পোস্টস

চিন্তা

এত রাগ শিক্ষকের প্রতি কেন?

৩১ আগস্ট ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

গেল ১৫ বছর দেশে আইনের শাসন বলে কিছু ছিল না। সেজন্যই আমাদের ছাত্র-জনতা গণ-আন্দোলনে দুর্মর দুঃশাসনকে টাটা বাই বাই বলে দিয়েছে। লুটেরাদের কেউ পালিয়েছে। কেউবা আইনের হাতে ধরা পড়ছে। মোদ্দা কথা হলো গেল ৫ আগস্টের পর দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাহলে এখন কেন একশ্রেণীর শিক্ষককে গলায় জুতোর মালা পরতে হচ্ছে, চপেটাঘাত খেতে হচ্ছে, জোরজবরদস্তির চাপ সামলাতে না পেরে স্ট্রোকে মারা যেতে হচ্ছে? 

ধরে নিচ্ছি, যাদের প্রতি আমাদের সমন্বিত ক্ষোভ সঞ্চিত ছিল এতদিন, কিন্তু নানামুখী চাপ ও ভয়ে বলতে পারিনি। এখন কথা বলবার স্বাধীনতা ফিরে এসেছে। আমরা বলব, জোরদার প্রতিবাদ করব। কিন্তু তাই বলে আইনকে নিজের হাতে তুলে নেব কেন? ভাল মন্দ যাই হোক শিক্ষক তো? এক অক্ষর হলেও পড়িয়েছেন তো? ওই পড়াবার গুরু দক্ষিণা হিসেবেই শিক্ষককে অসম্মানের হাত থেকে বাঁচানো যায় না? যাচ্ছেতাই করা, গায়ে হাত তোলা, গলায় জুতোর মালা পরিয়ে এলাকায় ঘুরানো, জোরজবরদস্তিতে পদত্যাগ করাতে গিয়ে প্রাণসংশয়ে ফেলে দেয়া বড় অমানবিকতা। আমরা সভ্য মানুষ হবো, হিতবাদী হবো, দেশকে নতুন সূর্যালোকে আলোকিত করব এমন ব্রত নিয়েই তো জানবাজি রেখে জুলাই বিপ্লবে শামিল হয়েছিলাম। তাই না?

মানছি অনেক শিক্ষক জুলুম করেছে। অন্যায্যতা দেখিয়েছে। দলদাস হয়ে ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি চর্চা করতে গিয়ে ক্লাস-পরীক্ষায় মন দেননি। অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে নারী নিপীড়নের অভিযোগও আছে। কেউ কেউ দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন। স্টুডেন্টদের কাছ থেকে বেহুদা ফি আদায় করে নিজেদের পকেট ভারী করেছেন অনেকে। কেউ কেউ পিতা বা দাদার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ ব্যবহার করে চরম অযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকতার চাকরি বাগিয়েছেন। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ জাল সনদের ডিগ্রিধারী হয়ে বাটপারি করা। কেউ আছেন এক অক্ষরও পড়ানোর সক্ষমতা রাখেন না, কিন্তু হেডম দেখান স্কুল বা কলেজের হর্তাকর্তা তারাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে একশ্রেণীর লালসার দাস শিক্ষক আছেন যারা ছাত্রীদেরকে বিশেষ সুযোগ দেন বিশেষ সেবার বিনিময়ে। স্কুল-কলেজে এমন শিক্ষক আছেন যাদের কাছে বাধ্যতামূলক প্রাইভেট না পড়লে এবং হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটিং-এ ইনটেনশনাল সঙ্গ না দিলে পরীক্ষায় ফেল করাবার হুমকিতে রাখেন।

যতগুলো অভিযোগ লিখলাম এর কোনোটাই শিক্ষকতা পেশার সাথে যায় না। শিক্ষক হবেন জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান, ত্যাগী, সেবাপরায়ণ, চরম সৎ, নির্লোভ, ছাত্র অন্তপ্রাণ, পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী, সুসভ্য ও বিশুদ্ধ সংস্কৃতিবান। যাদেরকে নিয়ে আমরা কবি কাজী কাদের নেওয়াজের মতো করে গর্বভরে বলতে পারব, 'আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির'! এর বাইরে যারা থাকবেন তাদের শিক্ষকতা পেশায় না আসা উচিত। কারণ এটা মোটেও যেনতেন দায়সারা গোছের চাকরি নয়। শিক্ষকতা মানে মানবহিতৈষা, সেবা এবং সমাজ সংস্কারের নিষ্ঠ ও নিবিষ্ট ব্রতচারিতা।

তাহলে যারা শিক্ষক নামের কলঙ্ক, তাদের বিরুদ্ধে আমরা কী ব্যবস্থা নেব? সব কথার এক কথা তাদেরকে রাষ্ট্রে প্রচলিত আইনের হাতে সোপর্দ করব। কোনো মতেই কারো গায়ে হাত তুলবার অধিকার আমাদের নেই। বৈশ্বিক রুলস এন্ড রেগুলেশন এটা সাপোর্ট করে না। নিজের বিবেক ও বোধ দিয়েও এটা কিছুতেই জাস্টিফাই করা যাবে না।

আজকাল আমরা যা করছি, নিমিষেই তা ভিডিও আকারে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কর্মকাণ্ডে যদি এমনটা হয় একসময় দেখা গেল বিশ্বের বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাদের দেশে অবস্থিত তারা আমাদের স্টুডেন্ট ভিসাই বন্ধ করে দিল, সেটা কি আমাদের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য ভালো হবে?

আমরা তো জানিই বিগত বছরগুলোতে বিশেষকরে সরকারি প্রতিষ্ঠানে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে দলীয় লেজুড়বৃত্তি, মামা খালুর কানেকশন, অবৈধ অর্থের জোর আর ফাঁস করে দেয়া প্রশ্ন কিনবার সামর্থ্যের ওপর কর্মী নিয়োগ হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগেও একই অবস্থা বিরাজমান ছিল। বহু শিক্ষকদের আমরা দেখেছি সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেও আওয়ামী লীগের দলীয় পদ বজায় রাখতে। দলের কানেকশন ব্যবহার করে অসাধুতা করতে। এমন এক বাস্তবতাতেও অন্যান্য কর্মীদের মতো অনেক শিক্ষকও নিশ্চয়ই মেধার বেসিসে নিয়োগ পেয়েছেন। তারা বাদে বাকিদের প্রতি সংক্ষুদ্ধ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু বড় বেখাপ্পা ব্যাপার হচ্ছে নিজেরাই জাজমেন্টাল হয়ে যাওয়া।

বিচারক মানিকের মতো মানুষেরা যত বড় অপরাধীই হোক আদালত প্রাঙ্গণে আমরা যেমন লাথি দিয়ে তার pouch ফাটিয়ে দিতে পারি না। তেমনি কোনো শিক্ষককে বিদ্যালয়ের মতো পবিত্র অঙ্গনে কান ধরে উঠবস করাতে পারি না। মনে রাখতে হবে একজন অপরাধীরও সন্তান ও পরিবার আছে। একজনের অপরাধে তার পরিবারকে আমরা সমাজের কাছে হেয় করতে পারি না। একজন দাগী অপরাধীরও আইনী সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে। এটাই সভ্যতা। এটাই মানুষের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, পারিবারিক দায়বদ্ধতা।

আমরা আমাদের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে দোষীকে দোষী বলব, প্রতিবাদ করব, প্রতিকার চাইব। সেটা যেন হয় রাষ্ট্রীয় আইনী কাঠামোর ভিতরে থেকে।

যে সুবর্ণ শিক্ষার্থীরা ঘৃণ্য ফেসিজম ঘুচিয়ে নতুন দিন আনতে পারে। যে সন্তানেরা বুকের তাজা রক্তে দেশের মুক্তি এনে দিতে পারে। যারা চিনিয়ে দিতে পারে মানুষের স্বাধীনতা কাকে বলে। সেই তারা কাউকে অসম্মান করবে, অপদস্থ করবে -এমনটা আমরা বিশ্বাস করব না। হে বিপ্লবী তোমাদের নাম ভাঙিয়ে কেউ যদি আইন ভাঙতে অতি উৎসাহ দেখায় তোমরা তাদেরকে ভালোবেসে সর্বমানুষে মায়া শেখাবে -এমনটাই তো প্রত্যাশা করি। তোমাদের যাকিছু ভালো সবটার সর্বোত জয় হোক। নিন্দার সামান্যতম আঁচও তোমাদের গায়ে না লাগুক।

লেখক: সাংবাদিক
৩১ আগস্ট ২০২৪