পোস্টস

নন ফিকশন

মাকে মনে পড়ে

১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এস এম শাহনূর- কবি ও গবেষক

আমার শ্রদ্ধেয় পিতা মাতার সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
পিতার নাম: হাজী আব্দুল জব্বার বল্লভপুরী (রহ.)
[জন্ম ১৯২৮ ইং, মৃত্যু ৬ ডিসেম্বর ১৯৮৮ইং]
কসবা উপজেলার বল্লভপুর গ্রামে (প্রথম মুসলিম বসতি জিয়া খাঁ,মিয়া খাঁর ১৬৮০ এর পরবর্তী প্রজন্ম) নোয়াব আলী সরকারের ঔরসে জন্ম লাভ করেন। তিনি ছিলেন
-ছতুরা দরবার শরীফের পীর প্রফেসর আব্দুল খালেক (রহ.)র মাস্তান খেতাবে ভূষিত একনিষ্ঠ শিষ্য।বল্লভপুর কবরস্থানে মা বাবার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত। আমৃত্যু আপাদমস্তক ঘুমজাগানিয়া একজন ধর্ম প্রচারক ছিলেন। তিনি মাত্র ১৭ বছর বয়সে জাহাজে চড়ে হজ্জে বায়তুল্লাহর উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা ও মদীনা মুনাওয়ারাতে গমন করেন।জীবদ্দশায় বল্লভপুর কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠের জন্য জমি দান, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ নির্মাণে সার্বিক সহযোগিতা সহ বহু জনহিতকর কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।

মাতার নাম:
জাহানারা বেগম ফজিলাতুন্নেছা
বল্লভপুর গ্রামের শামসুল হক সোনা মিয়া হাজীর (১৯০৩-১৯৭৭,পুলিশের দারোগা ও গ্রামের প্রথম সরকারি চাকুরে) একমাত্র কন্যা।

[ত্রিপুরার ১৭৭তম মহারাজ শ্রী শ্রী বিরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য বাহাদুরের(রাজত্বকাল,১৯০৯ – ১৯২৩) রাজ দরবারের মুসলিম কাজী(১৯১০ থেকে ১৯১৬ পর্যন্ত) বহু ভাষাবিদ হযরত মাওলানা মাকসাদ আলী(১৮৪০-১৯১৬) বল্লভপুরী (রহ.) ওনার দাদা এবং মুবাল্লিক, বুজুর্গ ও সুফি সাধক শায়খুল বাঙ্গাল আলহাজ্ব ছৈয়দ আবু মাছাকিন গোলাম মতিউর রহমান লাহিন্দী আল কাদেরী (১৮৭৩-১৯৭৮) (রহ.) দুদু মিয়া পীর সাহেবের ভাতিজি।]

জন্মকাল:
১১ অগ্রহায়ণ ১৩৪৩ বাংলা, ১২ই রমজান,২৭/১১/১৯৩৬ ই রোজ শুক্রবার আছরের ওয়াক্তে জন্মগ্রহণ করেন।

➤ ৪ ফাল্গুন ১৩৬৩ বাংলা, ১৯৫৬ ইং রোজ রবিবার হাজী আব্দুল জব্বার এর সাথে আমার আম্মাজান জাহানারা বেগম এর শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়।

➤পরলোকগমন:
৭ মহরম ১৪৩২ হিজরি,
৩০ অগ্রহায়ণ ১৪১৭ বাংলা,
১৪ ডিসেম্বর ২০১০ ইং,
রোজ মঙ্গলবার ভোর ১২:৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 

 

[১] ‘যাও আর দেখা হবেনা’
জীবদ্দশায় এটিই ছিল আমার সাথে মায়ের শেষ কথা।
তবে মায়ের সাথে একদিন পর আমার আরো একবার দেখা হয়েছে। তখন তাঁর আত্মা আর ইহজগতে নেই। মাঝে মধ্যে এখনও মাকে স্বপ্নে দেখি। কথা বলি। ঘুমভাঙলে খুঁজে পাইনা!

২০১০ সালের ১৩ ডিসেম্বর সোমবার। দীর্ঘদিনের নানান জটিল উপসর্গ জনিত কারণে শয্যাশায়ী মা। তবে বেশি কাহিলও নয়।সকালবেলা নেইলকাটার দিয়ে হাতের নখ কেটে দিয়েছি। অল্প স্বল্প কথা বলেছি। একসময় বললাম, মা ছুটি শেষ, বিকালে কর্মস্থলের উদ্দেশে চলে যাবো। আমি বুঝতে পারলাম, এ কথা শুনেই শিশু বাচ্চার মত মন খারাপ হয়ে গেল মায়ের। দুধে আলতা গায়ের বরণ ও মুখশ্রী ছিল মায়ের।ফর্সা আকাশে যেন হঠাৎ কালো মেঘের ছায়া।

তখন আমার কর্মস্থল ছিল কাপ্তাই। ১৫ দিনের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি বল্লভপুরে।দুপুরের খাবার শেষে প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় গুছিয়ে মায়ের কাছে বসলাম।আমি চলে যাব তাই পরিবারের সবাই ঘরে জড়ো হতে লাগল।বড় মামা খন্দকার জামশেদ চেয়ারে বসে আছেন, অন্যান্যরা দাঁড়িয়ে।আমি মায়ের বিছানায় খাটে বসলাম। আমার দু হাতে মায়ের দুটো হাত ধরলাম। মায়ের চাঁদপানা মুখের দিকে অপলক চেয়ে থাকলাম।বুকে বিদায়ের বেদনা, ছলছল চোঁখে মাকে বললাম, নিয়মিত ঔষধ খেও,ভাল থেকো,আবার ছুটি নিয়ে আসবো। মা আমার সব কথার অর্থই বুঝতেন।এত তাড়াতাড়ি ছুটিও হবেনা আর তাড়াতাড়ি আসবোওনা।এটা তিনি ভাল করেই জানতেন। আমার দুটো হাত শক্ত করে ধরে দোয়া করলেন।হঠাৎ প্রবল অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিলেন,হাতও ছেড়ে দিলেন।বললেন,”যাও আর দেখা হবেনা”। আমি কিছুক্ষণ মায়ের পাশে বসে থাকলাম।দুচোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসলো। মায়ের কষ্টের কারণ বুঝতে আমারও কোনো অসুবিধা হয়নি।ছেলে মানুষের কর্মই ধর্ম। তাই আর আর সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে মহানগর গোধূলি ট্রেনে রাত সাড়ে দশটায় চট্টগ্রাম পৌছালাম। টাইগারপাস বড় বোনের বাসায় রাত্রিযাপন করে সকাল ১২টার মধ্যে কাপ্তাই পৌঁছে যাব। কিন্তু সেবার ছুটিশেষে যথাসময়ে কাপ্তাই যাওয়া হয়নি আমার।বোন-ভগ্নিপতি ও ভাগিনাদের সাথে রাতের খাবার গ্রহণ ও গল্প শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম।রাত ১টা ১৫ মিনিটে মোবাইলে ইনকামিং টোন বেজে উঠল। স্ক্রিনসেভারে বাড়ির নম্বর দেখে আতংকিত বোধ করলাম। ঘুমঘুম চোঁখে এক অজানা আশংকা নিয়ে ফোন রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে জানালো কিছুক্ষণ আগে মা পরপারে চলে গেছেন। বাকীটা রাত নির্ঘুমে কাটলো। চট্টগ্রাম থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিজ গ্রামের উদ্দেশে ভোর ৭টায় মহানগর প্রভাতী ট্রেনে উঠলাম।

‘ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজেউন’।

 

[২]
কথায় বলে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। না, আমার মায়ের ভাত মাছ কিছুই লাগেনি। পরিবারের সকলের খাবার শেষে যা থাকত তাতেই তৃপ্ত হতেন। ৫ ভাই ৩ বোনের বিরাট সংসার। আমি যখন পুরোপুরি বুঝতে শিখেছি তখন আমার দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বাকি থাকল ৬।ভাইদের দাম্পত্য জীবনেও যোগ হতে থাকল নতুন নতুন মুখ। জমি আছে ফসল নেই।কোন কোন বছর জমিতে ভাল ধান হয় তবে চিটার পরিমান বেশী।কোনো বছর বন্যা,কোনো বছর খরা। তাই সারা বছর কেহই পেটভরে ভাত খেতে পারতনা।লাল আটার রুটি, মাষকলাই,মসুরি, সিমের বিচি সেদ্ধ,গোল আলু,মিষ্টি আলু সেদ্ধ, ধুন্দার চালের ভাতও খেয়েছি। জমিতে পিয়াজ,রসুন, ধনিয়া, মরিচের চাষ হত। ভোজ্য তেলের জন্য তিল,তিসি, ভেড়েন্ডা ও সয়াবিনের চাষ করা হত।ঘরে হালের বলদ ও দুধের গাভী ছিল। খোয়ারে মোরগ মুরগী ছিল। বিলের ডুবার জিঅল মাছ, বাড়ির আনাচে কানাচে পুঁইশাক,ডাটা,পেপে চাষ হত। হতো আদা আর হলুদের চাষ।ঘরের চালের লাউ, মিষ্টি কুমড়া,শিম,পটল,চিচিঙ্গা প্রয়োজনীয় শাকসবজির যোগান দিত। হাটবারে বাজার থেকে কেনাকাটার মধ্যে কেরাসিন আর লবন ছাড়া বেশী প্রয়োজনীয় তেমন কিছুই ছিলনা।পাটের খুবই কদর ছিল।পাট গাছ থেকে পাট প্রক্রিয়াজাত করা,ধান থেকে চাল প্রক্রিয়াজাত করা,তিলকে তাল করে সবার মুখে নিয়মিত সুস্বাদু খাবার তুলে দেওয়ার মত কঠিন কাজটি যিনি সযত্নে করেছেন তিনি আমার মা।

মা পাকা নারিকেলের চির ও চিড়া খেতে পছন্দ করতেন।নিজ হাতে দুধ থেকে উঠানো ঘি মাখা লবন মিশ্রিত গরম ভাত পছন্দ করতেন, বাদামের বিচি ভাতের সাথে খেতে ভালবাসতেন।

সস্তাদামের মাত্র দুটো শাড়ি হলেই কেটে যেত সারা বছর।কখনো দামী কোনো শাড়ি পরতেন না। পায়ে জুতা পরতে দেখিনি। ভালমানের কোন কাপড় কেউ কিনে দিলে কিংবা উপহার হিসাবে দিলে তা তুলে রাখতেন। এগুলো আবার অন্য কাউকে দিয়ে দিতেন। বাংলা সাবান আর সরিষার তেল হলেই চলত। মাথায় কখনো সখনো নারিকে তেল দিতেন। এতটুকুই প্রসাধনী। আজকের দিনে তা ভাবতেও অবাক লাগে।

গা ব্যথা,স্বাভাবিক সর্দিকাশি জ্বর হলে কখনো ঔষধ নিতেন না।ঔষধ খেলে নাকি অভ্যাস খারাপ হয়ে যাবে।ব্যথা বেদনার জন্য বড়জোর সরিষার তেলে রসুন গরম করে সেই তেল মালিশ করতেন।

নিয়মিত পান সুপারি খেতেন,সাদাপাতা /জর্দা খেতেন।মায়ের অনেক পান বান্ধবী ছিল। একজন আরেকজন থেকে পান/সুপারি /সাদাপাতা আনা-নেওয়া করতেন।
আবু তাহের ভাইয়ের মা,অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের দারোগা মোকাদ্দস মামার মা,মরহুম ছিদ্দিক সরকারের স্ত্রী ও হাজী আশ্রাব আলী তালুইর স্ত্রী উল্লেখযোগ্য। মায়ের পান বান্ধবীদের কেউ আর বেচে নেই।তবে ওনাদের মধ্যে কোনদিনও পান থেকে চুন খসার মত কোনো ঘটনা ঘটেনি।

তিনি ছিলেন অত্যন্ত সহজ সরল,পর্দানশীল ও লাজুক প্রকৃতির রমনী।অল্পভাষী ও নিচুকণ্ঠের অধিকারিণী। নিজ গ্রামে বাপের বাড়ি ও শ্বশুরালয় হওয়া সত্বেও উচুকণ্ঠে কথা কিংবা কোনো প্রকার বাকবিতন্ডা ও তর্কে লিপ্ত হতেন না। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া স্বামীর বাড়ির চৌহদ্দির বাহিরে তো দূরের কথা বাপের বাড়িতেও যেতেন না। ধর্মীয় রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।সংসারের শত ব্যস্ততার মাঝেও নিয়মিত কোরআন তিলাওয়াত ও অজিফা পাঠ করতেন।

[৩]
শুধু আমাদের ভাই বোনের নয়। যে কারোর কোন ভাল সংবাদ শুনে মা খুশী হতেন। অন্যের দুঃখ বেদনা ও কষ্টে ব্যথিত হতেন।কখনো অপরের ক্ষতি ও অমঙ্গল কামনা করতেন না। পরীক্ষায় বারবার প্রথম হওয়ার আনন্দ আমি আমার মায়ের চোখে মুখে দেখেছি। আমাদের শিক্ষকগণের প্রতিও ছিল ওনার এক অন্যরকম ভালবাসা মাখানো দোয়া। আমার স্কলারশিপ, এসএসসি, আইএসসির রেজাল্ট শুনে মা যারপর নেই এমন খুশি হয়েছেন। আমার চাকুরি প্রাপ্তির সংবাদে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। তবে ট্রেনিং অনেক কষ্টের জানতে পেরে মনে মনে কষ্ট পেয়েছিলেন। মায়ের কাছে সন্তান সব সময়ই আদরের সন্তান। তাইতো ‘কঠোর প্রশিক্ষণ সহজ যুদ্ধ’ এই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ‘শপথ’ শেষে প্রশিক্ষণকালীন কিছু কষ্টের অভিজ্ঞতার কথা জানার পর তিনি বলেছিলেন,”তোমার ওখানে যাওয়া ঠিক হয়নি”।

আমরা তিন ভাই বোন পড়াশোনায় নিয়মিতই ভাল ছিলাম।তাই পড়াশোনার ব্যপারে তিনি কখনো আমাদের উপর চাপ প্রয়োগ করতেন না। খুব ছোটকালে পেট ব্যথার অজুহাতে পড়ার টেবিল থেকে মায়ের কাছে চলে যেতে চাইতাম। মা তা বুঝলেও রাগ করেননি। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমানো আমার অভ্যাস ছিল। মাঝে মধ্যে রাক্ষস, পানপাতা, ডালিম কুমারের গল্প শুনাতেন।বেহুলা লক্ষ্মিণধরের কেচ্ছা শুনাতেন। শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে যেতাম টেরও পেতামনা।

স্কুল কলেজ জীবনে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামে আমরা একাধিক পুরস্কার পেতাম। তাতে মা খুবই খুশি হতেন। তবে গ্রামের অন্যান্য সহপাঠীরা পুরস্কার না পেলে তিনি কষ্ট পেতেন। ছোট বেলা দক্ষিণ চকে, অদের খালে, গাঁয়ের পশ্চিমের নলিতে মাছ ধরতে যেতাম।আজ আর সেই শৈশব নেই, পানি ভরা মাছও নেই। ময়াজাল ও কাছিটানা মাছ বন্টন শেষে মা ছোট ভাগটি নিতেন।অন্য শরীকদের দিতেন বড় মাছের ভাগটি।তাতে আমাদের ছোট্ট মনে কষ্ট পেলেও মা আনন্দ পেতেন।

স্কুল জীবনে পত্রিকায় প্রকাশিত আমার লেখা কবিতা দেখে মা খুশি হতেন। ‘মমতাময়ী মা’ শিরোনামে ২৪ লাইনের একটি কবিতা প্রিন্ট ও বাঁধাই করে ঘরে টানিয়ে রেখে ছিলাম।মাকে আমি একবার কবিতাটি পড়েও শুনিয়েছিলাম। পরে একাধিকবার তিনি নাতি নাতনির কণ্ঠে কবিতাখানা পড়িয়ে শুনেছেন।কবিতাটি ২০০৫ সালে অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত ‘স্মৃতির মিছিলে’ কাব্য গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। কবিতার কয়েকটি ছত্র নিন্মরূপ:

‘স্বদেশ কিংবা বিদেশ যেথায় যেথা থাকি
অকারণে বারেবার মা মা বলে ডাকি।
মা যে মাথায় হাত বুলিয়ে গালে দিতো চুম
নয়ন পটে আর আসেনা সেই নিদ আর ঘুম।
——
—–
সেই মাকে ছেড়ে আজ খোকা বিদেশ বিভূঁই রই
মায়ের চাঁদপানা ঐ মুখের রূপ কথা আজ কই?
মাগো তুমি আশিস করো অনেক বড় হবো
সবার মাঝে সুউচ্চ শিরে আমি বেঁচে রবো।’

মায়ের আর্শিবাদে আজও বেঁচে আছি।সুখে আছি।ভাল আছি।আলহামদুলিল্লাহ।

“রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ঈয়ানী সাগিরা”। (সূরা বণী ইসরাইল, আয়াতঃ ২৩-২৫)

[অর্থঃ হে আল্লাহ্ আমার মাতা-পিতার প্রতি আপনি সেই ভাবে সদয় হউন, তাঁরা শৈশবে আমাকে যেমন স্নেহ-মমতা দিয়ে লালন-পালন করেছেন।]


[৪]
আনার খেতে গেলেই মাকে মনে পড়ে
আনার আছে শুধু মা নেই আজ ঘরে।

সব রকমের ফলের মধ্যে আমার জান্নাত বাসিনী মা আনার ফল খুবই ভালবাসতেন।আমার একমাত্র তনয়া প্রিন্সেস সামীহা নূর জারার প্রিয় ফলও আনার।আজ থেকে দেড় দুই দশক আগে বর্তমানের মত এ ফলটি এত সহজ লভ্য ও সুলভ ছিলনা।পরিবারের কেউ কিংবা কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর মাকে যদি কখনো বলেছি,আম্মা কি ফল খেতে চান বা কি ফল আনবো।তিনি আমতা আমতা করে বলতেন,বড় সাইজের ভাল আনার পাওয়া গেলে যেন আনি।ছোট বেলা থেকেই আমাদের বাড়ীতে ডালিম গাছ ছিলো।গাছে প্রচুর ডালিম ধরতো।তবে তা আকারে তেমন বড় হতোনা।কাচা থেকে খাওয়া শুরু
করতাম।তারপর কাচাপাকা এবং শেষে পাকা পর্যন্ত। আকারে ছোট বলে আমরা এগুলোকে ডালিম ভাবতাম।আর শহরের ফলের দোকানে বড় মানের ডালিম আকৃতির দামী ফলটিকে ভাবতাম বেদানা বা আনার।
কেউ আনার আনলে মা চকচকে দানাগুলো ছাড়িয়ে ডজন খানেক নাতি নাতনি,ছেলেদের বউ আর আমাদের ভাইদের মধ্যে বন্টন করে দিতে খুবই আনন্দ বোধ করতেন।নিজের ভাগে যা থাকতো সেগুলোও আবার ছোটদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন।
আনার,বেদানা বা ডালিমকে স্বর্গীয় ফল বলা হয়। কারণ এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের জাদুকরী গুনাগুণ।। ডালিম বা বেদানা ফল মোটামুটি সারা বছর পাওয়া যায়।

মা নেই।মায়ের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমাকে।
রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা।

[৫]
সব সময় আপনার মঙ্গল কামনায় যিনি ছায়ার মত আপনার পাশে থাকেন তিনি হলেন মা। সন্তানের যেন কোন অমঙ্গল না হয়,সে চিন্তায় তিনি উদ্বিগ্ন থাকেন। বিপদাপদ, সকল প্রকার দৈব দুর্বিপাক ও রোগ-শোক মুক্ত জীবন কামনা করেন।বাড়ি থেকে কোথাও গেলে মা দোয়া দরূদ পড়ে নাকে মুখে চোখে ও শরীরে থুপথুপিয়ে দিতেন। কখনো চোখের কোণে,কখনো কানের লতিতে কুপির কালির ফোটা দিতেন।যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ থাকিয়ে থাকতেন।গোসল শেষে শরীর মুছে সারা গায়ে সরিষার তেল মাখিয়ে দিতেন।মায়ের সেই আদর সোহাগ যারা পায়নি,তারা এর আকুলতা অনুভব করতে পারবেনা।আমার এখনও ইচ্ছে করে মা যদি আমার সকল কাজের মঙ্গল কামনায় থুপথুপিয়ে দিতেন! আমি সকল কাজের কাজী হতাম।আমি বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত বিড়বিড় করে আমার জন্য দোয়া করতেন,আমি সফল হয়ে ঘরে ফিরতাম।

একদিন কোন এক অজ্ঞাত কারণে সকাল থেকে কিছু না খেয়ে আলগা ঘরে শুয়ে আছি।মা বিষয়টি বুঝতে পারলেন। আমার রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। শেষে একগ্লাস দুধ নিয়ে এলেন।অনেকক্ষণ অনুনয়-বিনয় করলেন।আমার মন টলে না,গলেও না।পরে বলেন, ”আমি না থাকলে কেউ এমন করে ডেকে খাওয়াবে না।” তৎক্ষনাৎ মায়ের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে দুধটুকু খেয়ে নিলাম। আজ না খেয়ে থাকলেও কেউ মুখ পানে তাকিয়ে বুঝতে পারেনা সারাদিন খাইনি। মা সত্যি তা বুঝতেন।

খুব ছোট ১৯৮৮/৯ সালের কথা।তখন গ্রামে বিদ্যুৎ নেই, নেই ফ্রিজ। হাটবারে বাজার থেকে সন্ধ্যায় মাছ কিনে আনলো।সেই মাছ কেটে ধুয়ে ভেজে পরের দিন রান্না করার জন্য রেখে দিল।রাতে মায়ের সাথে ঘুমানোর সময় ভাজা মাছের ঘ্রাণে আমার ঘুম আসছিল না।ভাজা মাছ খেতে ইচ্ছে করলো।মাছ খাবো এ কথাও ভয়ে বলতে পারছিলাম না। আমার কুহানু কাহানু শুনে মা ঠিকই বোঝলেন আমি কী চাই। অগত্য পুনরায় কুপী জ্বালিয়ে আমাকে ভাজা মাছ খেতে দিলেন।মাছ খেয়ে চুপ করে ঘুমিয়ে পড়লাম। এমন করে মনের কথা বুঝার মানুষ মা ছাড়া দুনিয়াতে দ্বিতীয়জন আছে বলে আমার মনে হয়না।

[৬]
এই যে আমার সুখ সমৃদ্ধশালী দাম্পত্য জীবন।এর মূলেও আমার মা। আমার বিয়ের জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছে। পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে পরিবারের সবার আমার মতামতের উপর আস্থা ও ভরসা দুটোই ছিল।ছুটিতে বাড়ি গেলে আত্মীয় স্বজন ও ঘটকের মাধ্যমে পাত্রী দেখার তাগাদা আসতো।সম্ভবত ২০০৫ সালের মার্চ মাসে একই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সাহেবের বড় মেয়ের জন্য প্রস্তাব আসে।পারিবারিক ভাবে মেয়েকে দেখা হয়। আমার অফিসিয়াল ব্যস্ততার কারণে সেবার বিয়েতে সম্মতি দেইনি। অতপর অন্যান্য পরিবারেও মেয়ে দেখা হয়।আমার মা কোন মেয়েকেই দেখেননি।না দেখলেও খেওড়ার শরীফ শামসুল হক সাহেবের মেয়েকেই তাঁর ছেলের জন্য উপযুক্ত মনে হয়েছে। আমি মায়ের মনোভাব যখন বুঝতে পারি, সিদ্ধান্ত নিই ওখানেই বিয়ে করব।পরিশেষে ২০০৫ সালের ১১ ডিসেম্বর আমার তরী এসে ভিড়ল খেওড়া চেয়ারম্যান বাড়ির বড় মেয়ের ঘাটে। আমার স্ত্রীকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ ও আদর করতেন। আমার স্ত্রীও মায়ের প্রয়োজনীয় এটাসেটা কিনে দিতেন।মা ২০১০ সালের আজকেরদিন ১৪ ডিসেম্বর মারা যান।ঐ সময়ের মধ্যে আমাদের দাম্পত্যজীবনে কোনো সন্তান আসেনি।চোঁখের সামনে সবসময় ডজনখানেক নাতি নাতনি ঘুরাঘুরি করলেও আমাদের সন্তান দেখার জন্য তিনি আকাঙ্খা পোষণ করতেন।সে ভাগ্য আমাদের হয়নি! তবে মা আমাদের দাম্পত্য জীবনের জন্য সন্তান কামনা করেছেন। অনাগত সন্তানের জন্য দোয়া করেছেন।আলহামদুলিল্লাহ। মায়ের দোয়ার বরকতে মহান আল্লাহ পাক আমাদেরকে একটি রাজকন্যা উপহার দিয়েছেন। তাঁর পায়ের জমজম শব্দে মুখরিত থাকে ঘর,হাসির ফোয়ারায় ভেসে যায় ক্লান্তি, কথার মধুরতায় হারিয়ে যায় দুঃখ বেদনা। দেখতে আমার মায়ের মতই চন্দ্রমুখী হয়েছে। আচার আচরণ ও খানাপিনায় যথেষ্ট যত্নশীল। মায়ের হাতের স্বর্ণের দুটো বালা এখন আমার মেয়ের হাতে শোভা পায়।মায়ের আর্শিবাদ মাখানো স্মৃতিকে মেয়ের মাঝে চিরকাল দেখতে চাই আমি।তাইতো মায়ের নাম ‘জা হা না রা’ কে সংক্ষিপ্ত করে মেয়ের নাম রেখেছি জারা।

"রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা।"