দূর থেকে ভেসে আসা সুরের মূর্ছনায় কেমন যেন মাতাল মোহর আভাস পাচ্ছি। সুরটা ঠিক কোথা থেকে আসছে সেটাই আমার মূল ভাবনার বিষয়!
আমি সুরটাকে খুঁজে ছুটছি – দিগ্বিদিক সুরের আবহ আমাকে কেমন করে যে টানছে সেটার বর্ণনা কোনো ভাষাতে প্রকাশ করা কী সম্ভব ?
সেই ভাবনা, এখন কি ভাববার সময় ?
ঠিক ক’টা বাজে সেটা জানতে ইচ্ছা করছে – কিন্তু, আমার হাতে ঘড়ি নেই। শরীরের নিজস্ব সময় চক্র আছে। সেই চক্রে আমি আবদ্ধ।
বদ্ধ কংক্রিটের শহুরে বাগান - যেখানে অট্টালিকা গাছের মতো করে কৃত্রিম ছায়া দিচ্ছে। সূর্যের সাদা আলো যে উষ্মতা দিয়ে থাকে সেটা আমাদেরই তৈরি করা ইট-পাথর দিয়ে গড়া দালান গুলি শুষে নিচ্ছে – আর আমরা?
উত্তপ্ত ঘর আর তার ভেতরের সব ঘরগুলো ইদানীং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত – যেমন নিয়ন্ত্রিত আমাদের জীবন – আর তাইতো, জানালার কাঁচের বাইরের পৃথিবীর দৃশ্যত বিস্ময়কর বিস্তৃতি কেনো যেন কেউ আর দেখে না ~ আজকাল, দেখার মানুষ কই ?
কেউ কি আছে ~ যার কাছে আছে দেখবার মতন দৃষ্টির কাল্পনিক ক্যানভাস – আমার সেই কল্পনা, আমি কাকে বলবো – শুনবে কি কেউ ?
ঘড়ির সময়ের যে অভাব নাই – সময়টা ঘড়িতেই চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান – আজকালকার ডিজিটাল পিকজেলের ডট ডট এর অবিরত টিকটক টিকটক কোরে নি:শব্দে চলতে থাকার অঙ্কে আবদ্ধ আমাদের যন্ত্র জীবন - এ যান্ত্রিকতা, আমাদের কেনো যে পৃথিবী ও তাঁর প্রকৃতির প্রকৃত প্রেক্ষাপট আমাদের দেখতে দেয় না ~ সেটার কারণ আমাদেরই ব্যর্থতা!
আমার প্রকৃতি; আমি আমার মতন করে দেখতে ভালোবাসি। আর আমার এই ভালোবাসা তো শর্তহীন...
ভালোবাসার আরেক রূপ থেকে থাকে ~ তাঁর নিজের বৈশিষ্ট্যের প্রকাশভঙ্গি বা তাঁর ভঙ্গুরতা অর্থাৎ সুর যেভাবে আজ আমাকে টানছে।
চারিদিকে ছুটে চলছে সব মানুষ – কিন্তু কোথায়?
সেটার হিসেব কেই বা জানেন – জানা বা না জানার মধ্যকার আনন্দটা জেনে ফেলা বা না জেনে ফেলাতে অবস্থিত – জেনে গেলেই তো জানার আনন্দের শেষ – আর অনুভবের শুরুর আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন তখনই ~ আনন্দ জিইয়ে রাখার মাঝে যে উচ্ছ্বাস রয়ে থেকে থাকে সেটার স্বতঃস্ফূর্তটা আমাদের বাঁচার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত করতে থকিতে থাকে প্রতিমুহূর্তে – মায়াময় সেই মুহূর্ত গুলি আসলে মায়া না ~ যাপিত বেঁচে থাকার স্মৃতির কেন্দ্রবিন্দু – আর এই বিন্দুটাকে ঘিরেই আমরা কিংবা আমাদের অর্জিত ঘটতে থাকা ঘটনার বাহুল্যতার আর সেটা কুড়িয়ে কুড়িয়ে জীবন এর গল্পের পৃষ্ঠায় নতুন কিছু যুক্ত করতে থাকতে থাকি আমরাই – আর, এই থাকাটাতেই বাঁচার সার্থকতা থেকে থাকে।
আর, আমি থেকে থাকি 'থাকার' ভাবনাকে ঘিরে।
শহরের ঠিক কোন প্রান্ত থেকে সুর হাওয়ায় চড়ে ভেসে উড়ে আসছে সেদিকটাতে আবারো আমার খেয়াল ফিরল – সম্বিত ব্যাপারটা আসলে শব্দের সাথে সব শবের অদৃশ্য সুতোতে গাঁথা থাকে – কে যেন কখন কোথা থেকে এসে আমাদের গোচরে কিংবা অগোচরে কল্পনায় ভাবনার বীজ বপন করে রেখে দেয়াড় খেলায় মাতায় - দেখতে থাকে আমাদের - গাছ চারার বেড়ে ওঠা দেখতে থাকে এই লীলা খেলার হেয়ালে – হেঁয়ালির অন্য পাশ থেকে সে ~ মগজের ভাঁজে যেখানে আমি আটকে রাখি।
আর, তাঁর অপারের যে দেয়াল আছে সেটার খামখেয়াল বড্ড বেপরোয়া হলেও তা-কিন্তু পরিকল্পিত ভাবে গোছানো – হয়তোবা তাই হবে- হয়তোবা তা-না...
নিয়তির বিস্তার যে বিজ্ঞানের অনাবিষ্কৃত সূত্র - অতি গোপন অলৌকিক তত্ত্ব ~ শর্তহীন ভক্তির নির্দিষ্ট ছন্দ।
এসব কিছুই লিখে রাখা আছে সহস্র কোটি লক্ষ্য বছর পূর্বে – হয়ত তখন জন্মেছিলো সময় নিজেই – আর, এই অসময়ের সরল গাণিতিক মীমাংসিত সমস্যা কেউ কখনোই বাদলাতে পারে নাই এবং পারবে না।
আদৌ পালটানো সম্ভব কী ~ প্রশ্নের উত্তর বোধের দ্বন্দ্ব তৈরি ধাঁধা কিন্তু জট বাঁধা শবের দ্রোহের ভাবনার স্নিগ্ধ বিস্ময়কর ভাবে আবদ্ধ।
আপ্রাণ চেষ্টার ফলাফল হয় অশুদ্ধতার শেষের বিশুদ্ধ।
আজ সেই অমিমাংসিত সমাধান আমাকে ডাকছে।
ক্রমশ শহরের কোলাহল ছাপিয়ে কি অদ্ভুত এক সেই সুর আর কাউকে কী ডাকছে না!
আর অন্য কেউ কি শুনতে পাচ্ছে না – নাকি শুনতে পাচ্ছে!
কিন্তু যন্ত্রের ভিড়ে, না শুনতে থাকার ভান করতে ব্যস্ত!
সস্তার নাকি বেশ ক’টা অবস্থা হয় – হয়ত, তবে , এই প্রবনাতা টাই কি সেগুলির কোনো একটা ?
সেটা হতে পারে সম্ভাবনার দায়ের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অলীক ছক কাটা নিবন্ধ?
আজ, স্বভাবের ওই ঘোরাঘুরির ঘোড়া গাড়ি কি আর সুরের এই মায়ার দাপট বইতে পারছে না?
হয়ত বা চাচ্ছে না - তাই বোধহয় সেদিকটাতে কেউই যাচ্ছে না।
আমি শুধু ছুটছি আর ভাবছি – আমার ভাবনার ভুবন যে কতটা সুন্দর সেটা ~ যে বা যিনি ভাবতে পারেন, তিনিই যিনি ভাবের কাঙালিনী ~ ভালোবাসার কাঙাল…
তাইতো সে ব্যতীত আর অন্য কেউ আসলে জানতে পারে না – এই 'না পারাটার' অভাব মূলত আমাদের পেটের দায়ের – সমাজ আর সমাজের সামগ্রিক সমাজ কাঠামোর অসম্পূর্ণতা আর তাঁর সাথে সাথে আরো অনেক কিছু জড়িয়ে থাকার অসম্পূর্ণতা– ঘুণ পোকাদের মতন ঘিরে রেখেছে এই সমাজ – ধীরে ধীরে , সুস্থকে করছে অসুস্থ।
আমাদের সমাজ আর তাঁর উপাদান অর্থাৎ মানুষ গুলিকে – শুধু মানুষ কেনো – আমরা বাকি সব প্রাণ গুলো কে পশু ভেবে নিজেদেরকেই একমাত্র শ্রেষ্ঠ মনে করতে করতে নিজেরাই নিজেদের ' একমাত্র অবশিষ্ট' ভেবে ফেলেছি, বোধহয় – হয়তোবা তাই – হবে হয়ত...
আর, সেটার যথার্থ কারণ যে নাই তা-কিন্তু নয় – কিন্তু, আমরা আমাদেরকে ভুলে থাকতে থাকতে – ঠিকটার 'সঠিকতার' যেই সহজ বোধ বা বোধগম্য আবেশে দম আটকে চুপিসারে বয়ে চলছে ‘সইতে’ এই আমার থাকাতে থাকাতে।
আমরা কি সইতেই থাকবো? নাহ্ ……..
সে যাইহোক!
আমি, ভাবছি শহরের ঐ প্রান্তে আছে সহস্র শতাব্দী আগের অডিটোরিয়াম।
মঞ্চে আছেন শিল্পীর দল – আছে হরেক প্রকারের বাদ্য-যন্ত্রের সমারোহ – আছে সারিসারি দর্শক আর উটকো না জানি কত দর্শন।
সেখানে আছে – নব্য বিবাহিত দম্পতি – খুনসুটির প্রেম যুগল – একলা কেউ যে নাই সেটাও কিন্তু না সেও যে এক প্রান্তে নিজস্ব স্থান করে নিয়েছে।
আছে স্কুল কিংবা কলেজ পালানো তোরা – ওদের আর দোষ কি, বয়সটা যে হার না মানার – অন্য আরেক দিকে শব্দ নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত, শিক্ষাগত যোগ্যতাহীন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব – তার পাইটু বা সহকারী ছোট্ট ছেলেটাই আসলে সব কাজ করছে – ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কালো চশমার উপর দিয়ে যুবতীর সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত – পাশে থাকা চানাচুর ওয়ালা মামা, ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে হাসি মুখে অকথ্য ভাষায় গালি দিলেও ইঞ্জিনিয়ার সাহেব হাসি বিনিময় করে আবার মুচকি হেসে নিয়ে নিজ কাজে আবারও ব্যস্ত হয়ে পরলেন – ফুচকা আর চটপটির দোকান গুলিতে অল্প বয়সী ছেলেপুলেদের ভিড় কেনো যেন একটু বেশিই মনে হচ্ছে – টক.ঝাল. মিষ্টির সাথে সাথে রয়েছে হাইব্রিড ফার্মের চিকেন ফ্রাই তার জায়গা করে নিয়েছে – সেটা মন্দ কিনা – সেটা সময় বলে দিবে – মানুষের সংস্কৃতি আকৃতি পেতে পেতে সভ্যতা স্বগত জানাতে থাকে – জন্মাতে থাকে সভ্যতার নতুনত্ব।
খেয়াল করে দেখলাম – কে কাকে কি বলছে – সেসব কিছু ছাপিয়ে-দাপিয়ে শিল্পীর সুর চারিদিকটা কে মোহিত করে রেখেছে – ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেঁথে দিচ্ছে সুরেলা মূর্ছনা – কতশত প্রাণ বোধ হয় জেগে উঠছে – সেই সুরের তালে তালে – দুলছে তাদের মনসপঠে প্রেক্ষাপট ... আহ!
কি যে আছে সেই সুরে …
আমি পৌঁছুলাম!
কিন্তু এ কী !
কোথাও কেউ নাই – নেই কোনো মানুষের অস্তিত্ব – কোনো শ্রোতা – কোনো দর্শক বা তাঁদের দর্শন – কাউকে কী এই মায়ার সুর আকর্ষণ করতে পারেনি – পারেনি টেনে আনতে এই বেওয়ারিস প্রান্তরে – এই অরণ্যের কিছু আগের ফাঁকা মেঠো মাঠের এই অদৃশ্য অডিটোরিয়ামে রয়েছে শুধু একটা যন্ত্র – সুরটা সেখান থেকেই সুনির্দিষ্ট তাল. লয়. মাত্রা. মেপে মেপে ক্রমাগত বেজে চলছে – তবে কী – এই সুর তুমি ?
তোমার অস্তিত্ব কি তবে শুধু এই যন্ত্রেই আবদ্ধ ?
তাই বুঝি, কেউ টিকেট কাউন্টারে নিবন্ধন করেননি
কোনো বিনামূল্যের টিকেটের জন্যে ?
এও কি সম্ভব ?
একসাথে এতো মানুষ কি করে যে বোকা হল – তোমার সুরের যাতনায় ?
তুমি তো গাছের পাতার কম্পন – নদীর স্রোতের সাথে মেশা রৌদ্রের ঝলকানি দেয়া ঝিলিক – পাখির কলরবের মিষ্টি ধ্বনিত স্লোগান – মেঘমালার ঘনঘটার নির্যাস – পায়ে হেঁটে হেঁটে চলা যে পথিকের পদধ্বনির উচ্ছ্বাস হয়ে ছিলে সৃষ্টির প্রথম থেকে – কেনো বেঁকে বসলে, এভাবে – এমনটা কি হওয়ার ছিল – যেমনটা আমরা ভেবেছিলাম – তেমনটা যে ‘না হওয়ার’ আক্ষেপ।
জানো? আজ তুমি যন্ত্রের সীমিত আবদ্ধতার কৃত্রিম ঠং দেখিয়েও ~ দেখেও যে না দেখে থাকছো – আর, বলছ সুরের ভাষায়।
নিজেকে ভুলে গেলে কি করে – কথার চয়নও যে সুরের ছোট্ট প্রেম – ভুলনা সেটা।
যেটা আমাদের সেই আদিম চেতনা – আর, তোমার-আমার আমাদের ফিরে ফেরার বিনম্র শপথ।
তুমি যন্ত্রে নও – যন্ত্রের দানব তোমাকে কেড়ে নিচ্ছে – তুমি আর কত কাড়বে যন্ত্র সেজে?
এ যে শুধু এই যুগ.কাল. সময়ের নয় – বহু পুরোনো এই ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ আকাঙ্ক্ষা – তোমার নিজেকে ফিরে পাওয়ার বেদনার তৃষ্ণা – দিব্বি যে দিব্য দৃষ্টির বলে মানুষ পায় তোমার দেখা – আর আমি, আমার আমিতেই তোমাকে বারবার খুঁজে বাঁচি – অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা আমার যে তোমার মতন না।
তাইতো , তুমি আমাতেই ফিরে আসতে চাও বারংবার – ঝর্ণার ধারে বসে আমরা তাই ভাবি – তোমাদের মিলন যবে হবে 'তবের' অপেক্ষার ভাবনাতে 'কবের' উপেক্ষিত উৎসবের...
আর তাইতো…
বাঁচুক সুর – বাঁচো তুমি – আমাদের সঙ্গে ওদের দূরত্ব একটুকুও কমাই নি, জানো তো ?
আমরা শুধু আমাদের গল্প শুনবো না ~ তোমাদের দেখবো বলে।
বলো , তুমি আসবে ?
আর তাইতো আমি …