পোস্টস

চিন্তা

নির্বাচনী রোডম্যাপ ও বিএনপির এইসময়ের রাজনীতি

৩১ আগস্ট ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

তিপ্পান্ন বছর পেরিয়ে এসেও বাংলাদেশ সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য টেকসই গণতন্ত্রের দেখা পেল না। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাওয়া একটা দেশকে এতসব ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে এমনটা কেউ ভাবতে পারেনি। এখানে শক্তিশালী ও স্বাধীন নির্বাচনী সংস্থা কোনো শাসক গড়ে তুলেনি, যেই সংস্থাকে চোখ বন্ধ করে সবাই বিশ্বাস করবে। একদলীয় বাকশাল, সেনাশাসন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, রাতের ভোট, ডামি নির্বাচন -কীসব বিচিত্র ও বিভ্রান্তিকর পদ্ধতিতে দেশ চলেছে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাওয়া বাহাত্তরের সংবিধান কেউ মানেনি। কারো মধ্যে ওই সংবিধানে মান্যতা দেয়ার আগ্রহও দেখা যায়নি।

এর আগে অনেকবার সংবিধান স্থগিত হয়েছে, মনের মাধুরী মিশিয়ে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। ২০২৪ এর জুলাই বিপ্লবের পর বিপ্লবীদের অভীপ্সা অনুযায়ী সংবিধান পুনর্গঠনের দাবি উঠছে আরেকবার। কালের পরিক্রমায় শান্তিতে নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুনমাত্রিক ইন্টেরিম তথা অন্তর্বর্তী সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর নিয়মে সেনাবাহিনী এই সরকারকেও সর্বোত সাপোর্ট দিচ্ছে। সবাইকে আবার ভাবতে হচ্ছে অধরা গণতন্ত্রের দেখা কি জনগণ আদৌ পাবে?

২০০১ সালে নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিএনপি। সেসময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে সংবিধানে একটি বড় সংশোধনী আনে বিএনপি সরকার। অভিযোগ রয়েছে, নিজেদের পছন্দের প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে পাওয়ার জন্য এই কাজ করেছিল বিএনপি সরকার। এর উদ্দেশ্য ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজেদের কব্জায় রেখে নির্বাচনের সময় সুবিধা আদায় করা।

বিবিসি বাংলা জানাচ্ছে, ওই সংশোধনীর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। সংঘাতময় এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। জারী করা হয় জরুরী অবস্থা। ফখরুদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন। সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ ওই সরকারকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে থাকেন।

ওই সরকারের দুই বছর শাসনকাল শেষে ২০০৮ এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হয়। বিএনপি নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। ওই সময় ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ লিখেছিল, 'অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে নির্বাচনে যারা ব্যাপক জয় পেয়েছে, তারা সরকার গঠনের পর অগণতান্ত্রিক আচরণ করেছে এবং ভিন্নমত দমন করেছে। আমরা শুধু আশা করি, আওয়ামী লীগ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবে।'

আওয়ামী লীগ অতীত থেকে ছিটেফোঁটাও শিক্ষা নেয়নি। নিজেরা ওয়ান থার্ড মেজরিটি পেয়ে পরের ১৫ বছর বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নির্বাচনী মাঠ থেকে বিতাড়িত করে গায়ের জোরে দেশ শাসন করেছে। আকন্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থেকেছে। রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাট করেছে। ধ্বংস করেছে দেশের সকল সিস্টেম। এর ফলাফল সামান্য কোটা আন্দোলনকে বেসিস করে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে দলবলসহ আওয়ামী লীগের লজ্জাকর পলায়ন। এমন পলায়নপর রাজনীতি এর আগে আর দেখা যায়নি।

বাংলাদেশে চারটে বড় দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী। বাকিরা এই দলগুলোরই লেজুড় অথবা তল্পিবাহক। গেল ১৫ বছর আওয়ামী লীগ তাদেরকে বড় দল দাবি করেছে। এখন ওই আওয়ামী লীগ মাঠে নেই। খুব স্বাভাবিকভাবেই অটোপাশের মতো নাম্বার ওয়ান দলের স্থান দখল করে নিয়েছে বিএনপি। জাতীয় পার্টি যেহেতু শেখ হাসিনার দোসর হিসেবে অনৈতিক ও নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের দোসর ছিল। তাই তারাও একধরনের বিতাড়নের মধ্যে পড়েছে। কার্যত চতুর্থ নাম্বারে থাকা জামায়াতে ইসলামী এখন দুই নাম্বার স্থান দখল করেছে। এখনকার এক আর দুই অতীতে সখ্যতাপূর্ণ গণতন্ত্র চর্চা করে ক্ষমতা ভাগাভাগি করলেও এবার এক আর দুইয়ে মিলছে না। গণ-আন্দোলনে শেষ সময়ে বিএনপি কর্মীরা কেন্দ্রের নির্দেশে মাঠ দখলে রাখলেও আওয়ামী লীগকে পরাজিত করায় বিএনপির দৃশ্যমান কোনো ক্রেডিট নেই, উপরন্তু ছাত্র-জনতার ব্যানারে জামায়াত-শিবিরের অগণিত ছেলেপুলে জুলাই বিপ্লবে মারা গেছেন; সেহেতু জামায়াতে ইসলামী এখন রাজনীতির মাঠে এক নাম্বার আসন দাবি করবার বিষয়টি আরেঠারে বুঝিয়ে দিচ্ছে। এমনকি প্রকাশ্য সভায় জামায়াতের আমির ঘোষণা দিচ্ছেন বিএনপির সাথে তারা এক প্ল্যাটফর্মে থেকে রাজনীতি বা নির্বাচনী দাবি আদায়ে নামবেন না। বরং নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশব্যাপী চলমান নেতিবাচক কার্যক্রমের ৮০ ভাগ দায় বিএনপির ওপর চাপিয়ে দিয়েছে তারা। যদিও বিএনপি বিষয়টি অস্বীকার করেছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার নির্দিষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ কখন ঘোষণা করবেন এটা নিয়েও বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন দেখা যাচ্ছে। যদিও নির্বাচন অনুষ্ঠান ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় আরোহনের সুযোগ নেই।

২০০৮ এর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ নিজেদেরকে বড় দল গণ্য করত। এর পরিসংখ্যানগত কারণও ছিল। সিইসি এটিএম শামসুল হুদা কমিশনের হিসেব অনুযায়ী ২০০৮ সালের সাধারন নির্বাচনে ৮৬.২৯ শতাংশ ভোট পড়েছিল।

রয়টার্সের তথ্যমতে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৩০টি আসন। অন্যদিকে বিএনপি পেয়েছিল মাত্র ৩০টি আসন। শুধু তাই নয়, প্রাপ্ত ভোটের হারের ক্ষেত্রে ছিল বিশাল ফারাক। আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪৮.১৩ শতাংশ ভোট এবং বিএনপি পেয়েছিল ৩২.৪৯ শতাংশ ভোট।
সে নির্বাচনে দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভরাডুবি হয়েছিল জামায়াতে ইসলামীর। চারদলীয় জোটের শরীক হিসেবে ৩৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র দুটি আসনে জয়লাভ করেছিল দলটি। এছাড়া ভোট পেয়েছিল ৪.৬০ শতাংশ।

২০১৪ থেকে-২০২৪ পর্যন্ত দেশে কোনো‌ বিশ্বাসযোগ্য ভোট অনুষ্ঠিত হয়নি। কাজেই এই সময়টায় কার ভোট কমেছে বা বেড়েছে সেই পরিসংখ্যান দেয়া সম্ভব নয়। ঠিক এই এইসময় গণ-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার জয়জয়কার বা জোয়ার দেখতে পাচ্ছি। এদের কতভাগ বিএনপি আর কতভাগ জামায়াত সেই পরিসংখ্যান নিশ্চিত করে বলবার জো নেই।

তবে রাজনীতির মাঠ, প্রশাসন, বিচারালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রেমিজে আমরা জামায়াত ও তাদের ছাত্র সংগঠন শিবিরের সরব উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছি। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রসমাজ, শিবির ও ছাত্রদলের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ত্রিমাত্রিক সংঘর্ষের খবরও আসছে।

মোটকথা হলো আওয়ামী লীগের অনুপস্থিততে সরকারে যেতে যারা উদগ্রীব তাদের মধ্যেই নানা বিষয়ে মতানৈক্য দেখা যাচ্ছে। অসঙ্কোচ ও নিঃসন্দেহে বলা যায় চলতি ইন্টেরিম গভমেন্টে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রসমাজ তাদের আধিপত্য ধরে রেখেছে। কিন্তু সরকারি সিস্টেমে বিএনপি ও জামায়াতের অংশীদারিত্ব থাকছে প্রায় সমান্তরালে। তারপরও অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ভোটের দাবিতে বিএনপি-জামায়াত এক হতে পারছে না। জামায়াত যেখানে সংস্কারের জন্য ইউনূস সরকারকে যথেষ্ট সময় দিতে আগ্রহী, বিএনপি সেখানে বলছে যৌক্তিক সময়ের কথা। যদিও প্রথমদিকে তারা তিনমাসের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছিল।

গেল ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি নির্যাতন সয়েছে বিএনপি অ্যাক্টিভিস্টরা। কারণ তারা যতবার ন্যায্য নির্বাচন চেয়েছে আওয়ামী লীগের কাছে, ততবারই মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন তারা। যেহেতু জামায়াতের চেয়ে বিএনপির জনসমর্থন বেশি মনে করছে তারা, ওই কারণেই গণতন্ত্র যাতে বেহাত ও প্রলম্বিত না হয় সেই ব্যাপারটিতে কড়া নজর রাখছে তারা। বিশ্বসমাজ মেনে নিলেও, আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাধুবাদ জানালেও ২০০৮ সালের নির্বাচনী ফলাফল বিএনপি মেনে নেয়নি। এ কারণেই তাদের সন্দেহ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও কি বিএনপির ক্ষমতার ন্যায্য হিস্যা বুঝিয়ে দেবে না?

আমরা মনে করি বিএনপি অতীত অভিজ্ঞতা থেকে যেহেতু সন্দেহ জিইয়ে রেখেছে, সেহেতু তারা আরেকটু প্রখর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখাতে পারত। জামায়াত ইসলামী বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে বা নীতির বিরোধিতা করবে এমন সুযোগ‌‌ জামায়াতকে দেয়া তাদের উচিত হয়নি। আওয়ামী লীগাররা সহসাই রাজনৈতিক মাঠে ফিরতে পারবে না। সেকারণে তাড়াহুড়ো না করে ধীরেসুস্থে মাঠ গোছানোর কাজ শুরু করা উচিত ছিল বিএনপির। প্রায় একমাসে যতটুকু হিতবাদী ও উদারনৈতিক রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ড. শফিকুর রহমান দেখাতে পেরেছেন তার ধারেকাছেও বিএনপি নেই। এমনকি বন্যার মতো এত বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ তৎপরতায় জামায়াতের চেয়ে বিএনপি পিছিয়ে ছিল। গণ-আন্দোলনে আহত-নিহতদের খোঁজখবরও জামায়াতই বেশি নিয়েছে।

বিএনপিকে ক্ষমতায় ফিরতে হলে কয়েকটি শক্তির মোকাবিলা করতে হবে তাদের। অন্তর্বর্তী সরকারের বাধা, এই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বৈষম্য বিরোধীদের দ্বারা গঠিত নতুন কোনো দল, জামায়াতে ইসলামী এবং আওয়ামী লীগের ফেলে যাওয়া ছায়া সিস্টেম। এতগুলো প্রতিবন্ধকতা পেরোনোর মতো রাজনৈতিক কৌশল, নৈতিকমান, সত্যিকারের গণতন্ত্রে ফিরবার সদিচ্ছা এবং জনহিতকর কোনো কার্যকরণ বিএনপির আছে কিনা সেটা তাদেরকেই ভেবে দেখতে হবে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া পরাজিতদের প্রতি প্রতিহিংসা না দেখিয়ে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে বলেছিলেন -তেমনটা আমরা দেখতে পাইনি। বিএনপিকে দিশা খুঁজে নিতে হবে তারা ধর্মভিত্তিক জামায়াতে ইসলামীর কাছে দেশের দায়িত্বভার তুলে দেবে, নাকি উদার গণতান্ত্রিক নিজেরাই বাংলাদেশের পাওয়ার বুঝে নেবে।

বাংলাদেশে না চাইতে কেউ কিছু দেয় না। কাজেই যথাসময়ে নির্বাচনী রোডম্যাপ চাইতে হবে এবং বিএনপিকে অতি অবশ্যই মনে রাখতে হবে সামনের নির্বাচনও সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও নিরঙ্কুশ গ্রহণযোগ্যতা পেতে হবে। অন্যথায় অধরা গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশিদের ক্রন্দন কখনো থামবে না। 
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের বক্তব্যটা বিএনপি মনে রাখতে পারে, 'গণতন্ত্রের প্রতি চূড়ান্ত প্রতিশ্রুতি এবং বিশ্বস্ততা নির্ভর করছে জনগণের রায়কে পরাজিত পক্ষের মেনে নেবার উপর।'

লেখক: সাংবাদিক
৩০ আগস্ট ২০২৪