পোস্টস

চিন্তা

গোল্ডফিশ মেমোরির সময়ে

২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রওশন আরা মুক্তা

কয়েক রাত নির্ঘুম কেটেছে। ইন্টারনেট বন্ধ ছিল, আর টিভিতে নেই কেবল কানেকশন। দিনলিপি লিখে রাখছিলাম, যেন পরে মনে থাকে সব। কোনটার পর কী হলো, কোনটা আগে কোনটা পরে। সারাদিন বোনকে কল দিয়েছি সংবাদের জন্য, আর বোনও কোনো নতুন আপডেট পেলেই কল দিয়েছে সাথে সাথে। 


আমরা ধীর গতির ইন্টারনেট পেলাম ২৪ তারিখ তবে ফেসবুক বন্ধ। এর মধ্যেই রটে গেছে দেশের ধ্বংসযজ্ঞের খবর। বাংলাদেশি চ্যানেলগুলো শুধু পোড়া বিল্ডিং দেখাচ্ছে। আর বিদেশি চ্যানেলে এসেছে শতাধিক মৃত্যুর খবর। অদ্ভুত একটা ডিলেমা তখন। মানুষ মৃতের পক্ষে যাবে নাকি বিল্ডিং-এর? 


২৪ তারিখ অফিসে গেলাম। হতাশা, চাপা ক্ষোভ, নীচুস্বরে আলোচনা চললো। কী হয়ে গেল সব! এটাই কি তবে নিয়তি! হ্যাঁ, দাবি মেনে নেয়া হয়েছে। কীসের আর আন্দোলন তবে? তারপরো কেন ভাঙচুর? 


অফিস থেকে ফিরতে ফিরতেই এমন সব ভিডিও দেখা হয়ে গেল যেসব সচারাচর আমি প্লে করি না। মানুষ মানুষকে মারছে এরচেয়ে জঘণ্য দৃশ্য আর হয় না। না দেখেও উপায় ছিল না। কারণ সুশীলদের টিভিতে তখন বিটিভি পোড়া ছাড়া কোনো নিউজ নেই। 


নির্ঘুম রাতের কারণ ছিল ভয়ানক সব স্বপ্ন। এদিকে পুলিশ ওদিকে পুলিশ, সবার হাতে অস্ত্র আর মাঝখানে পড়ে গেছি আমি। পরিবারকে জানাতে পারছি না, যে আমি মরে যাচ্ছি। জেইলখানার মতো লাগছিলো নিজের বাসাটাকেই। 


রাতে বিছানায় শুই, ছটফট করি, আবার উঠে এ ঘর ও ঘর হাঁটি। দুইটা লাইন লিখি, ভাবি কী দরকার লেখার? আমি এক ছাপোষা মহিলা মানুষ, এসব লেখা আমাকে মানায় না। লেখা বন্ধ রাখি। আবার কীভাবে যেন চার লাইন লিখে ফেলি। তারপর ভাবি, আরে লিখলে কী আর এমন হবে, আমি তো আর যাই হোক এই লেখা পাবলিশ করতে যাচ্ছি না, তাহলে লিখেই ফেলি। মোবাইলের নোটসে কবিতাটা লেখা শেষ করি। ততক্ষণে সকাল। আমার বাচ্চার ঘুম ভাঙার সময় হয়ে এসেছে। হালকা ঘুমের চেষ্টা করতে করতেই অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়ার সময় হয়ে গেল। 


রেডি হচ্ছিলাম অফিসে যাবো বলে। মোবাইলটা হাতে নিলাম অফিসের গ্রুপে কোনো মেসেজ আছে কিনা চেক করতে। কিন্তু আমার হাত স্বয়ংক্রিয়ভাবে নোটস থেকে কবিতাটা কপি করে ফেসবুকে পেস্ট করে দিলো, তখনও নাম দিই নাই কবিতাটার। খুব কান্না পাচ্ছিলো আর মনে হচ্ছিলো, এই কান্নার স্থায়িত্ব আসলে কত সময়ের? মধ্যবিত্ত মন তো আসলে গোল্ডফিশ। এই কাঁদছি, কালই হয়তো ভুলে যাবো। আমার মেমোরিকে দখল করেই তো শাসন করা যাচ্ছে আমাকে! কবিতার নাম লিখলাম, গোল্ডফিশের কান্না। কী আর হবে খুব বেশি হলে? ধরে নিয়ে যাবে? মেরে ফেলবে? কিছু না বলে রাস্তায় গুলি খেয়ে মরার চেয়ে, কিছু বলে মরে যাওয়া ভালো। ফেসবুকে পোস্ট করে দিলাম কবিতাটা। এরপর হাতমুখ ধুয়ে অফিসে চলে গেলাম। 


অফিসে এসে সাধারণ দিনের মতোই শুরু করলাম সব। কিছুক্ষণ পর দেখি আসলেই একজন মেট্রো দেখতে গিয়ে কাঁদছে। সার্কাস মনে হলো ব্যাপারটা। ওদিকে আমার পোস্ট একটার পর একটা শেয়ার হচ্ছে। আর আমার মনে হচ্ছে শেষ, আমার জীবনের এখানেই ইতি। আমি কী পরিমাণ ভীতু মানুষ তখন টের পেলাম। কেউ আমার কবিতা শেয়ার করলেই মনে হচ্ছিল, আমাকে বাঘের খাঁচার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। হায় হায়, আমি কী করব এখন? পোস্ট ডিলিট করে দিবো? কিন্তু ততক্ষণে অনেকেই কপি করেও পোস্ট দিয়ে ফেলেছে। 


অভাবনীয় ঘটনা ঘটলো অফিসে। আমার বস, আমার সিনিয়ররা কবিতাটা অসম্ভব পছন্দ করলেন। আমাকে ডেকে জড়িয়ে ধরলেন শ্রদ্ধেয় একজন মোস্ট সিনিয়র কলিগ। তিনি আমাকে এপ্রিশিয়েট করছিলেন, আর আমার মনে হয়েছিল, আমি অকূল পাথারে একটা অবলম্বন পেয়েছি যেটা ধরে আরো কিছুক্ষণ ভেসে থাকা যায়। যে আমি জীবননাশের ভয়ে কম্পিত ছিলাম, গুম হওয়ার আতঙ্কে নাই হয়ে যাচ্ছিলাম, কিছু না হলেও অন্তত চাকরি তো যেতেই পারতো! সেই আশংকাও তো ছিল। কারণ অন্য অফিসে এমন অভিজ্ঞতা ছিল যে, চিফ ডেকে বলেছিলেন, গল্প-কবিতা লিখতে হলে চলে যান। আমাদের কলম শুধু নিউজের জন্য চলবে। মেনে নিয়েছিলাম, কিন্তু বেশিদিন মন টিকাতে পারিনি। সেই আমি এমন একটা অফিস, আর এমন অসাধারণ কলিগদের মাঝখানে অন্যরকম একটা তৃপ্তি পেলাম। 
গোল্ডফিশের কান্না কবিতাটা অনেকেই পড়েছেন, ভিডিও শেয়ার করেছেন যার মধ্যে মোজাম্মেল স্যার অন্যতম। আমার মা-বাবা, ভাইরা, বোন-দুলাভাই ফোন করে আমাকে সাহস দিয়েছিলেন আমাকে। দুই একজন লেখক বন্ধুও ফোন করে আমার খোঁজ খবর নিয়েছেন। বলেছেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, কিছু করবে না আপনাকে। কিন্তু তাতেও আমার ভয় কাটেনি। অফিসে যাওয়া-আসার সময় মনে হতো দূর থেকে বুলেট ছুটে আসবে। রাতে মনে হতো বাসায় কেউ আসবে, যদি ধরে নিয়ে যেতে আসে তাহলে কী করবো এই সমস্ত ভাবনায় দুই-তিনরাত একেবারেই ঘুমাতে পারিনি। তারপর যখন দেখলাম অনেকেই লিখছে, অনেকেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হচ্ছে তখন আশা জাগলো, ধীরে ধীরে ভয়টা কেটে গেল। 


তবে এখনো অবিশ্বাস্য লাগে, এমন দিন কেটেছে আমাদের। ইন্টারনেট বন্ধ করে কী নির্বিচারে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, আর কী নির্লজ্জভাবে কিছু পোড়া বিল্ডিং দেখিয়ে সত্য লুকানোর চেষ্টা করেছিল কিছু মানুষ। আমাদের গোল্ডফিশের মেমোরিতে জানি না কতদিন থাকবে এই শহীদদের আত্মত্যাগের কথা। কতদিন আসলে আমরা মনে রাখি তাদের?— যাদের পবিত্র শরীরের ভগ্নাংশে ফুলে-ফলে পরিপূর্ণ হয় এই পৃথিবী।