Posts

গল্প

শুধু একটি সাদা গোলাপ

September 5, 2024

দানিয়েল

57
View

ছোট্ট একটি গ্রাম, নাম মেঘডুবি। গ্রামটি কোলাহল থেকে দূরে, সবুজে ঘেরা। এখানে সবাই একে অপরের আপন। সেই গ্রামের এক প্রান্তে বাস করতেন আমার এক চাচা। নাম তার করিমুল। করিমুল চাচার বয়স হয়েছিল প্রায় সত্তর। স্ত্রীকে হারিয়েছিলেন বহু বছর আগছ। তার একমাত্র ছেলে শহরে গিয়ে নতুন সংসার পেতেছিল। তাই করিমুল চাচার জীবনে সঙ্গী বলতে ছিল কেবল তার প্রিয় গরু আর গোপি। গোপি ছিল একেবারে সাধারণ একটি গরু। না খুব বড়, না খুব ছোট। কিন্তু করিমুল চাচার কাছে গোপি ছিল তার জীবনের শেষ অবলম্বন। একমাত্র এই গরুটির সাথেই তিনি তার দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নিতেন। সারা দিন তাকে খাওয়াতেন, গোসল করাতেন, আর রাতে তাকে তার ছোট্ট ঘরে রেখে পাশে থাকা বিছানায় শুয়ে পড়তেন। গোপির সাথে গল্প করতেন। গোপি যেন তার নীরব শ্রোতা ছিল। একদিন হঠাৎ করেই চাচা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বয়সের ভারে তার শরীর এতটাই ন্যুব্জ হয়ে গিয়েছিল যে তিনি আর উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না। গ্রামের ডাক্তার এসে বললেন, "চাচা, আপনার এখন বিশ্রাম দরকার। কোনো কাজ করতে যাবেন না।" কিন্তু চাচার মাথায় তখন একটাই চিন্তা—গোপি। কে তার খেয়াল রাখবে? পরদিন সকালে চাচা উঠে বসলেন। কিন্তু হাত-পা ঠিকমতো চলছিল না। তিনি এক হাতে লাঠি আর অন্য হাতে গোপির রশি ধরে বললেন, “আরে ও গোপি, তুই আমার শেষ সঙ্গী। কিন্তু আমি তোর আর খেয়াল রাখতে পারছি নারে। তোকে ভালো রাখা আর আমার সাধ্যে নেই।” কাঁপা কাঁপা হাতে তিনি গোপির গলায় একটা সাদা গোলাপ বেঁধে দিলেন। তারপর আমাকে সাথে নিয়ে চাচা গ্রামের বাজারের দিকে রওনা দিলেন। রাস্তার প্রতিটি পদক্ষেপে চাচার চোখে পানি চলে আসছিল। বাজারে পৌঁছে তিনি গোপিকে দাঁড় করালেন। গ্রামের লোকেরা তাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, “শেষ‌ পর্যন্ত গোপিকে বিক্রি করছো তাহলে?” করিমুল চাচা কেবল মাথা নত করে সায় দেয়। একজন ব্যবসায়ী এসে গোপির দাম বলল, কিন্তু চাচা একটুও দরাদরি করলেন না। তিনি কেবল চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখের জল গোপনে মুছলেন। গোপিকে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, চাচা তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বাজার থেকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে করিমুল চাচা একা হয়ে গেলেন। সেই রাতে তার ছোট্ট ঘরটি যেন আরও ফাঁকা হয়ে গেল। ঘরে কোনো শব্দ ছিল না। শুধু একটি সাদা গোলাপের স্মৃতি রয়ে গেল। পরদিন সকালে গ্রামের লোকজন করিমুল চাচার ঘরে গিয়ে দেখল তিনি আর বেঁচে নেই। তার নিথর দেহ বিছানায় পড়ে ছিল। আর তার হাতে ছিল একটি শুকনো সাদা গোলাপ। গ্রামবাসী বুঝতে পারল, করিমুল চাচার এই জীবনের শেষ সঙ্গীও তাকে ছেড়ে গেছে। তারা তাকে গ্রামের কবরস্থানে সমাধিস্থ করল। হাতে থাকা শুকনো সাদা গোলাপটি তার কবরে রেখে দিল। গ্রামের মানুষদের মনে সেই গোলাপের মতোই একটি স্মৃতি রয়ে গেল—এক বৃদ্ধ মানুষ ও তার প্রিয় গরুর কাহিনী, যা শুধু ভালোবাসায় মোড়া।

Comments

    Please login to post comment. Login