পোস্টস

চিন্তা

একাত্তর প্রশ্নের সমাধান কোনপথে

৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

জুলাই বিপ্লবে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার হাতে আওয়ামী লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। ২০০৮ এর গণভোটে বিজয়ী নারী নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার যে ইতিবাচক ইমেজ গড়ে উঠেছিল তাদের ভুলে সেটিরও অবশিষ্ট কিছু নেই। ১৪, ১৮ ও ২৪ এর একতরফা সরকারের অগ্রহণযোগ্যতা পিতৃতান্ত্রিক প্রতিভুদের ছড়ি ঘোরানো দেশে একজন নারী লিডারের সমস্ত প্রশংসা বানের জলের মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী ন্যারেটিভও ধূলায় মিশে গেছে। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নাম্বার বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আওয়ামী রেজিমের ভয়াবহ একগুঁয়েমি ও স্বেচ্ছাচারিতা মুছে দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর নাম নিশানা।

তিপ্পান্ন বছর পরে এসে খোদ পাকিস্তানও এটাকে তাদের বিজয় হিসেবে ঘোষণা করেছে। সেদেশের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেছেন, পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন করার সাজা পেয়েছেন শেখ মুজিব।

গেল ২১ আগস্ট ইসলামাবাদে ন্যাশনাল ইয়ুথ কনভেনশনে তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, যিনি খারাপ কাজ করবেন, তা ফের তার ওপরই আসবে। শেখ মুজিবুর রহমান এই অবিভক্ত পাকিস্তানকে দুই ভাগ করেছিল।’  

ফেসিজম, করাপশন ও পারভারশন সব শাসনকেই এমনতর কালিমালিপ্ত করে। শেখ হাসিনার আজকের আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। 

কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারে চেতনা, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা, তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর সতীর্থদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, লাখো মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার আত্মত্যাগ, ১৬ ডিসেম্বরে বিজয়ী জনতার ম্যান্ডেটে পাওয়া বাহাত্তরের সংবিধান, বাংলাদেশ, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতও বাতিল বলে গণ্য করা যাবে? স্বাধীনতার কনক্রিট ইতিহাস পাশ কাটিয়ে সেটা কোন পথে হতে পারে? 

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও ইন্টেরিম গভমেন্টের আইসিটি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতকে বলেছেন, "আওয়ামী লীগের আদর্শে ১৯৭১ ছিল ‘ইতিহাসের শেষ অধ্যায়’। কিন্তু আমরা মনে করি এটি ইতিহাসের ধারাবাহিকতা।… আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে ৭১ এর প্রশ্নটির সমাধান করতে চাই।” 

তিনি আরো বলেন, “ইন্দো-মুসলিম সভ্যতার অংশ হিসেবে উপমহাদেশে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক ও সভ্যতাগত সম্পর্ক রয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক ও ভারসাম্যপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া গড়তে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার প্রয়োজন৷ মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবেও পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের গভীর বন্ধন রয়েছে। যদিও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বাংলাদেশকে বিশেষত্ব দিয়েছে।”
আমরা ২০২৪ এর গণহত্যা দিয়ে একাত্তরের গণহত্যাকে অস্বীকার করবার প্রয়াস পেতে পারি কি? দীর্ঘ ৯ মাসের ম্যাসিভ জেনোসাইডকে ২০২৪ দিয়ে ঢাকা দেয়াটার অর্থ আসলে কী দাঁড়াবে? অতীত বাদ দিয়ে আমরা কেউ না। হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভিতর দিয়েই আমরা আজকের বাংলাদেশি। ২০২৪ এর ইতিহাস খুব তাজা, জ্বলজ্বলে ও জ্যান্ত। তাই বলে একাত্তরকে কি বঙ্গ পরগণা থেকে বিলীন করে দেয়া যাবে? ব্রিটিশ শাসন পেরিয়ে পাকিস্তান গঠন করবার ধারাবাহিকতায় একাত্তরের স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলন তো মিথ্যা নয়। পাকিস্তান আমাদেরকে শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের এক হাজার একটা নজির দেখিয়েছিল, সেই তাদের সাথে আর কোন প্রশ্নের মীমাংসা হবে? পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর কোন সূচকে বাংলাদেশ তাদের চেয়ে পিছিয়ে? 

স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী কালেই আমরা পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক গড়ে নিয়েছি। ইন্টেরিম গভমেন্ট আসার পর ইতোমধ্যে তারা অপর ১২৬টা দেশের মতো আমাদেরও পাকিস্তান ভ্রমণে ভিসা ফি রেয়াত দিয়েছে। আমাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য, খেলাধুলা, সমরসামগ্রীর লেনদেন সবই বিদ্যমান আছে। এরপরও ৭১ প্রশ্নের সমাধানের প্রসঙ্গ আসছে কেন? আমরা আসলে কী বলতে চাইছি? একাত্তরের স্বাধিকার আন্দোলন ভুল ছিল? আমরা কি পাকিস্তানের কাছে ভুল স্বীকার করে নেব? এখনো বাংলাদেশের বড় দুটি দলের নাম বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। দুটি দলেরই প্রতিষ্ঠাতা বা প্রধানদের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে। আওয়ামী লীগের এইসময়ের নেতারা ভুল করেছেন। কিন্তু প্রান্তিক যে মানুষটি দলের কাছ থেকে কিছু না পেয়েও সমর্থন ধরে রেখেছেন যুগের পর যুগ তারা তো এই সমাজেরই মানুষ। আমরা যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়বার কথা বলি তাহলে 'পাকিস্তানের সাথে ৭১ প্রশ্নের সমাধানের' ক্ষেত্রে বিএনপি বা আওয়ামী ঘরাণার ওইসব মানুষ কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের মতামত চাওয়া হবে না? একাত্তরের সত্যিকারের গণ আকাঙ্ক্ষাটা জানতে চাওয়া হবে না? 

এ ব্যাপারে সমন্বয়কদের শীর্ষ ব্যক্তি অবশ্য কিছুটা ভিন্ন কথা বলেছেন। ১৯৭১ সালের আকাঙ্ক্ষাকে পাশ কাটাতে চাইলে, তা আত্মঘাতী হবে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম। তিনি বলেছেন, সংবিধান পুনর্লিখন করতে হলে তা ১৯৭১-এর মানুষের আকাঙ্ক্ষার ধারাবাহিক হতে হবে। 

রাজধানীতে গেল ৩১ আগস্ট শনিবার সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ, সংবিধান প্রসঙ্গ’ শীর্ষক সংলাপে এসব কথা বলেন মাহফুজ আলম। 

মিস্টার মাহফুজ আলম তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেলেও তেমনটাই বলেছেন। 'গণ-অভ্যুত্থানের গণচরিত্র ধরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ! 
ব্যক্তির বদলে সামষ্টিক চিন্তা মোকাবেলা গুরুত্বপূর্ণ!' তিনি আরও বলেন, 'গণ-অভ্যুত্থানের অংশীজন কারা? নির্দিষ্ট করে বললে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের অধিক অংশ। এ নাগরিক বা জনতা যদি বলতে চান- তাদের রূপ আর রঙ বহুত। সব শ্রেণি পেশার দল-মতের লোকেরাই এ অভ্যুত্থানের অংশীজন। এখনই কাউকে বড় করে তোলা কিংবা কাউকে খাটো করে দেখার সময় নয়।' 

সোশ্যাল হ্যান্ডেলে প্রকাশ করা আরো একটি বয়ানে মাহফুজ আলম বলেন, 'এতদিন জঙ্গীবাদের নাটক করে বিরোধীদল দমন করা হয়েছে, ইসলামফোবিয়া ছড়িয়ে জনগণকে বিভাজিত করা হয়েছে- সেসবের বিরোধিতা করেছি বলে এই নয় যে আসলেই যারা ইসলামের নামে জঙ্গীবাদকে, গণতন্ত্র ও বিচারিক প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করবেন, তাদেরকে আমরা ছেড়ে কথা বলব। আমরা রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদের সাথে সাথে সামাজিক ফ্যাসিবাদেরও বিরুদ্ধে। ফিতনা ও ফাসাদ করা থেকে দূরে থাকুন, যদি এ মাটিকে ভালোবাসেন। নইলে এ মাটি আপনাদের গ্রহণ করবে না।' 

খুব ভালো‌ কথা এটাই যে, গণতন্ত্র সমুন্নত রাখবার ব্যাপারটাই শেষ পর্যন্ত প্রায়োরিটি দিচ্ছেন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের রূপকাররা। গণ-আন্দোলনের ভিতর দিয়ে আসা গণ-মানুষ যদি বিশুদ্ধ গণতন্ত্রের মধ্যে থেকে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের চিন্তা, চেতনা ও দর্শনে সম্মতি দেয় এবং সেটি যদি দেশ ও দশের বৃহত্তর কল্যাণ বয়ে আনে -তবে তাই হোক। আমরাতো বরাবর ভালো, ন্যায্যতা ও বৈষম্যহীনতার পক্ষেই কলম ধরে আছি। একাত্তর প্রশ্নের সমাধান যদি কল্যাণকর কিছু বয়ে আনে তাহলে সেই পথ মসৃন হোক। তবে সবার আগে আমাদেরকে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে হবে আমাদের নতুন বাংলাদেশের মটোটা আসলে কী হবে? ইনক্লুসিভ একাত্তর, নাকি ওনলি এক্সক্লুসিভ ২০২৪? 

লেখক: সাংবাদিক
০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪