদেশ বলছিলেন শিল্পী তখনই দর্শকদের বিপুল চিৎকার যেন স্বাগতম জানালো একাত্তর বছর বয়সী এই বাংলা গানের ফেরিওয়ালাকে।

 

 

আমার কাছে দার্জিলিং মানে অঞ্জন দত্ত। আমি দার্জিলিং চিনেছি অঞ্জনের গানে। মনে মনে আঁকা সেই ছবির কাছে সম্প্রতি গিয়েছিলামও। এবার অঞ্জন গাইলেন তার গান 'দার্জিলিং'। অঞ্জনের গান আর সিনেমায় দার্জিলিং-এর যে ছবি আঁকা তা সত্যি অনবদ্য। অঞ্জনের গানে আরো এসেছে কোলকাতার অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের কথা। সেই ধারাবাহিকতায় পরপর দুটো গানের চরিত্র তেমন দুজন, মি. হল আর ম্যারি অ্যান। আমার মনে আছে কলেজ জীবনে প্রচুর অনুষ্ঠানে আমি গাইতাম 'ম্যারি অ্যান'। আবার অনেকদিন পর গাইলাম অঞ্জনের সাথে সেই গান। এখনো পুরো লিরিক মনে আছে সেটা অনুধাবন করলাম গাইতে গাইতে। এবার অঞ্জন ধরলেন দশ বছর বয়সী আলীবাবার গান। তারপর নিলেন একটা ছোট্ট বিরতি। তবে গানের বিরতি পড়েনি। অঞ্জন দত্তের ছেলে, গিটারিস্ট, সংগীত পরিচালক নীল দত্ত গাইলেন তার গান 'মাঝিরে'। এই গানে নিজের জাত আরেকবার চেনালেন এই উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গিটারিস্ট অমিত দত্ত। পুরো অনুষ্ঠানেই অসাধারণ ছিল তার গিটারবাদন যার দারুণ উদাহরণ ছিল এই গান। মাঝিরে গানের পর ব্যান্ডের বাকিরা নিলেন একটা ছোট বিরতি। কিন্তু এবারো থামেনি গান। এবার স্টেইজে ছিলেন শুধু অঞ্জন আর তার গিটার। গাইলেন 'কাঞ্চনজঙ্ঘা'। ভেসে গেলাম কাঞ্চনের কথা আর সুরে। চোখ বন্ধ করে দেখে নিলাম পুরো গানের চিত্রায়ন। গান জীবনের এত কাছাকাছি যেতে পারে তা এই গান না শুনলে বোঝা যাবে না। এইযে একটা ঘোরের মাঝে ঢুকে গেলাম সেটা থেকে বেরোবার আগেই পুরো মিলনায়তন উন্মাতাল হয়ে উঠলো। সবাই মিলে ঘোষণা দিয়ে দিল 'রঞ্জনা আমি আর আসবো না'। তারপর আবারও নীল দত্তের পালা। অঞ্জনের সিনেমা 'আমি আসবো ফিরে'-এর শিরোনাম সংগীত গাইলেন তিনি। 


 

আবার এলো অঞ্জনের পালা। বাংলাদেশ তার বেশ কিছু গানে এসেছে। তেমনই এক গান 'বেইলী রোড'। এই গানে সাবিনা-রুবিনাদের কথা বলে অঞ্জন চলে গেলেন মালার কাছে। আসলে কে এই মালা? যে ১২ই মে চলে গিয়েছিল। আসলেই কি ইমরান খান দমদমে নামলে তার সাথে কফি খেতেন? এই প্রশ্নের উত্তর পাবার আগেই ২৪৪১১৩৯-এ কল করলেন শিল্পী। বেলা বোসকে ডেকে আবারো ভেসে গেল পুরো মিলনায়তন। তারপর আমরা সবাই দেখা পেলাম অঞ্জনের গানে নতুন চরিত্র বিদিশার। তিনি ঘোষণা দিলেন আগামী ডিসেম্বরে বাংলাদেশের একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থেকে আসবে তার নতুন ওয়েব সিরিজ। সেই সিরিজের একদম নতুন গান 'বিদিশা' শোনালেন তিনি। এরপরের গান 'এখনো তাই'। এই গানটিও প্রকাশ পেয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। তারপর আবার নীল দত্ত গাইলেন তার গান 'তানিয়া'। গানে গানে অনেকটা সময় কাটলো। বাড়ি ফেরার আগে শেষ গান গাইলেন অঞ্জন, 'তুমি আসবে বলে তাই'। আসলেও কি আসবে সুদিন? সেই সুদিনের প্রত্যাশায় বিদায় নিলেন অঞ্জন দত্ত এবারের মতোন। আসলেও কি বিদায় নিতে পারেন তিনি? পারেন না। কারণ গানে গানে গুনগুনিয়ে অঞ্জন থাকেন সারাক্ষণ আমাদের সাথে।


 

পুরো পরিবেশনায় অঞ্জন দত্তের সাথে লিড গিটারে ছিলেন অমিত দত্ত, রিদম গিটারে নীল দত্ত, বেইস গিটারে প্রশান্ত এবং ড্রামসে দেবপ্রতিম। পুরো ব্যান্ডের পরিবেশনা ছিল অসাধারণ। একাত্তর বছর বয়সে এসে প্রায় দুঘন্টা এভাবে গান গাওয়া সোজা ব্যাপার নয়। কিন্তু সেই কঠিন কাজটিই অঞ্জন দত্ত করলেন অনায়াসে। 

 

 

অঞ্জন আর নীল মিলে গান গেয়েছেন ১৭টি। তবুও কত প্রিয় গান শোনা হলো না। 'বৃষ্টি', 'একদিন বৃষ্টিতে', 'চ্যাপ্টা গোলাপ ফুল', 'পুরোনো গিটার', 'জেরেমির বেহালা'সহ কত কত গান। এটাই প্রমাণ করে অঞ্জন দত্তের বিশালতা। তিরিশ বছরের ক্যারিয়ারে অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন তিনি। সেইসব গান শুনেই আমার মতো গানওয়ালারা তৈরি হয়েছে, হচ্ছে দুই বাংলায়। কৃতজ্ঞতা অঞ্জন দত্তের প্রতি আমাকে একটা সুরেলা কৈশোর দেবার জন্য। গানে গানে গাইয়ে হয়ে ওঠার অনুপ্রেরণা হবার জন্য।

 

 

অপেক্ষায় থাকলাম আবারও সরাসরি অঞ্জনের গানে বুঁদ হবার জন্য। সে পর্যন্ত হৃদয়ে গেঁথে থাকুক একটা অঞ্জনগ্রস্ত রাত।


 

১ অক্টোবর ২০২৩