Posts

চিন্তা

জাতীয় সংগীত: আমি কোথায় পাবো তারে

September 6, 2024

ফারদিন ফেরদৌস

85
View



গেল ৭ আগস্ট বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশের দায়িত্বগ্রহণের আগে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এনডিটিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে তার প্রভাব ভারতের সেভেন সিস্টার্সেও পড়বে। বুঝাই যাচ্ছে সাত বোনের ভাগ্যরেখায় এদিকের এক ভাইয়ের ব্যাপক ভূমিকা আছে। 

১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে রেড মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের ওয়ালাইকুমুসসালাম বলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন। সেই সাথে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার, ত্রিপুরাও আমার। এগুলো ভারতের কবল থেকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মানচিত্র পূর্ণতা পাবে না'। 

দূরদর্শী মাওলানা ভাসানী কিংবা ড. ইউনূস যে বাংলা পরগণায় একদিন হুইশেল ব্লোয়ার হবেন এটা তার জামানায় টের পেয়েছিলেন রবিঠাকুর। 

১৯০৫ সালে বাংলার নিখাদ ভূমিপুত্র গগন হরকরার 'আমি কোথায় পাব তারে'র সুরে অনুপ্রাণিত হয়ে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রবিঠাকুর বাউল ঘরাণায় লিখলেন তাঁর বিখ্যাত গান, 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি'। 

২০২৪-এ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীদের ঘোষিত দ্বিতীয় স্বাধীনতায় আমাদের অনেকেই সেভেন সিস্টার্সের মানচিত্রে আমাদের দেয়াল রাঙিয়েছি। আমাদের সুরে কথা বলেছেন বাংলাদেশের এই সময়ের লিডার ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পাকিস্তান আমলে একই কথা বলে গেছেন বাংলাদেশ আন্দোলনের পুরোধা মুরুব্বি মাওলানা ভাসানী। 

তাহলে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ রদের কথা বললেই দোষ? আপনারা যা চান সেটিই তো রবিঠাকুর চেয়েছেন। আপনাদের ন্যারেটিভ আর তাঁর ন্যারেটিভে পার্থক্য তো নেই। আপনারা পশ্চিমবঙ্গ উড়িষ্যা, বিহার পেরিয়ে দিল্লি পদাবনত করবার স্বপ্ন দেখেন না? তাহলে ভারতবর্ষের মানুষ হয়ে দুই বাংলার মিলন দেখতে চাওয়াটা রবিঠাকুরের ভুল কীসে? 

আসল সমস্যা এখানে না। রবিঠাকুরকে আপনারা হিন্দু ঠাওরে ঘৃণার বস্তু বানিয়েছেন। অথচ রবিঠাকুর নিরাকার ব্রাহ্ম ধর্মের অনুরাগী ছিলেন, যেখান থেকে কালী বা দুর্গাপূজায় আচারিক নিষ্ঠবান হওয়া তাঁর অভিপ্রায় ছিল না। সর্বধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল রবিঠাকুর যে জীবনদেবতার আরাধনা করেছেন সেটি চরম মানবতাবাদকেই মহিমান্বিত করে রেখেছে। 

ইতিহাসের ডিভাইড এন্ড রুল নীতি কে না জানে? ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছাড়ার পূর্বে সরকারিভাবে পুরো ভারতজুড়ে ছোট ছোট অন্তত ৫৬৫টি দেশীয় রাজ্য গড়ে দিয়েছিল। এই প্রতিটি রাজ্য বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি মাথায় নিয়ে তাদের নিজ নিজ অবস্থান বজায় রেখে চলছিল। ইংরেজদের গড়া ওই ডিভাইড এন্ড রুল নীতিতে মাত্র পাঁচ হাজার ইংরেজ তিরিশ কোটি ভারতীয়কে শাসন করতে পেরেছিল। কারণ ওই নীতির কারণে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর ভারতীয়রা ছিল বিচ্ছিন্ন, অসংগঠিত। যেকোনো ঠুনকো অজুহাতেই নিজেদের মধ্যে দাঙ্গাহাঙ্গামায় জড়িত হয়ে পড়ছিল গণমানুষ। বঙ্গভঙ্গের ফাঁদে পা দেয়া পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গও এর বাইরে ছিল না। অবস্থা বেগতিক দেখে অন্য ফিলানথ্রোপিস্ট কবি সাহিত্যিক ও হিতবাদি পলিটিশানদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বঙ্গভঙ্গ রদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন রবিঠাকুর। 

সেসময় দুই বাংলার অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় লিখে ফেলেন অমর সংগীত 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।' এই গানটির মাধ্যমে পূর্ববাংলার প্রতি তিনি অকৃত্রিম প্রেম ও পরম মমত্ববোধই দেখিয়েছিলেন। আর আপনারা কিনা মিনিং দাঁড় করাচ্ছেন পুরোই উল্টো। 

কেউ কেউ আরেক কাঠি সরেস। রবিঠাকুরের গান বাতিলের খাতায় ফেলে রাখতে রীতিমতো লেখকের চরিত্রের ওপর মিথ্যা কালিমা লেপন করছেন। রবিঠাকুরের পূর্বপুরুষ পতিতালয় চালাতেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন, প্রজা নিপীড়ক ছিলেন, মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ দেখিয়েছেন; ইত্যাকার নানা অসত্য অভিযোগে জর্জরিত করেন। অথচ সেদিনের মানুষ রবিঠাকুরের খুব অথেনটিক জীবনী গ্রন্থ চাইলেই সংগ্রহে পাঠ করে নেয়া যায়। রবিঠাকুরের গান শুনতে না চাওয়া আপনার অধিকার। সেই অধিকারকে জাস্টিফিকেশন দিতে যা নয় তাই বলে কারো চরিত্রের ওপর কালিমা লেপন করাটা ঘোরতর অন্যায়। 

বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে স্বদেশী আন্দোলনের সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল এই গান। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী রাজনীতিক, স্বদেশী কর্মী ও বিপ্লবীরা বাঙালি জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যম হিসেবে এই গান প্রচার করেন। 

১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপকধর্মী চিরসবুজ সিনেমা ‘জীবন থেকে নেওয়া’-তে এই গান প্রথম ব্যবহার বরেণ্য চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। 
রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আগেও গানটি গাওয়া হয়। 
পরবর্তীতে মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার এই গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত পরিবেশিত হয়। মুক্তিযোদ্ধা এই গান গেয়ে দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত হন।
স্বাধীনতার পর দেশের সংবিধানের ৪.১ অনুচ্ছেদে গানটির প্রথম দশ চরণ জাতীয় সংগীত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। 

খেয়াল করেন ভাইসব, রবীন্দ্রবিদ্বেষ উগ্রে দেয়ার আলাপ দিয়ে আওয়ামী রেজিমের ফেসিজম তো ভুলে বসছেন না? আপনাদের প্রথম প্রায়োরিটি হওয়া উচিত দেশ পুনর্গঠন ও অন্ধকারে বিলীন হওয়া রাষ্ট্রীয় সিস্টেমের সুসংস্কার। একাত্তরের গণ আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে আমরা যে দেশ পেয়েছি সেই দেশ আওয়ামী লীগ নিজেদের হীন স্বার্থে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে। ভেবে দেখুন আপনারা বিপর্যস্ত দেশ জাগিয়ে তুলবেন নাকি, মীমাংসিত জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা নিয়ে অগ্রহণযোগ্য বাজে বয়ানে মনোনিবেশ করবেন? 

১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের এসাসিনেশনের পর খন্দকার মোশতাক সরকার এবং পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান সরকার জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাবনা আনেন। সেসব প্রস্তাবনা কার্যকরী হয়নি। ২০০১ এ আসা বিএনপি সরকারের দুই মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনে লিখিত প্রস্তাবনা আনেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ওই প্রস্তাবনা বিবেচনার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠান। ফাইনালি সে প্রস্তাবনাও টেকেনি।
স্বাধীনতার তিপ্পান্ন বছর পর এবার আরেকবার জতীয় সংগীত পরিবর্তনের আলাপ উঠছে। 

একাত্তরে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামের ভুখন্ড বিশ্ব মানচিত্রে গৌরবময় জায়গা করে নিয়েছে। মহান মুক্তিযোদ্ধারাই 'আমার সোনার বাংলা' গানটি তাদের স্বপ্নের স্বাধীন দেশের ন্যাশনাল অ্যান্থেম বলে মান্যতা দিয়েছে। কবি কাজী নজরুল ইসলামের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও তারা প্রতিবাদের স্বরূপ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এখন আমরা যদি মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করতে চাই, সেটি আমরা পারব না এমনটা নয়। কিন্তু নিজেদের গৌরবময় অতীতকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিতে চাইলেই কি তা মুছে ফেলা সম্ভব হবে? শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, বীর ও বীরাঙ্গনা যারা জীবনবাজি রেখে পাকিস্তানের আধিপত্য, জুলুম ও চরম বৈষম্য রুখে দিয়ে 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ' নামক দেশটি এনে দিয়েছেন তাদের মতামতকে পাশ কাটানো বা অগ্রাহ্য করবার প্রাধিকার আসলে কাদের? নতুন জাতীয় সংগীত? আমরা কোথায় পাবো তারে? বাউল গগন হরকরারা কি সবখানে সবকালে জন্মান? 

লেখক: সাংবাদিক
৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

Comments

    Please login to post comment. Login