[১ সেপ্টেম্বর ২০২০।
ছবি প্রতিকী ও সংগৃহীত। ]
অনেকের মাঝে বয়স লুকানোর প্রবণতা কাজ করে।কোনো এক সময় হয়তো আমার মাঝেও করত।বয়স বাড়ার সাথে সাথে টের পাচ্ছি।বাস্তবকে অনুভব করছি।বয়স কী আর বাড়ে? বয়েস তো শানবাঁধানো পুকুরঘাটের ইটপাথরের মত। প্রতিদিনই ক্ষয়ে যায়।এক একটা করে হারিয়ে যায়।আমার জন্ম(সম্ভবত) ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯ সাল মোতাবেক শনিবার দিন। সকল সার্টিফিকেটে ১৯৮২ সালের ৮সেপ্টম্বর বুধবার দিন।তবে আমার জন্মের দিন ঘোর বৃষ্টি ছিল।হালকা বাতাস ছিল।ঐ দিন আসরের আগে পরে আমি জন্মেছিলাম।
প্রথম তারিখ অনুযায়ী আজ থেকে ১৪৯৭৬ দিন পূর্বে পৃথিবীর আলো বাতাসে আমার প্রথম চিৎকার। শেষোক্ত তারিখ অনুযায়ী ১৩৮৮০ দিন পূর্ব থেকে মানব সমাজের সাথে আমার বসবাস।
৮ ভাই বোনের সংসারে পরিবারের ছোট্ট সদস্য বলে আদর যত্ন আর আধিক্যেতা বেশিই ছিল।শিশুকালে ঘরোয়া পড়াশোনায় তত একটা মন বসত না আমার।তাই স্কুল জীবনের শুরুটা একটু বিলম্বিত ছিল। অবশ্য আমাদের সময় ছেলে মেয়েরা আজকের শিশুদের মত এডভান্স ছিলনা। মা বাবারাও সন্তানের পড়াশোনার ব্যাপারে এত সিরিয়াস ছিলেন না।তবে আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রেজাল্ট সব সময়ই ভাল ছিল। ক্লাসের পড়া ক্লাসেই শেষ করতাম। হোম ওয়ার্ক বলে কিছুই থাকত না।খুব ভোরে পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙ্গত।হাতমুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে বসতাম।মাগরিবের আযান হলে নীড়ে ফেরা পাখিদের সাথে আমিও ঘরে ফিরতাম।পড়া লেখার জন্য নিজস্ব একটা রুটিন ছিল।পড়তে ভাল লাগতো।লেখতে ভাল লাগতো।রাত ১১টায় রেডিও শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম।আর এ কারণেই স্কুল কলেজ জীবনে কখনো সেকেন্ড হতে হয়নি।
জীবনে কী হতে চেয়েছি,কী হয়েছি, কী পেতে চেয়েছি,কী পেয়েছি আর কী পাইনি?কুসুমিত মনের সে আকাশ কুসুম চিন্তা আজ আর মাথায় নেই। এক সময়তো কত কিছুই ভাবতাম। গুলশান বনানীতে বিশাল এক বাড়ি থাকবে,বাড়ির সামনে বাগানে গোলাপ,টগর,চামেলি ; বিদেশি কুকুর, সর্বাধুনিক ফ্যাশনের গাড়ি আরো কত্ত কী! আজ এসব ভাবলে মনে মনে ভীষণ লজ্জা বোধ করি।বাস্তব আর কল্পনা এক নয়।বয়স বাড়ার সাথে সাথে নির্মম কঠোর বাস্তবকে অনুধাবন করতে পেরেছি। স্বার্থ কে ত্যাগ করতে না পারলেও অন্ধ স্বার্থকে ত্যাগ করার রুচিবোধ কিছুটা জন্মেছে বৈকি। শিশু নিজে স্বপ্ন দেখার আগে তাকে নিয়েও এই সংসার সমাজ আর দেশের কিছু স্বপ্নবাজ মানুষ বড় কোনো স্বপ্ন দেখে।এই স্বপ্নবাজ মানুষগুলো হয় সন্তানের পিতা মাতা,কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক এবং এমন আরো অনেকে। আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের নিকটও আমি চিরঋণী। কারণ ওনারা আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। পরম যত্নে ভালো কিছু শেখাতেন। আমার ভাল হোক মনে প্রাণে তা চাইতেন।এমনটি চাইতেন বলেই আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবন সমাপান্তে সার্টিফিকেটে বয়স একটু কমিয়ে দিয়েছিলেন। একটু নয় পুরো তিন বছর।আজ সকল শিক্ষকগণের নাম মনে না পড়লেও ওনাদের স্নেহ আর আর্শীবাদ মাখা সুন্দর মুখগুলো আমার চোঁখে ভাসে।সেদিন আর্শীবাদ করে বলেছিলেন, "তুমি অনেক দূর এগোবে।তুমি অনেক বড় হবে।আমাদের দোয়া তোমার পাশে থাকবে।"
এইতো জীবন
একসময় শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা ছিল। স্কুল জীবনে ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য'(Aim of your life) রচনা লিখতে গিয়ে অন্যান্য সহপাঠীদের মত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবো তা না লিখে বরং আমার জীবনের লক্ষ্য’ লিখেছিলাম ‘রাজনীতি’। অধুনা প্রচলিত গতানুগতিক রাজনীতির মত নয়; অবশ্যই তা হবে রাজার নীতি। কেন জীবনের লক্ষ্য রাজনীতি তার উত্তরে ছিল: পৃথিবীতে এমন একটি পেশাও নেই যা গ্রহণে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের উপকার ও কল্যাণে আসা যায়। রাজনীতিই একমাত্র মহত্তোম পথ বা পেশা যেটি চর্চা করে আপনার আমার চারিপাশের পরিবেশ, সংস্কৃতি ও পরিস্থিতিকে বদলে ফেলা বা উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।একজন রাজনীতিবিদই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন, শারীরিক ও মানসিক বিকাশে যথার্থ অবদান রাখতে পারে। রচনাটির দুই পৃষ্ঠার পরতে পারতে একজন আদর্শ রাজনীতিবিদের নৈতিক ও মানসিক মূল্যবোধ কেমন থাকা উচিত তাও বিশদভাবে লেখা ছিল। দায়িত্ব ও কর্তব্যের তালিকাটি ছিল সময়োপযোগী।
স্কুল জীবনে আমার হ্যান্ডনোট গুলো বিষয়ভিত্তিক সংশ্লিষ্ট স্যারদের দেখিয়ে পরিশুদ্ধ করিয়ে নিতাম। বিজ্ঞান ও কলায় সমান পারঙ্গম ছিলেন স্বর্গীয় বাবু সূর্যকান্ত স্যার। রচনাটি স্যারকে দেখালাম। তিনি আমায় অত্যন্ত স্নেহ করতেন,এসএসসিতে হায়ার ম্যাথম্যাটিকসের ছাত্র হয়েও স্যারের সাহচর্যে পরীক্ষা পূর্ববতী সময়ে আমি হিসাব বিজ্ঞান বেশ রপ্ত করেছিলাম। বাংলা ব্যাকরণের খুটিনাটি জেনেছিলাম। সাহিত্যের নীতি ও গতি-প্রকৃতি শিখেছিলাম। যাকে বলে ‘A man is known by the company he keeps.’ যা হোক,স্যার আমার লেখা ‘আমার জীবনের লক্ষ্য রাজনীতি’ রচনাটি মনোযোগ সহকারে পড়লেন। একটু হাসলেন। তিনি জোরে হাসতেন না। তবে হাসির শব্দে সুন্দর একটি সুর ঝংকৃত হতো। স্যারের হাসিতে বুঝতে পারলাম রাজনীতির মত মহান পেশা আর হয়না। পরক্ষণে অবশ্য আমাকে তিনি সেই কথাগুলোই বললেন। তিনি আমাকে তুমি বলে সম্বোধন করতেন। মনে পড়ে স্যার বলেছিলেন, “Morning shows the day. তোমার মাঝে এমন প্রস্ফুটিত চিন্তা আমাকে আনন্দ দিয়েছে। পরীক্ষার খাতায় এ রচনা লিখলে আমি তোমাকে দশে দশ দিবো কিন্তু অন্য আরেকজন শিক্ষক হয়তো আমার মত করে ভাববে না।রাজনীতির টপ টপিক্সটিকে তোমার মত করে নিবেনা। তাই পরীক্ষার খাতায় নয়। এমন মহৎ পরিকল্পনা গুলো মনের খাতায় লিখে রাখ। সময় মত বাস্তবে রূপ দিতে পারলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে।” তিনি আরো বলেছিলেন, “একজন রাজনীতিবিদকে সর্ববিষয়ে পারদর্শী হতে হবে। অন্য পেশার মানুষ রাজনীতিবিদ হলে তার মধ্যে রাজনৈতিকের সকল গুণাবলী থাকেনা। তখন জনতা তার কাছে আমজনতা মনে হয়।”
রাজনীতিবিদ হওয়া হলো না! মেডিকেল কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিয়েও ডাক্তার হওয়া হলো না! ফিজিক্স, হায়ার ম্যাথম্যাটিকস নিয়ে বিজ্ঞান শাখায় পড়াশোনা করেও ইঞ্জিনিয়ার হওয়া হলোনা!
তারুণ্যে উজ্জীবিত স্বপ্নভরা দুচোখে (সেনা বাহিনী) “সমরে আমরা শান্তিতে আমরা সর্বত্র আমরা দেশের তরে”, (বিমান বাহিনী) “বাংলার আকাশ রাখিব মুক্ত”,(নৌ বাহিনী) “শান্তিতে সংগ্রামে সমুদ্রে দুর্জয়” বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর উপরোক্ত শ্লোগান তিনটি
জোনাকির আলোর মত জ্বলজ্বল করে উঠলো।
সময়ের প্রয়োজনে ‘কঠোর প্রশিক্ষণ সহজ যুদ্ধ’ মূলমন্ত্রের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছিলাম। Aim of my life রচনার Aim আর ঠিক থাকলো না। কঠোর বাস্তবতার কাছে ‘শ্রমের মূল্য’ রচনায় পড়া Work is worship (কর্মই ধর্ম) মন্ত্রে জীবনকে সঁপে দিলাম। কিছু স্বপ্ন হারিয়ে গেল,কিছু স্বপ্ন পালিয়ে গেল,কিছু স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখলো আমায়। জীবনের সোনালি দিনগুলো হারিয়ে,২১ বসন্তের কর্মমুখর জীবন মাড়ায়ে কখনও কখনও মনে হয়,জীবনের লক্ষ্য আজও পূরণ হলো না।তবে শৈশব কৈশোর থেকে শব্দমালা নিয়ে খেলার স্বপ্ন আমাকে আজও বড় কোন স্বপ্ন দেখায়। একদিন সকল ঘুমন্ত বিবেক জেগে উঠবে,একদিন সকল অনাচার অবিচার বন্ধ হবে আমার লেখায়।