পোস্টস

চিন্তা

বস্ত্র শিল্প যার উপর দাঁড়িয়ে আমাদের অর্থনীতিঃ পর্ব ১

৩১ আগস্ট ২০২৪

Md. Rezaul Islam

মূল লেখক Md. Rezaul Islam

বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যা প্রায় ৮০০ কোটি। এই ৮০০ কোটি মানুষের ২য় মৌলিক উপাদান বস্ত্র। বস্ত্র ব্যাতিত কেউ ভদ্র সমাজ বা সভ্যতায় চলে পারেনি আর পারবেও না।

একটি পরিসংখ্যান দিয়ে শুরু করা যাক। ২০১৭ সালের জুলাই এবং আগস্ট মাসে আমাদের দেশের মোট রপ্তানি ছিল ৬৬২.৮৬ কোটি ডলার যার মধ্যে তৈরি পোশাক এবং হোম টেক্সটাইলেই  আয় যথাক্রমে ৫৫২.৪২ কোটি  ও ১৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ বস্ত্র  শিল্প আমাদের জন্য কতটা গুরুত্ব বহন করে সেটা  আমরা বুঝতেই পারছি। চলুন তবে কথা না বাড়িয়ে আলোচনা শুরু করা যাক। আলোচনাটা আমি কয়েকটি ভাগে ভাগ করব। প্রথম ভাগে থাকবে প্রাগ ঐতিহাসিক সময়ের বস্ত্র শিল্পের ইতিহাস, দ্বিতীয় ভাগে থাকবে আধুনিক সভ্যতা কবে থেকে বস্ত্র পরিধান শুরু করে, তৃতীয় ভাগে থাকবে আমাদের দেশে বস্ত্র শিল্পের বিস্তার ও বর্তমান অবস্থা।

প্রাগ ঐতিহাসিক সময়ের বস্ত্র শিল্পের ইতিহাসঃ

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় সেই আদিকাল থেকেই মানুষ বস্ত্র পরিধান করে আসছে। তাঁরা প্রথমে খাদ্যের জন্য শিকার করত। তাদের একতাই কাজ ছিল। খাদ্য সংগ্রহ। কিন্তু একটা সময় তাঁরা বস্ত্রের অভাব  অনুভব করা শিখল। তাঁদের মস্তিষ্কের বিকাশ হওয়ার সাথে সাথে তাঁরা বুঝতে শিখল তাঁদের বস্ত্র খুবই জরুরি। কিন্তু তাঁরা এটা ভেবে পাচ্ছিল না কিভাবে এই অভাবটা মিটাতে হবে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের ডেইলি মেইল পত্রিকা একটা রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপোর্টে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ইতিহাসবিদ ও গবেষক ডঃ ডেভিড রিড তাঁর দীর্ঘ গবেষণার পর দেখতে পান মানব সভ্যতা প্রায় ১,৭০,০০০ বছর পূর্বে বস্ত্র পরিধান করা শুরু করে। হ্যাঁ বস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা পুরনের জন্য তাঁরা গাছের বাকল,পাতা, পশুর চামড়া ইত্যাদি ব্যবহার করে নিজেদের শরীর ঢাকতে শুরু করে। এভাবেই মানব সভ্যতা প্রথম বস্ত্র সম্পর্কে ধারণা লাভ করে ।

আধুনিক সভ্যতার বস্ত্র পরিধানঃ

সময় যত বাড়তে থাকে মানব সভ্যতা তত আধুনিকতার দিকে ধাবিত হতে থাকে। জ্ঞানের পরিধি বাড়ার সাথে সাথে তাঁরা এই বস্ত্রকে নতুন নতুন  রুপে সাজাতে শুরু করে।  ডঃ ডেভিড রিডের মতে আধুনিক মানব সমাজ প্রায় ৭০,০০০ বছর পূর্বে পোশাক পরিধান করেন। তবে ৫,০০০ বছর পূর্বে বস্ত্র বা টেক্সটাইল শিল্প বিশ্ব ব্যাপি ব্যপক হারে বিস্তার করতে শুরু করে। এসময়ে ভারত,মিশর, চিন, মঙ্গোলিয়া, ইউরোপ ইত্যাদি দেশে বস্ত্র শিল্পের চাহিদা বাড়তে থাকে। রোমান সভ্যতা বিস্তারের সাথে সাথে ইউরোপে প্রচুর তুলা, লিলেন, লেদার কাপড়ের চাহিদা বাড়তে থাকে। এসময় সময় তাঁদের নিকট সবথেকে বেশি জনপ্রিয় ছিল সিল্ক কাপড়। যেতা তাঁরা লাকজারিয়াস লাইফের জন্য ব্যবহার করত। এই কাপড়ের প্রায় সবটুকুই তাঁরা চিন থেকে আমদানি করত। তখন চিন শবাশন করত হান রাজারা। যে পথটি ধরে ইউরোপ সিল্ক কাপড় আমদানি করত সেই পথের নাম দেয়া হয়েছিল সিল্ক রোড। যেটা ছিল চিন থেকে সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত আর আয়তন ছিল প্রায় ৪০০০ মেইল বা ৬৫০০ কিঃমি। বর্তমানে চিন সরকার এই পথটি পুনরায় চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এভাবে বস্ত্র শিল্প শতকের পর শতক পার করতে থাকে। প্রায় ১৫৫০ সালের দিকে আমাদের ভারত উপমহাদেশ বস্ত্র শিল্পের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়।  হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ইতিহাসবিদ অধ্যাপক জি উইলিয়াম তাঁর বই "India’s Deindustrialization in the 18th and 19th Centuries" তে উল্লেখ করেছেন সেই সময়ে সারা বিশ্বের প্রায় ২৫% বস্ত্র ভারত উপমহাদেশ একা প্রদান করত। মোঘোল রাজাদের সবাশনাধিন ভারত উপমহাদেশ সেই সময় ছিল বস্ত্রের জন্য  সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ টেক্সটাইল কারখানা, তুলার কারখানা এই উপমহাদেশে ছিল। বাংলার মসলিন কাপড় সেই সময়ে সারা বিশ্বের মন জয় করতে  পেরেছিল। শুধু তাই নয় বাংলার টেক্সটাইল শিল্প ডাচ ব্যবসায়ীদের দ্বারা ইউরোপে প্রায় ৫০ ভাগ টেক্সটাইল পন্য ও ৮০ ভাগ সিল্ক রপ্তানি করা শুরু করে। এশিয়ার প্রায় সকল স্থানে বাংলার টেক্সটাইল পন্য ছড়িয়ে যায় যেটা ঢাকা টেক্সটাইল নামে পরিচিতি লাভ করে।

 

বস্ত্র শিল্পে শিল্প বিপ্লবের ছোয়াঃ                     

 ১৭৫০-১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ। বিশ্বব্যাপী ছোঁয়া লাগে শিল্প বিপ্লবের। এই সময়কালে মানুষ কৃষি এবং বাণিজ্যিক ব্যবস্থা থেকে আধুনিক শিল্পায়নের দিকে ঝুকে পড়ে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর সমুদ্র যাত্রা বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের পথ খুলে দেয়।এরপর পুঁজিবাদের উদ্ভব, বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কার, কয়লার খনি আর ইস্পাতের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে অনেক শিল্প শহর আর কারখানা গড়ে উঠে। এই শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়া বস্ত্র বা টেক্সটাইল শিল্পেরও ভিত নাড়িয়ে দেয়। শিল্প বিপ্লবের সময়কালে কিছু বিখ্যাত টেক্সটাইল বিজ্ঞানীদের আগমন ঘটে। যারা এ শিল্পের আমুল পরিবর্তন ঘটান। তাও তাঁদের কথা না বললেই নয়। এদের মধ্যে অন্যতম ব্রিটেনে জম্ন নেয়া স্যার রিচারড। যিনি নিজেও ছিলেন একজন শিল্পপতি। তিনি “পাওয়ার ড্রাইভেন মেশিনারি ও এমপ্লয়মেন্ট অফ এ ফ্যাকটরি সিস্টেম অফ প্রডাকশন” সম্পর্কে নতুন তথ্য আবিস্কার করেন। যেটা প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি বহুগুন বাড়িয়ে দেয়। ব্রিটেনের আরও দুইজন বিখ্যাত বিজ্ঞানি ছিলেন। তাঁরা হলেন জন কি এবং জোসেফ সোয়ান যারা যথাক্রমে ফ্লাইং শাটেল লুম এবং সিংথেতিক ফাইবার আবিস্কার করেন। উইলিয়াম লি যিনি নিটেড মেশিন আবিস্কার করেন। ব্রিটেনের  উইলিয়ম হেনরি পেককিন। তিনি কুইনিন সংশ্লেষন করতে গিয়ে ব্যার্থ হন কিন্তু আবিস্কার করে ফেলেন এনিলিন ডাইজ ( অনিচ্ছাকৃত ভাবে)। ফ্রান্সের বিখ্যাত বিজ্ঞনি ছিলেন জোসেফ মারিয়ে জ্যাকার্ড। তিনি বস্ত্র শিল্পকে এক নতুন ধাপে নিয়ে যান। ১৮০০ সালের দিকে তিনি জ্যাকার্ড ম্যাশিন আবিস্কার করেন। যেটা সত্যিই ছিল এক যুগান্তকারী অবিস্কার। ইউরোপে নতুন নতুন উদ্ভাভোনি শক্তি ও চাহিদার ফলে সে সময়ে আমাদের ভারত উপমহাদেশও  এর প্রভাব ব্যপক হারে পরতে থাকে। পুরানো টেক্সটাইল ঐতিহ্যের জন্য এখানেও নতুন ধরনের কল কারখানা গড়তে শুরু করে। ধন্যবাদ।।

 

চলবে…………